In the eyes of power, every citizen is a potential terrorist.
-Giorgio Agamben
এই নির্বাচনে কে জিতেছে?— এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। তবে হেরেছে বাংলাদেশ! আওয়ামী লীগ বিগত আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই একটা আওয়ামীসুলভ নির্বাচনই করেছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে লীগের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সর্বনাশটাও হয়ে গেল। পাঠক আমার কথায় চমকে উঠবেন না। আজ আমি কঠিন কোন তাত্ত্বিক বয়ান পেশ করার জন্য লিখতেছি না। খুবই সাধারণ কিছু কথা-বার্তা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
সেনা নামিয়ে প্রথমে থমথমে পরিবেশ তৈরি করা। এর মাধ্যমে সেনাবহিনীর যে সম্মান ছিল তাকেও এই মিথ্যার জুলমের সাথে মিশিয়ে দেয়া হল। ব্যাপক ভীতির মধ্যে নির্বাচন হলেও মিডিয়াতে বারবার প্রচার হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হচ্ছে। এই একটি কথাই মিডিয়ার অবস্থান বুঝবার জন্য যথেষ্ট। মিডিয়া আসলে সবই বলছে কেবল সত্য ছাড়া।
বিগতদিনের ভোট ডাকাতির সাথে এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় তফাত হল, গোটা দেশে নিয়ন্ত্রিতভাবে সেনা নামিয়ে প্রথমে থমথমে পরিবেশ তৈরি করা। এর মাধ্যমে সেনাবহিনীর যে সম্মান ছিল তাকেও এই মিথ্যার এই জুলমের সাথে মিশিয়ে দেয়া হল। ব্যাপক ভীতির মধ্যে নির্বাচন হলেও মিডিয়াতে বারবার প্রচার হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হচ্ছে। এই একটি কথাই মিডিয়ার অবস্থান বুঝবার জন্য যথেষ্ট। মিডিয়া আসলে সবই বলছে কেবল সত্য ছাড়া। ফলে এইসব নিয়ে কথা বলার মানে হয় না। আসলে নির্বাচনের ফলাফলই এই নির্বাচন কেমন হয়েছে সেটা বলে দেয়। এখন দেশি-বিদেশি মিডিয়া, বুদ্ধিজীবীরা যাই বলুক কোন কিছু যায় আসে না। আসলে চুরির মধ্যেও একটা ব্যাপার থাকতে হয়। যেমন অভিনয়ে অতি নাটকীয়তা থাকলে হাস্যকর হয়ে যায়, মানুষ বুঝে যায় এইটা কিচ্ছু হচ্ছে না। তেমনি এই চুরিটাও হয়ে গেছে হাস্যকর। বিএনপিকে ৭টা আসন দিয়ে এই চুরিকে কৌতুকে পরিণত করেছে এই সরকার। এতোটা না দিলেও হতো। মানুষ কিছুই মনে করত না।
প্রথম কথা হল, এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় করে জনগণের সাথে এই মশকারির জবাব এখনও জনগণ চাইতে পারছে না। কিন্তু এটাই শেষ না। নতুন বছরের শুরুতে বাংলাদেশের মানুষ এক ভীতিকর বিষাদ নিয়ে জীবনের যাত্রা শুরু করতে বাধ্য হচ্ছে। এবার ভোট ডাকাতিতে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নাই। মাঠের চিত্রটা দেখলে এটা বুঝতে বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে না। মাঠে দেখা গেছে চারদিকে নৌকার লোক। বিপুল লোক। আর দায়িত্ব পালন করছে এলাকার সবচেয়ে মাস্তান ধরনের লোকগুলো। যাদের দেখলেই সাধারণ জনগণ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তাছাড়া আগের রাতে সিল মারা তো পুরনো নিয়ম। নতুন নিয়ম হলো লোকজনকে ধরে ধরে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা। যা হোক এই নির্বাচনের অনিয়মের ফিরিস্তি দিয়ে আমি সময় নষ্ট করতে চাই না।
