প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সিএনএন’র একটি বিজ্ঞাপন আছে। যেখানে একটা আপেলেরে ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে “এটি একটি আপেল”। কিছু মানুষ আপনাকে বলার চেষ্টা করছে, “এটি একটি কলা”। তারা চিৎকার করতে পারে, “কলা, কলা এবং কলা বলে”। পরিস্থিতি এক সময় এমন দাঁড়াবে যে আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করবেন যে, এটি একটি কলা। কিন্তু আসলে ওটা আপেলই ছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস’র গ্রন্থ-সমালোচক মিচিকো কাকুতানি তার আলোচিত ‘দি ডেথ অব ট্রুথ’ বইটি এই বিজ্ঞাপনের আলোচনা দিয়ে শুরু করেছেন। সম্ভবত তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে আমেরিকার পরিস্থিতি যেভাবে অনুধাবন করছিলেন, তা মোটা দাগে ‘আপেল’কে ‘কলা’ প্রতিপন্ন করার মতো। হতে পারে এই বইটি আমি পড়েছিলাম বলেই বর্তমান বাংলাদেশকে আমার ‘দি ডেথ অব ট্রুথ’র এর একটি যথোপযুক্ত সংস্করণ মনে হচ্ছে।
প্রথমেই বলে রাখি, আমি রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার নই, এমনকি কোন রাজনৈতিক দলের সাথেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত নই। তবে অবশ্যই সমর্থক। না হলে অন্তত ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কোন প্রয়োজন ছিলনা! রাজধানীর মিরপুরের একটি পুরোনো স্কুলে আমার ভোটকেন্দ্র পড়েছিল। সকাল ১১টার দিকে যখন যাই, গিয়ে শুনি পুলিশের সাইরেন বাজছে কিন্তু কেউ ভিতরে যেতে পারছেন না। গণ্ডগোল হচ্ছে। অগত্যা ফিরতে হলো। বেলা ২টার দিকে যখন গেলাম, ভোটার স্লিপ ছিল না। ভোটার নং মনে ছিল। কিন্তু ভোটার স্লিপ ছাড়া ঢুকতে দেয়া হলো না। স্লিপ আনার পরেও ভোট দিতে গিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হলো। আমার প্রতি পাহারাদার ব্যক্তিদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ছিল। তাদের পছন্দ মতো মার্কাতে ভোট দিবো কি না তা নিয়ে ওরা সংশয়ে ছিল। যার কারণে সরকারি দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত আমার ক্লাসমেটের সুপারিশ প্রয়োজন হয়েছিল ভোট দিতে। ভিতরের দৃশ্য সম্পর্কে বলাটা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’র আওতায় পড়ে বলে আপাতত বাদ রাখলাম। এইখানে ভোট না দিয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল আমার বন্ধু মায়ের। ‘আমি তো আওয়ামী লীগ করি’ বলেও ফিরে যেতে হয়েছিল আমার সমবয়েসী একজন ভোটারের। এই ছিল আমার চাক্ষুষ নির্বাচন প্রক্রিয়া।
এখানে আপেল আর কলার মিলটা কোথায়? যেখানে আমার মতো অসংখ্য জনগণ এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। তাদেরকে “নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে” বলাটা হচ্ছে ‘কলা’ বলে চিৎকার করার মতো আর ‘নির্বাচন’টা দেখানো হচ্ছে ‘আপেল’র মতো ব্যাপার। যাই হোক, নির্বাচনের আগে পরে যা ঘটছে সেই সব পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে কিছু বিষয় নিয়ে বলা যাক, যা অন্তত আমাদের জনগণকে একটু হলেও সতর্ক করবে বলে আমার বিশ্বাস।
ড. কামাল হোসেন ও একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের দায়:
দশ বছর ধরে চলা একটি গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি যেখানে ভয়াবহ কিছু ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে পুরোপুরি রূদ্ধ করার কাজ ভালোভাবেই করা হয়েছে। সরকার সেখানে প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে ‘গণতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনাটা ড. কামাল হোসেনের দায় ছিল। সম্ভবত এই বয়সে তিনি একজন সংসদ সদস্য কিংবা দেশের রাষ্ট্রপতিও হতে চান না। শুধু রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করাটাই ছিল এই বর্ষীয়ানের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্য। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এতই উত্তেজিত ছিল যে, ড. কামালের গাড়ি বহরে হামলা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। কিংবা ‘জনৈক’ সাংবাদিককে ‘খামোশ’ বলায় তাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছে অথচ তার মাত্র দু’দিন আগেই সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল ৫৮টি অনলাইন সংবাদপত্র। রাজনৈতিক ‘কুটকৌশল’র বাইরের একজন নেতা ড. কামাল হোসেন। এই সংসদ নির্বাচনে তার ভূমিকাকে সাধুবাদ দেয়া নাগরিকদের দায়িত্ব। অন্তত তিনি দেখিয়েছেন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হয়?
