নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমাদের কবি। কয়েকটি প্রজন্মের তরুণদের নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়ে দেওয়ার কবি। কারণ, তিনি অকপটে আমাদের পরিচিত যাপনবাস্তবতার কথা এমনভাবে বলতেন যে আমরা তার শেকড়ের গন্ধেই মাটির দৃঢ়তাকে মুঠোর প্রতীকে ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। বোধ হয় এই কবির স্বভাবপ্রবণতাকে তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত নিজের ভাষ্যে সুচিহ্নিত করে গিয়েছেন। কবিতার ভাষা সম্পর্কে হিকমত লিখেছেন, “কবিতার গদ্যের আর কথা বলার ভাষার পার্থক্য সময়ের কবি স্বীকার করেন না। এমন এক ভাষায় তিনি কবিতা লেখেন যা বানানো নয়, কৃত্রিম নয়, তা সহজ, প্রাণবন্ত, বিচিত্র, গভীর এবং অনাড়ম্বর। সেই ভাষায় উপস্থিত থাকে জীবনের সমস্ত উপাদান। কবি যখন লেখেন আর যখন কথা বলেন তখন তিনি একই ব্যক্তি। কবিরা তো আকাশ থেকে পড়েননি যে তারা মেঘের রাজ্যে পাখা মেলার স্বপ্ন দেখবেন। কবিরা হলেন সামাজিক জীবনে সম্পৃক্ত একজন সংগঠক।” এই নিরিখে নীরেন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করলে বোঝা যাবে তিনি বিগত চার দশক ধরে পাঠক-হৃদয়ের এত কাছাকাছি বিচরণ করেছেন কীভাবে। নিপাট সাদা সত্য কথা হল এই যে, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আবডালের ভাষা ভেঙে যে-ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন তা মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি। তিনি পাঠকের সাথে আসর জমিয়েছেন সরাসরি। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “কবিতার গদ্যই আমার মাতৃভাষা”। কবির এই আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যেই নিহিত আছে সেই হিকমত-প্রার্থিত নির্মাণশৈলী। তার কবিতায় তিনি যেন গদ্যেই কথা বলে যাচ্ছেন, অথচ ভিতরে সক্রিয় রয়েছে এক অবিমিশ্র ছন্দস্পন্দনের মসৃণ মাদকতা। তার কবিতায় যুগপৎ রয়েছে এক অমোঘ মৃদুদোদুল ছন্দ-স্পন্দনের আড়ালে থাকা গদ্যস্বভাব এবং প্রসারিত কথামালার বিনুনীসম্ভারে সঞ্চারিত গদ্যের আড়ালে অনুৎকটিত ছন্দের অনুরণন।
জানি, পৃথিবীর সব কবির কাছে গণমানুষের একই রকম প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়াতে নেই। তবু কথাভাষ্যের অকপট অনায়াসভঙ্গিমার দাবি নিয়ে পাঠকসমাজ বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে নীরেন্দ্রনাথের কাছেই নতজানু হয়েছে তারই ভূমিসংলগ্ন জীবনবাস্তবতা পরখ করার জন্য। কবির তিরিশটি কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতা যেন সময়ের নিরিখে অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতায় সমৃদ্ধ। তার প্রতিটি কবিতার পিছনেই যেন রয়েছে অনায়াস-বিচ্ছুরণের অপ্রতিরোধ্য তাগিদ। প্রাত্যহিক যাপনবাস্তবতার চিত্রনির্মাণে তার বিরল দক্ষতার মূল্যায়ণ হয়তো এখনও যথাযথ হয়নি। আগামী প্রজন্ম উপলব্ধি করবে কেন সময়ান্তরের এই কবি বাংলা কবিতাকে অকারণ ভাবালুতা, অধিবাস্তবতার ধূসরিমা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তিনি কবিতাকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন এমন একটা নিশ্চিত নিরেট জমির উপরে যেখানে বিহ্বল-ভাববিলাসের অনুমোদন নেই। সময়শাসিত কবিকথন কীভাবে দায়বদ্ধতার শর্তটিকে অবিছিন্ন রেখে হৃদয়গত মহার্ঘ্যে শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারে, তা নীরেন্দ্রনাথেই প্রমাণিত। সূচনাপর্বের সেই দিনগুলিতে কবি আঁকলেন এমন এক নিরাভরণ চিত্র তা যেন ‘চল্লিশের দিনগুলি’র (সেই সময়কাল ‘রোরিং ফর্টিশ’ নামে বহুল পরিচিত) কণ্ঠছেঁড়ার আর্তি,