আওয়ামী লীগ যেটা করল তা হলো, নিজের রাজনৈতিক অধ্যায়ের ইতি ঘটিয়ে ক্ষমতার দানবীয় পথেই নিজেকে বহাল রাখল। আর এটা সহনীয় করতে মিডিয়া ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। বাংলাদেশে এখন একটা মিথ্যার কিংডম বা সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এই সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রচুর লোক নৌকা নৌকা বলে চিৎকার করেছে। সবাই আসলে আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। এটাই হলো ফ্যাসিবাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। আশার কথা হল, সবাই যখন লীগ করে তখন আসলে কেউ লীগ করে না। লীগ সেজে থাকে।
আওয়ামী লীগ যেটা করল তা হলো, নিজের রাজনৈতিক অধ্যায়ের ইতি ঘটিয়ে ক্ষমতার দানবীয় পথেই নিজেকে বহাল রাখল। আর এটা সহনীয় করতে মিডিয়া ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। বাংলাদেশে এখন একটা মিথ্যার কিংডম বা সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এই সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রচুর লোক নৌকা নৌকা বলে চিৎকার করেছে। সবাই আসলে আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। এটাই হলো ফ্যাসিবাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। আশার কথা হল, সবাই যখন লীগ করে তখন আসলে কেউ লীগ করে না। লীগ সেজে থাকে। ফ্যাসিবাদের করুণ পরিণতি হয় এই মিথ্যার প্যাঁচে পড়েই। সে যেমন গালগপ্প প্রচার করে। জনগণকে বিশ্বাস করে তেমনি সেও এইসব ফেইক মানুষের উচ্ছ্বাস দেখে ভাবতে থাকে সে অনেক জনপ্রিয়। কিন্তু যখন এই ফেইক ও সত্যের সংগ্রাম শুরু হয় তখন পরিস্থিতি করুণ থেকে করুণতর হতে থাকে।
এই ফেইক উম্মাদনার এই প্রক্রিয়াকে শক্ত করতে তারকা, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, ইতিহাস সব কিছুকেই ব্যবহার করা হয়েছে। আর আছে টাকার ব্যবহার। বিদেশি গোয়ান্দাদের ব্যবহারের কথা আমরা সবাই জানি। ভারতের ঢাকাস্থ গোয়েন্দা প্রধানের নাম ভারতীয় সাংবাদিকরাই প্রকাশ করেছেন। যার নেতৃত্বে এই নির্বাচনের নিরব ভোট ডাকাতির বিপ্লব শান্তিপূর্ণভাবেই করা সম্ভব হয়েছে। আর এতে আমাদের পুলিশ, সেনা সবাইকে একটা মিথ্যা মঞ্চস্থ করার কাজে সফলভাবে ব্যবহারের প্রতিভা দেখে যারা হতাশ হয়েছেন তাদের জন্য আমার বক্তব্য অতি পরিস্কার, আপনারা বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদের চরিত্র এবং এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবেন নাই। এই বিষয়ে কোন সতর্কতা নাই।
তাইলে আমরা দেখছি, ফ্যাসিবাদের যেমন কোন মতাদর্শ থাকে না তেমনি থাকে না কোন রাজনীতি। শুধু ভরসা একটা দানবীয় সংগঠন। এটাই ফ্যাসিবাদের মূল শক্তি। এই সংগঠন গ্রামে গ্রামে শক্ত ভিত্তি যে গড়ে তুলেছে তা এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সরাসরি দেখতে পেলাম। এর সাথে যুক্ত হয় ভাড়াটিয়া নানান বাহিনী। পুলিশকে নির্বাচনের ডিউটির জন্য ৭ থেকে ১০ হাজার নগদ টাকা দিয়ে এক দিনের জন্য কিনে নেয়ার সহজ কাজটি করা তেমন কোন জটিল বিষয় না। অন্য বাহিনীর কথা আর না বলি।
‘The Mass Psychology of Fascism’ নামক বিখ্যাত বইয়ে Wilhelm Rech যেমন বলেন, “Today not a single individual who dose not have the elements of fascist felling and thinking in his structure”.