সত্যিই ‘মূর্তি’র মত ছিলেন যারা:
নির্বাচনের আগে ঝড় উঠেছিলো পর্যবেক্ষকদের ‘মূর্তি’র মতো থাকা নিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য মূর্তিরা যখন কথা বললেন তা চুপ করে থাকার চেয়ে বেদনাদায়ক হয়ে উঠলো। ব্রিটিশ মানবাধিকার কর্মী ডেভিড বার্গম্যান নির্বাচনের পরদিন একটি টুইটে লিখেছিলেন, আজ আরেকটি প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়েছে। সে প্রতিষ্ঠানটি ছিল সমগ্র পর্যবেক্ষকরা। যাদের দায়িত্ব ছিলো নির্বাচন পর্যবেক্ষণের তার পর্যবেক্ষণ করলেন শ্রেফ সরকার দলীয় রাজনীতিবিদদের কথা। সরকার দলীয় নেতারা যা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যা বলেছেন তারই সুরে সুর মিলিয়ে পর্যবেক্ষকরা একই গান গেয়েছেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র ক্যামেরায় ধরা পরেছে, সকাল ৮টা বাজার আগেই ব্যালট ভর্তি বাক্স নিয়ে নেমে গেছে এজেন্টরা সেখানে নির্বাচন তাদের কাছ ‘সুষ্ঠু’ মনে হয়েছে। এরটা বুঝতে নির্ঘাত উচ্চমার্গীয় পজেটিভিটি’র চোখ প্রয়োজন। যা কোন বিবেকবান মানুষের থাকতে পারে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মিডিয়া, প্রায় সব প্রতিষ্ঠান যে ভাবে গোটা জনগণের সাথে মিথ্যা বলছেন এবং এই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসী কায়দায় বল প্রয়োগ শুরু হয়েছে তা থেকেই মানুষ বুঝে গেছে কেমন বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছি আমরা। গোটা জাতির সাথে এমন প্রকাশ্য মশকারির মাশুল কি হবে তা ভাবার মতো সময়ও এখনও আসে নাই। তবে মাশুল যে গুণতে হবে তা ইতিহাসের সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আছে।
জনগণই আবার আশার আলো যেভাবে
স্থানীয় নেতাদের ধমক খেয়ে হয়তো ভোট না দিয়ে ফিরে এসেছে, কিন্তু জনগণ কি আদৌ মস্তিষ্কশূন্য কিনা? — সে প্রশ্ন করে ফেলাই যায় এখন। কিন্তু না। গত কয়েখ দিনের সোশ্যাল মিডিয়ায় জনমানুষের মনোভাবে সেটা পরিস্কার। এদেশের মানুষ দমনের শিকার, এক রকম অসহায়। ফেসবুকে একজন স্ট্যাটাস দিয়েছে, “কেউ বলবেন আমার ভোটটা কি দেয়া হয়ে গেছে? যদি হয় তাহলে আর এই সকালে ঘুম থেকে উঠবো না!” জনগণের অনুধাবনে এটি স্পষ্ট যে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করছে না। কিন্তু যেভাবে তারা সরকারি বাহিনী ও নেতা-কর্মীদের দিয়ে ‘বাহুশক্তি’র বলয় তৈরি করেছে তার সামনে অন্তত সাধারণ মানুষের লড়াই সম্ভব না। মূলত রাজনৈতিকভাবে আমাদের মৃত্যু হয়নি, তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়— সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকালে। ট্রলের মাধ্যমে খোঁজা হচ্ছে পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের জায়গাগুলো। জনপ্রিয় গীতিকার ও অভিনেতা মারজুক রাসেল তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “সারাবছর না-পইড়া-লেইখা পরীক্ষার আগের রাইতে পড়াশোনা-করা-জাতির কাছে কেমন ফলাফল আশা করো মামু”। অথবা এমন একজনের কমেন্ট উল্লেখ করা যেতে পারে। যিনি লিখেছেন, “ড. কামাল বলেছিলেন ফজর পড়ে সবাই যেন কেন্দ্র পাহারা দেয়, কে জানতো প্রধানমন্ত্রী তাহাজ্জুদ পড়ে বাক্স ভরে ফেলবেন”। এই বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য করলে অন্তত আমাদের বিবেকের জাগ্রত ভাবটা নিয়ে শঙ্কিত না হলেও চলে। কিন্তু ‘বাহুশক্তি’র বিরুদ্ধে দাঁড়ানো জরুরি। জনগণ জানে আমার ‘ফ্যাসিবাদী’ বা ‘স্বৈরাচারী’ শাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। খুব দ্রুতই যা প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হবে। তাই ‘বাহুশক্তি’র একটা পরিণতি দরকার।
পুরনো বাংলা সিনেমা এবং পিতার স্বপ্নপূরণ
যে সময়টাতে আমাদের টেলিভিশন ছিলনা। আমরা অন্যবাড়ি গিয়ে শুক্রবারের সিনেমা দেখতাম। তখনকার প্রায়ই সিনেমায় দেখতাম- পিতার স্বপ্নপূরণের জন্য জসীম, বাপ্পারাজ কিংবা ওমর সানীরা যে পরিমাণ ত্যাগ শিকার করেছে, তাতে নিজের স্ত্রীকে ‘ডিভোর্স’ দেয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে, রয়েছে কোম্পানির মালিকের সাথে প্রতারণা, কিংবা শ্বশুরকে মেরে ফেলার মতো ঘটনা (সিনেমার নাম মনে পড়ছে না, তবে আমি নিশ্চিত ‘দৃশ্য’গুলো পরিচিত)। তবে কি সেই দেশ সেই দিকেই হাটছে। গত বছর এপ্রিলে আল জাজিরায় ফয়সাল মাহমুদ তার কলামে লিখেছিলেন, “বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে?” নির্বাচন তার কথা আংশিক প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আর ক্রমান্বয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে শঙ্কা তৈরি করছে— যে বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে? আর ক্ষমতার সেই দৃশ্যে বলি হতে হবে জনগণকে— দেওলিয়া হতে হবে জনগণকে— রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে ‘ডিভোর্স’টাও জনগণকে বরণ করতে হবে। এই মুহূর্তে জর্জিয়া আগামবেন’র একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে, “ক্ষমতার চোখে, প্রত্যেক নাগরিকই কার্যত সন্ত্রাসী”। স্মরণ করা যেতে পারে, ‘আমাদের অবস্থান’। এটা মনে রাখলেই আমাদের কর্তব্যও ঠিক করা সহজ হবে।