“কী দেখিনি আমি এখানে
সাফল্য, হতাশা, দারিদ্র্য, বৈভব, বোমা, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা-
চল্লিশের সেই
স্বপ্নে আর দুঃস্বপ্নে ভরা দিনগুলিতে
সবই আমি দেখেছি।
দেখেছি, ছাত্রমিছিলের উপর দিয়ে ছুটছে
লালবাজারের মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়া। দেখেছি,
ধর্মতলা স্ট্রিটের ট্রামলাইনের উপরে ছড়িয়ে রয়েছে
চাপ চাপ রক্ত,
কেমিস্ট্রি, প্রাকটিক্যালের খাতা, ভাঙা চশমা আর
ছেঁড়া চপ্পল।”
সমসাময়িক কাব্যপ্রবণতার তথাকথিত ধ্রুপদী ভাষাবিন্যাস ও ক্লাসিক মূর্ছনার কসরত এড়িয়ে নীরেন্দ্রনাথ বাক্যের কথ্যচালে কবিতাকে করে তুললেন কমিউনিকেটিভ। কথ্যচালকে আশ্রয় করে এক ধরনের রিপোর্টাজধর্মী ক্যানভাসকে উন্মুক্ত পরিসরে তুলে ধরলেন তিনি। বহুদিন আগে ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায় নিজের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “কবির কাজ নিজের হৃদয়কে উন্মোচিত করে দেখানো। কিন্তু তার মানে কি তিনি শুধু ব্যক্তিগত কথাই বলবেন?… একইসঙ্গে তাঁর সময় ও তাঁর সমাজের একটা ব্যাখ্যাও কি তিনি শুনিয়ে যাবেন না? যতজনকে শোনাতে পারেন, ততই ভালো। অথচ অনেকজনকে যদি শোনাতে হয়, তবে এমন ভাষাতেই শোনাতে হবে, যা অনেকজনের বোধগম্য। অন্য দিকে কবিতার মহিমাকেও নষ্ট হতে দেওয়া চলবে না। মান্য করে চলে চলতে হবে তার নিজস্ব শর্তকে।” এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে দশকের পর দশক জুড়ে কেন আবৃত্তিকারেরা নীরেন্দ্রনাথের কবিতা নির্বাচন করেন এবং নিজের কণ্ঠে তুলে নেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় কান পাতলেই শোনা যায় আত্মপ্রত্যয়ে স্থির এক বিবেকী-কণ্ঠস্বর। তার কবিতায় লোকচেতনার হৃদয়প্লাবিত বিস্তার দেখা যায়। পরিব্যপ্ত লোকজগতের তিনিই আমাদের কবি-কথক। কবির অতি জনপ্রিয় ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় প্রকৃতান্বয়ে রয়েছে আসলে প্রচলিত একটি লোককথার নিহিত উপাদান। সময় প্রাসঙ্গিকতা ও রাজনৈতিক চেতনায় প্রচলিত লোকাপাদানটি অনন্য লোকাভরণশৈলীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। সঙ্গত কারণেই ‘উলঙ্গ রাজা’ কাব্যগ্রন্থের ব্লার্বে লেখা হয়েছিল: “নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা পড়লেই বোঝা যায়, তিনি এই রুগ্ন সমাজের ব্যাখ্যাতা, এই দুঃস্থ দিবসের ভাষ্যকার। তাঁর কবিতা যেন সন্ধানী আলোর মত, দেশ ও কালের নানা গোপন যন্ত্রণাকে যা নিমেষে উদঘাটিত করে।” আসলে সময়ের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যে কবিতা জন্ম নেয়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হলেন সেই কবিতার জনক। তাই তার ‘প্রস্থান’ নেই। পঁচিশে ডিসেম্বর কবিতার মর্মার্থ উপলব্ধির দিন। জীবন কথকের কাছে কান পাতার জন্য কর্ণকুহরকে ঝালিয়ে নেওয়ার দিন। আমাদের বইয়ের তাকে থরে-থরে সাজানো নীরেন্দ্রনাথের লোকপদাবলির নাগরিক ঐশ্বর্য থেকে গেল স্বমহিমায়। আমরা পড়ব। আগামী প্রজন্ম আড়াল ভাঙার কবিতা পড়েই প্রত্যক্ষতার পাঠ নেবে।