আমরাও দেখতে পাচ্ছি, এই যে গণমনের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা তা ধীরে ধীরে বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে। এক ব্যক্তির শাসন ও সেই ব্যক্তিকে মিথিক্যাল ভাবা শুরু হয় ক্রমে। তার শাসনক্ষমতা নিয়ে জনমনে মিথ বা কল্পকাহিনী তৈরি করা। আর এখন মিডিয়া সহজলভ্য থাকাতে সেই মিথের বিজ্ঞাপন খুব চকটদার পদ্ধতিতে প্রচারিত হয় ক্রমাগত। এভাবেই ‘মিথ অব স্ট্রং লিডারশিপ’র মিথ শক্তিশালী হয়। কিন্তু জনগণ এই মিথ্যাচার ও প্রকাশ্য গুন্ডামিকে প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। সত্য উচ্চারণের সাহস ধীরে ধীরে তলানিতে নেমে আসে। মিডিয়াতে প্র্রচারিত হচ্ছে, আওয়ামী লীগ একটি দল নয়, একটি অনুভূতির নাম। এটা খুব গর্ব ভ’রে প্রচার হচ্ছে এখন। এই অবস্থায় দলীয় গুণ্ডাদের ও নির্বোধ জনতার মিথ্যার উপর এই বিশ্বাসকেই জনগণের শক্তি ধরে নিয়ে শাসক আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিরোধীদেরকে দমনে সরকারি শান্তি, অস্ত্র ও দলীয় জনগণের দোহাইকে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে এটা প্রতিদিনের চিত্র।
এবার আসেন, এমন একটি অবস্থায় বিরোধী দলে থেকে ঐক্যফ্রন্ট জিতে নতুন সরকার গঠন করতে পারবেন এই আশা যারা করেন তাদের রাজনীতির পাঠে সমস্যা আছে। এইটা ঐক্যফ্রন্টও মনে করে না। কিন্তু জনগণের কাছে ‘ফ্যাসিবাদ কতটা শক্ত অবস্থানে আছে’, সে মেসেজটা পৌঁছানোর জন্য এটা দরকার ছিল। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দানবীয় বাহিনীর সামনে জনগণকে ঠেলে দিয়ে ভোট বিপ্লব করে ক্ষমতা নেয়ার যে আরামদায়ক পথ তা কোন বাস্তব বা ইতিহাস সম্মত পথ নয়। কাজেই এই বিরোধীদের তরফেও এই ফ্যাসিবাদের শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তিকে প্রথমে, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে মোকাবেলার কোন কৌশল ও নীতি ছিল না। তার মানে একটা সহজ পথে ক্ষমতার পরির্বতনের বাইরে আর কোন গঠনমূলক রাজনীতিও তাদের দিক থেকে ছিল না। লীগের কুশাসনের ফলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে আবার বিএনপির শাসনে হতাশ হয়ে লীগ আসবে এই চক্রের অবসানের একটা সুযোগ বাংলাদেশ পেয়েছে। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রশংসা করতে হয়। তিনি ২০১৪ তে সঠিক ছিলেন। এবং এখন জেলে থেকে, সব জুলুম সহ্য করে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে নিজ দলের নেতা-কর্মী ও জনগণকে চেনালেন— লীগ কি চিজ! এবং তিনি লীগের রাজনীতির ১২টা বাজিয়ে ছেড়েছেন। যদিও ক্ষমতার দিক থেকে চিন্তা করলে যে ধরনের রাজনীতি শুরু করা দরকার তা এখনও পর্যন্ত বিএনপি শুরু করতে পারে নাই। তবে এই শুরুর জন্য খালেদা জিয়ার মতো একটা কোমল ক্ষমতার অ্যাপ্রোজ আছে এমন নেতার দরকার। সমাজে নতুন রাজনীতি গঠনের যে তাগিদ তৈরি হয়েছে এটাই বড় অবদান এই ফ্যাসিবাদের।
