যুদ্ধ মানেই ধ্বংসযজ্ঞ। বিশ্বযুদ্ধ হলে তো কথাই নেই। পুরো বিশ্ব মেতে ওঠে ধ্বংসের হোলি খেলায়। মানুষের রক্ত নিয়ে যে সময়ে খেলা, সেই সময়ে ফুটবল খেলা নিতান্তই পাগলামি। ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সকল ফুটবল ম্যাচ বাতিল করে দেবে। কিন্তু বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯১৪-১৫ মৌসুমে লিগের খেলাগুলো এফএ স্বাভাবিকভাবেই চালিয়ে যায়। অবশ্য লিগ তাদের অনুষ্ঠান বাতিল করলেও ক্লাবগুলোকে আঞ্চলিক ফুটবল ম্যাচ প্রতিযোগিতার অনুমতি দেয়। ধ্বংসযজ্ঞ চললেও তখন ফুটবলই মানুষকে প্রাণবন্ত করার সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
আস্তে আস্তে ফুটবলই সৈন্যদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে ও মনোবল বাড়াতে দারুণ ভূমিকা পালন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফুটবলকে ঘিরে আছে দারুণ কিছু ঘটনাপ্রবাহ। আজকের আয়োজন উল্লেখযোগ্য এমন নয়টি ঘটনাকে উপজীব্য করে।
১. সামরিক দ্রব্যাদি প্রস্তুতকারী কারখানার নিজস্ব মহিলা ফুটবল দল :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ৯ লাখেরও বেশি মহিলা শ্রমিক সামরিক দ্রব্যাদি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল। নতুন মহিলা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, কল্যাণ ও আচরণবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় প্রতিটি কারখানা একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করত। খেলা, বিশেষ করে ফুটবলের প্রতি তাদেরকে অনেক বেশি উৎসাহিত করা হতো। এমনকি, অনেক কারখানার নিজস্ব মহিলা ফুটবল দল গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে প্রিস্টনের ডিক, কের’স লেডিস এফসি নেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এদের অনুষ্ঠিত ম্যাচগুলোকে প্রচুর র্দশক জমায়েত হতো। ১৯২১ সালে মহিলা লিগ নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা ধারাবাহিকভাবে সাফল্য লাভ করেছিল।
২. সৈন্যদের মনোবল বাড়ানোর টনিক :
বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে পশ্চিমা অংশের সৈন্যদের অবস্থার পরিবর্তন করতে তখন ফুটবলকে বেছে নেওয়া হয়। সেনাদলকে ফিট, কর্মক্ষম ও মনোবল বাড়ানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হতো। এর ফলে সৈন্যদল পুরো উদ্যম নিয়ে আবার রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম হতো।
৩. সেনাবাহিনীতে নিয়োগ :
ফুটবল সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের যে পোস্টার ছাপানো হয়, সেখানে সরাসরি ‘ভালো ক্রীড়াবিদ’কে ইঙ্গিত করা হয়। সেখানে ক্রীড়াবিদদের সৈন্যদলে যোগদানের আহ্ববান জানানো হয়েছিল যারা অন্য ক্রীড়াবিদদের উৎসাহিত করে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করতে সমর্থ হবে।
৪. সেনা-শিবিরে বন্দিদের ফুটবল খেলা :
বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যশিবিরে যেসব বন্দি থাকত ক্যাম্প কতৃপক্ষ তাদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করত। এমনকি কর্মকর্তারাও এখানে অংশগ্রহণ করত তাদের দেহকে ফিট ও সতেজ রাখার জন্য। তবে জায়গার সঙ্কটের কারণে অনেক সময় ম্যাচে বিঘ্ন ঘটতো এবং কারা কতৃপক্ষ ম্যাচ আয়োজন বন্ধ রাখত। তবে বন্দিদের মানসিক অবসাদ কাটাতে ও প্রফুল্ল রাখতে ফুটবল ম্যাচ দারুণ ভূমিকা রেখেছিল।
৫. প্রজ্ঞাপন হিসেবে ফুটবল :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশরা একটি ফুটবল গেমের খেলনা বানায়। আরো বিভিন্ন গেমের মতো এটাও বেশ মজার ছিল। তবে এখানে সম্রাটকে উদ্দেশ্য করে গেমটি বানানো হয়। গেমটির লক্ষ্য ছিল ফুটবলকে বিভিন্ন ধাপ পার করিয়ে সম্রাটের হাঁ করা মুখে প্রবেশ করানো।
৬. রণাঙ্গণে ফুটবল খেলা :
ফুটবলে বেশ শৃঙ্খলিত হয়ে খেলতে হয়। প্রত্যেক দলকে একজন অধিনায়কের আদেশ, উপদেশ, পরামর্শ মেনে নিয়ে মাঠের লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে অধিনায়ক ও দলের সদস্যদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি ও অধিনায়কের নেতৃত্বের গুণ তৈরি হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়া ও দলের সদস্যদের নেতার আদেশ মেনে নিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যদের প্রত্যেকটি ক্যাম্পে ফুটবল খেলা হতো যাতে সৈন্যদের মধ্যে নেতৃত্বের মনোভাব গড়ে ওঠে ও বাকি সৈন্যদের সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
৭. ব্রিটিশ গ্রাউন্ডে ‘নতুন’ খেলা :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফুটবলের পাশাপাশি নতুন খেলার প্রতিও মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়। ব্রিটেনে আগমনকারী আমেরিকান ও আধিপত্য বিস্তারকারী সৈন্যরা ব্রিটিশ নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য বেসবল খেলার আয়োজন করে। অ্যাঙলো-আমেরিকান লিগের প্রথম বেসবল ম্যাচটি উত্তর লন্ডনের আর্সেনালের ফুটবল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।
৮. উভয় সৈন্যদলের ফুটবল ম্যাচ :
বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্রিসমাসের ছুটিতে যুদ্ধবিরতি ছিল। তখন উভয় পক্ষের সৈন্যরা ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করে। ১৯১৪ সালের ২৫-২৬ ডিসেম্বর উভয় দলের সেনারা ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে। প্রীতি ম্যাচে ব্রিটিশ ফুটবল দল জার্মান সৈন্যদের বিপক্ষে জয়লাভ করে।
৯. একঘেয়েমি কাটানোর জন্য কর্মীদের ফুটবল ম্যাচ :
বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশিরভাগ সেবা প্রদানকারী কর্মীই অনেক দিনের অলসতায় একঘেয়েমিতে ভুগছিল। অবসাদ কাটানোর জন্য এডমিরাল জেলিকো নৌ ক্যাম্পে খেলার সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেন যাতে কর্মীরা অবসাদ কাটিয়ে প্রফুল্লতা ফিরে পায়। এমনকি একটি ফুটবল মাঠও তৈরি করা হয় যাতে কর্মীরা অবসাদ কাটিয়ে কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন।