রমাপদ চৌধুরী, আফসার আহমেদ, পৌলোমী সেনগুপ্ত— ২০১৮ সালে কয়েকজন স্বনামধন্য বাংলা সাহিত্যিক পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্বর্গলোকের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন। ২৯ জুলাই অভিন্নহৃদয় বন্ধু রমাপদ চৌধুরী প্রয়াত হওয়ার পর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি স্মৃতিচারণা লিখেছেন। ‘লোকে আমাদের মানিকজোড় বলত’ শীর্ষক সেই স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন, “রমাপদকে বেশিদিন একা থাকতে হবে না। সম্পূর্ণ নির্ভর করে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা কথা রমাপদ বোধ হয় আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলেনি। তাই বললাম, ও খুব শিগগিরই কথা বলার লোক পেয়ে যাবে।” রমাপদ-জায়া সুষমা চৌধুরীকে বলা এই ইঙ্গিতবাহী কথা পাঁচ মাসে সত্য হয়ে যাবে, কে জানত? তবে কি তিনি আন্দাজ করেছিলেন, এই ‘শিগগিরই’ সময়টা খুব দ্রুত অতিক্রান্ত হবে তার জীবনে? ২৫ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার দুপুর ১২:২৫ নাগাদ প্রয়াত হলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। গত কয়েকমাস বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। বৃক্ক-ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে গত ৯ ডিসেম্বর তাকে দক্ষিণ কলকাতার মুকুন্দপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবার হয়েছিল কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এবং মঙ্গলবার হার্ট অ্যাটাক। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পরাজিত হলেন তিনি। মৃত্যুকালে লেখকের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।
অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুর নিকটস্থ চান্দ্রা গ্রামে ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর চলে আসেন কলকাতায়। পড়াশোনা করেন মিত্র ইন্সটিটিউশন, বঙ্গবাসী কলেজ এবং সেন্ট পলস কলেজে। ছেলেবেলা থেকে তিনি সাহিত্য-অনুরাগী ছিলেন। বাংলা ভাষায় বানানবিধি এবং শব্দচয়নে তার মুনশিয়ানা ছিল অতুলনীয়। ছড়া লিখতেন শিশুকাল থেকে। ১৯৫৪ সালে যখন তার বয়স ৩০, প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’। এই কাব্যগ্রন্থে তার স্বকীয় রচনাশৈলী এবং শব্দসুষমা প্রশংসিত হয় বাঙালি পাঠক-দরবারে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘প্রথম নায়ক’, ‘সময় বড় কম’, ‘ঘুমিয়ে পড়ার আগে’ ইত্যাদি। ১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এবিপি গ্রুপের ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা জন্মলগ্ন থেকে সম্পাদনা করেছেন বহু বছর। জনপ্রিয় কমিকস ‘টিনটিন’ আনন্দমেলা পত্রিকায় বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি। উল্লেখযোগ্য শিশুসাহিত্য: ‘পিতৃপুরুষ’, ‘সাদা বাঘ’, ‘বিবির ছড়া’ ইত্যাদি। কবি-পরিচয়ে খ্যাতনামা হলেও সীমিত নন; তিনি একাধারে ছিলেন প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, গদ্যকার, গল্পকার, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক এবং বানান-বিশেষজ্ঞ। তার লেখা কিছু ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়, যা নজর কাড়তে সমর্থ হয়েছিল অগণিত পাঠকের। তার রচিত কবিতা থেকে উদ্ধৃত “রাজা তোর কাপড় কোথায়” এবং “অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল” আজ প্রবাদপ্রতিম।
৯৪ বছরের জীবনে বহু সম্মাননা, পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ১৯৭৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করেন ‘উলঙ্গ রাজা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৭৬ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৯৬ সালে শরৎস্মৃতি পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ২০০২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ‘ডক্টর অফ সায়েন্স’ ডিগ্রি প্রদান করে। ২০১২ সালে বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কারে রাজভবনে সম্মাননা জ্ঞাপন করেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৭ সালে ৪১তম আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলায় বহুবিধ সাহিত্যকীর্তির জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কার প্রদান করেন।। ১৯৯০ সালে তিনি নির্বাচিত ভারতীয় প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্ব কবি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
লেখকের মৃত্যুতে সাহিত্য এবং রাজনৈতিক জগতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি শোক প্রকাশ করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “আমি এক পরম আত্মীয়কে হারালাম!” শোকে মুহ্যমান জয় গোস্বামী, শ্রীজাত, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবির শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। আজ মঙ্গলবার বিকাল ৪:৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬:০০ পর্যন্ত কবির দেহ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য শায়িত থাকবে রবীন্দ্র সদনে। সেখান থেকে বাংলা আকাদেমি ভায়া নিয়ে বাঙুর অ্যাভিনিউয়ে বাসভবনে পৌঁছাবে কবির দেহ। সন্ধ্যা ৭:৩০ নাগাদ শেষকৃত্যের জন্য কবির দেহ নিয়ে যাওয়া হবে নিমতলা শ্মশানে।
লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যক্ষা কবিকন্যা শিউলি সরকার জানিয়েছেন, গত ২৩ জানুয়ারি তার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা গভীর বেদনাহত হয়েছিলেন। মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে বাঙুরে থাকতেন তিনি। শারীরিক দূর্বলতার কারণে নিয়মিত লিখতে না পারলে সাহিত্যপ্রীতি কমেনি আমৃত্যু। ২৪ নভেম্বর তিনি একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছেন। নিজে পড়তে পারতেন না, তাই মেয়েকে দিয়ে রোজ খবরের কাগজ পড়াতেন দেশের হালচাল জানতে। তার মৃত্যুতে শোকাকূল প্রথমা কন্যা সোনালি চক্রবর্তী, জামাতা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কনিষ্ঠা কন্যা শিউলি সরকার, জামাতা অভীরূপ সরকার।
‘কলকাতার যিশু’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন তিনি, যা তুমুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। আশ্চর্য সমাপতন, যিশুর জন্মদিনে প্রয়াত হলেন সেই কবিতার রচয়িতা। কীভাবে তৈরি হয়েছিল ‘কলকাতার যিশু’ লেখার পটভূমি? তিনি ভবিষ্যতে লিখেছেন, “এক বার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে রাস্তার উলটো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু।” বাস্তব নিঙড়ে কবিতা লিখতেন তিনি।
প্রবীণ কবি শঙ্খ ঘোষ এক শোকবার্তায় লিখেছেন, “জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল থেকে গেছেন, এমন একজন স্রষ্টার জীবনাবসান সমস্ত বিচ্ছেদ বোধের মধ্যেও একটা সফলতার স্পর্ধা এনে দেয়। সহজ ভাষার টানটান চেতনার স্পর্ধিত সেই কবি চলে গেলেন আজ। তাকে আমাদের প্রণাম।” নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যজগতের আরও একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র নির্বাপিত হল, একবাক্যে মেনে নিচ্ছে বাংলা সংস্কৃতি মহল।