অন্যদিকে সরকারি দলের ছিল ভারতবাদী অবস্থান ঐক্যফ্রন্ট পশ্চিমাদেশগুলোর দিকে ঝোঁকে ছিল। জনগণের দিক থেকে রাজনীতি গড়ে তোলার দিকে কেউ ছিল না কার্যত। কাজেই দুই তরফের এই রাজনীতিহীন দেওলিয়াপনার মধ্যে এই ধরনের ফ্যাসিবাদের উত্থানের ফলে গণমনে যে অনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার হতাশাজনিত ক্লান্তি তার রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এই অবস্থার অবসানের জন্য যে রাজনীতি দরকার তা শুরু করা ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তির আর কোন পথ নাই এটা ধীরে ধীরে পরিস্কার হতে শুরু করেছে।
জনগণ দেখতে পেল আমাদের ফ্যাসিবাদ কত আহ্লাদি। ভোট দখল ও গুণ্ডামিকে মনে করে তাদের অধিকার। এমন একটি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সন্ত্রাসের মুখে অসহায় জনগণকে ঠেলে দিয়ে তাদের কাছ থেকে ভোট আশা করা এবং সেই ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর সংগ্রামকে সফল করার স্বপ্ন যারা দেখেন তারা রাজনৈতিকভাবে নতুন বাংলাদেশের জন্য অনুপযুক্ত। কথা ছিল ভোটটা হবে আন্দোলনের অংশ। এই জন্যই আমরা জনগণকে ভোটে অংশ নিয়ে নিজের ভোট দেয়ার চেয়ে ভোট রক্ষার জন্য আহবান জানিয়েছিলাম। কিন্তু এমন সংগঠিত সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে বিরোধীদল আরও সুসংগঠিত না হওয়ার ফলে ভোট রক্ষা তো দূরের কথা ভোট দেয়াই সম্ভব হয় নাই। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে মানুষ ছিল জিম্মি। ফলে এই আশা যে কোন কার্যকর রাজনৈতিক দিশার দিকে নিয়ে যাবে না তা সাধারণ জনগণই বুঝতে পেরেছিল। জনগণ জানে লীগ যে কোন মূল্যে জিতবে। এই যে কোন মূল্যটা যে এতো হাস্যকর ও লজ্জাজনক হবে তা অবশ্য বুঝতে পারে নাই। যারা সাধারণ লীগ সমর্থক তাদের লজ্জায় ফেলে দিয়েছে এই ডাকাতিয়া বিজয়।
দেশে দেশে। যুগে যুগে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের এমনকি আমাদের দেশেও প্রথম মুজিব আমলের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের যে ইতিহাস আছে তা আমলে নিলে হতাশ হওয়ার সুযোগ নাই। ১৯৭৩ সালে নির্বাচন এবং বাকশালী জুলুমের বিরুদ্ধে গণবাহিনীর রক্তাক্ত সংগ্রামকে মাথায় রাখলে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই বর্তমান সময়ের টেকনো-ফ্যাসিবাদের দিকে, সরকারি সুবিধার দিকে ঝুঁকে সমাজের বৃহত্তর একটি অংশ অনৈতিকভাবে স্বাধীনতাহীনতার ভেতর বেঁচে থাকতে মোটেও লজ্জিত হচ্ছে না। ভোটের দিনে যে বিপুল টাকা ও জনসাধারণকে ব্যবহার করে ২১ লাশ পড়ার পরেও যে শান্তিপূর্ণ ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতার প্রকৃত ফ্যাসিবাদী রূপান্তর হতে যাচ্ছে এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারতে হবে। আমদের এই গণমননকে বুঝতে না পারলে নতুন রাজনীতি সম্ভব হবে না।
এখনও কেন এতো বিপুল মানুষ আওয়ামী লীগ করে। এক. এরা রাজনৈতিকভাবে অশিক্ষিত। দুই. অনৈতিকতা বা গুণ্ডামিকে পূজা করতে আপত্তি নাই। তিন. পরিবারের বা ব্যক্তিগত লোভের কারণে বা টাকার প্রয়োজনে। চার. মিথ্যা প্রপাগান্ডা, ইতিহাসের দলীয় বয়ান ও মিথ্যার উপর ঈমান রেখে বসে আছে। পাঁচ. লীগ করে না আসলে লীগ সেজে আছে। এগুলাই মোটে দাগে আসল কারণ। এই অবস্থার যে সামাজিকীকরণ হয়েছে তা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষতির দিক।
এখনও কেন এতো বিপুল মানুষ আওয়ামী লীগ করে। এক. এরা রাজনৈতিকভাবে অশিক্ষিত। দুই. অনৈতিকতা বা গুণ্ডামিকে পূজা করতে আপত্তি নাই। তিন. পরিবারের বা ব্যক্তিগত লোভের কারণে বা টাকার প্রয়োজনে। চার. মিথ্যা প্রপাগান্ডা, ইতিহাসের দলীয় বয়ান ও মিথ্যার উপর ঈমান রেখে বসে আছে। পাঁচ. লীগ করে না আসলে লীগ সেজে আছে। এগুলাই মোটে দাগে আসল কারণ। এই অবস্থার যে সামাজিকীকরণ হয়েছে তা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষতির দিক।
লীগ নিজে একা পঁচেছে তাই। সাথে যারাই গেছে তাদের পরিণতি হয়েছে লেজ কাটা শেয়ালের মতো। এরশাদ, বি চৌধুরী এমনকি হেফাজতের শাহবাগি পরিণতিও আমরা দেখেছি। এ এমন এক মেশিন যার ভেতর যেই ঢুকবে সেই শয়তানের শিষ্য হয়ে বের হবে। শয়তানের পূজার এই আলামত জাতির জন্য সবচেয়ে হতাশার। এটাই সবচেয়ে বেশি আমাদের ক্ষতি করছে।
এখন এই বাস্তবতার ভিতর চোরের মার বড় গলা সহ্য করে স্বাধীনতাকামী ও গণতন্ত্রমনা যারা বেঁচে থাকতে চেষ্টা করবে তাদের নির্মমভাবে দমনের কাজও কঠোর ভাবে শুরু হবে। ফ্যাসিবাদী শাসনে দলীয় ও সরকারি শাসনের ভেদরেখা উঠে যায়। দলীয় স্বার্থের দিক থেকে পরিচালিত সব কাজই সরকারি মোড়কে হাজির করা হয়। কাজেই এই দানবীয় দলের বিরোধিতাই হবে সরকারের বিরোধিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহ। ফলে দমনের সন্ত্রাসবাদী কাজটা আইনকে ব্যবহার করেই করা হবে।
এগুলোও নতুন কিছু না। সামনে যে ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ তা নিয়ে অনেকেই আতঙ্কিত। কিন্তু আমি আতঙ্কের কোন কারণ দেখি না। কারণ, ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলার জন্য যে আদর্শবাদী ও সুসংগঠিত মিলিট্যান্ট রাজনৈতিক শক্তির দরকার তার কোন শুরুই হয় নাই এখনও পর্যন্ত। পরীক্ষায় না নেমেই পরাজিত হয়ে যাওয়ার কোন মানে নাই। মনে রাখতে হবে, যে কোন বাহিনী। তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন। গণবাহিনীর নৈতিক স্পিরিটের কাছে সব সময়ই পরাজিত হয়েছে।
কাজেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থএ রাজনৈতিক শক্তির সূচনার আগেই যারা হতাশ হয়ে চুপসে যাবে তাদের জন্য ইতিহাসে কোন স্থান নাই। তাদের জন্য স্বাধীনতার মর্যাদা না। দাস্য-নৈতিকতা নিয়ে বেঁচে থাকার গ্লানি তাদের নিয়তি। কিন্তু মানুষ তো কেবল এমন সুবিধা ও অনৈতিকতার বা মিথ্যাকে পূজা দিয়ে বেঁচে থেকে সুখে মরে যাওয়ার মতন জীব নয়। কাজেই হতাশ হওয়ার বদলে এই ফ্যাসিবাদী অবস্থা বাংলাদেশকে প্রকৃত প্রস্তাবে মুক্তির আসল লড়াই শুরু করার দরজায় ঠেলে দিলো। এই লড়াই কিভাবে শুরু হবে তার উপরই বাংলাদেশের মুক্তির প্রশ্নটি নির্ভর করছে।
কাজেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থএ রাজনৈতিক শক্তির সূচনার আগেই যারা হতাশ হয়ে চুপসে যাবে তাদের জন্য ইতিহাসে কোন স্থান নাই। তাদের জন্য স্বাধীনতার মর্যাদা না। দাস্য-নৈতিকতা নিয়ে বেঁচে থাকার গ্লানি তাদের নিয়তি। কিন্তু মানুষ তো কেবল এমন সুবিধা ও অনৈতিকতার বা মিথ্যাকে পূজা দিয়ে বেঁচে থেকে সুখে মরে যাওয়ার মতন জীব নয়। কাজেই হতাশ হওয়ার বদলে এই ফ্যাসিবাদী অবস্থা বাংলাদেশকে প্রকৃত প্রস্তাবে মুক্তির আসল লড়াই শুরু করার দরজায় ঠেলে দিলো। এই লড়াই কিভাবে শুরু হবে তার উপরই বাংলাদেশের মুক্তির প্রশ্নটি নির্ভর করছে।
সব দিকের পরাজিত ও রাজনীতিশূন্য রাজনৈতিকতার আস্ফালনের বাইরে জনগণের মুক্তির প্রশ্নে নতুন রাজনীতি শুরু করেই বাংলাদেশকে বিজয়ী করতে হবে। বাংলাদেশেকে জিততে হলে এই পথ ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। আর এই জন্য প্রথমে দরকার ফ্যাসিবাদের মিথ্যার বয়ানকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা করা। এই দলীয় ইতিহাসের বয়ান থেকে জনগণকে মুক্ত করে নতুন ইতিহাসের জন্য রাজনীতির সামাজিকীকরণ করা।
আরও একটি প্রশ্ন আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। নীতি ও কৌশলের প্রশ্নকে। রাজনীতিতে যে কোন কৌশলকেই জায়েজ বলে মানার যে হীন সংষ্কৃতি রাজনীতিতে চর্চা হয়ে আসছে তাকে চ্যালেঞ্জ করা। নীতিহীন কৌশল পশুত্বের লক্ষন। এটা জানুয়ারির চর্চা। মানুষের চর্চা না। ফলে যারা এইসব অন্যায় ও জুলুমকে কৌশলের বয়ান দিয়ে জায়েজ করতে চায় তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। এই হীন নির্বাচনের পরেও চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, উন্নয়ন এইসব কথা যারা বলবে তাদের সন্ত্রাসী ও গণবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। মোট কথা সামাজিকভাবে যে ক্ষতি এই অবৈধ আমলগুলোতে হয়েছে তাকে পুনঃগঠন না করে নতুন রাজনীতি সম্ভব না।
আরও জরুরি যে কথাটি বলতে হবে। ফ্যাসিবাদ সব সময়ই গণতন্ত্রের কথা বলতে আরাম পায়। এই কলঙ্কিত নির্বাচনের পরেও সরকারি দলের লোকজন গলাফুলায়ে গণতন্ত্রের বিজয় বলে চিৎকার করছে। এইটার সুযোগ আমরাই তৈরি করে দিয়েছি। আমাদের দেশে যে পার্টিজান বা দলদারি গণতন্ত্র চর্চা হয়ে আসছে তার পেট থেকেই ফ্যাসিবাদ পয়দা হয়েছে। তাই এই দলদারি গণতন্ত্রের বয়ানের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের রাজনীতি শুরু করতে হবে। পরিবারতন্ত্র ও দলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভিতর আবদ্ধ থাকার কারণে ফ্যাসিবাদের মনস্তত্বকে গণমানুষের মধ্যে সহজেই জনপ্রিয় উপাদান আকারে জারি রাখা যায়। ফ্যাসিবাদের গণমনন নিয়ে অন্য একটি লেখায় আলোচনার ইচ্ছে রইল।
এই বিষয়গুলো আমলে নিলে আমরা আশা করি সহজেই বুঝতে পারব বাংলাদেশের মুক্তির জন্য এখন কি করতে হবে? কোন ধরণের রাজনীতির সূচনা করতে হবে। রাজনীতিশূন্য ক্ষমতার দৌড়াদৌড়ি। বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে ক্ষমতা পরির্বতনের যে ইন্দুর-বিলাই খেলা এটার অবসান জরুরি। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার রাজনীতির পথ পরিস্কার করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জয়ী হতে পারে। আর এটাই এখন ঐতিহাসিক দায়িত্ব হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। বিপ্লব বিপ্লব মুখে ফেনা তুলে কাজ হয় না বা কলাম লিখে, গলাবাজি করেও এটা হয় না।
গত ১০ বছর ধরেই বলছি, বাংলাদেশের সংকটের চিত্রটা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে বেশি নৈতিক। নৌকার বিপরীতে ধানের শীষ হেরে গেছে বা বিরোধী শক্তি হেরে গেছে ব্যাপারটা মোটেও তা না এখন। হেরে গেছে বাংলাদেশের নাগরিকরা। জনগনতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য আগামীতে কি ভাবে আন্দোলন তৈরি করতে হবে তা নিয়ে বিস্তারিত লিখতে চেষ্টা করব। তবে এখন অন্তত আমাদের মনে রাখতে হবে, ভোট চোরকে ভ্যাট দিয়ে সন্ত্রাসে সহযোগিতা করার কোন মানে হয় না। নো ভোট, নো ভ্যাট। মিডিয়াকে দলীয় প্রপাগান্ডাতে বাধ্য করার জন্য ও অপছন্দের সাংবাদিকদের সাইজ সরার জন্য যে ডিজিটাল কালাকানুন করা হয়েছে তার প্রতিবাদে আমাদের সাংবাদিকরা কি সরকারদলীয় সংবাদ বর্জনের ডাক দিয়েছেন? এই আইন বাতিল না করলে সরকারদলীয় খবর প্রকাশ বন্ধ করে দিন। ভ্যাট আমরা দিবো সরকারকে। কোন দলীয় সন্ত্রাস চালানোর জন্য আমরা ভ্যাট দিতে পারি না। এই দুইটা কাজ শুরু করেন বাকিগুলা সহজ হয়ে যাবে। আর অবশ্যই রাজনৈতিক ভ্যানগার্ড লাগবে। সারা দেশে যে ভাবে সন্ত্রাসের বিস্তার হয়েছে তাকে প্রতিরোধের জন্য নৈতিক ভাবে শক্তিশালি ও রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্ভর জনগনের সমন্বয়ে গঠিত ভ্যানগার্ড দরকার। মাও বলতেছেন,
“A revolution is not a dinner party, or writing an essay, or painting a picture, or doing embroidery; it cannot be so refined, so leisurely and gentle, so temperate, kind, courteous, restrained and magnanimous. A revolution is an insurrection, an act of violence by which one class overthrows another.” [ Mao Tes-Tung; selected work Vol.1,p.28]
কাজেই সন্ত্রাস ও জনগণের শক্তিপ্রয়োগের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে হবে। জনগণের শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সন্ত্রাসকে পরাজিত করতে না পারলে ফ্যাসিবাদ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি হবে না। এটা সম্ভব করাই এখনকার রাজনীতি। আমি জানি আমার মতো আপনারও মনে করেন যে কোন মূল্যে বাংলাদেশকে জিততেই হবে।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৮.