আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ফাইভ-জি’র বিশাল মূলা বনাম বাস্তবতা

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ফাইভ-জি’র বিশাল মূলা বনাম বাস্তবতা

আওয়ামী লীগ বলেছে ক্ষমতায় আসলে তারা ফাইভ-জি সেবা আনবে। ফাইভ-জি রোডম্যাপ ও ইউজ কেইস, ফাইভ-জি স্পেক রেডি কিনা, ফাইভ-জি নেটয়ার্ক টেস্ট, ফাইভ-জি ইউজার ডিভাইস রেডিনেস, স্পেক ভেরিফিকেশন, ইউজ কেইস ভেরিফিকেশন, ফাইভ-জি বিজনেইস কেইস কি কি হবে, কমার্শিয়াল লঞ্চ কোন কোন বিজনেস মডেলে হবে এই আলোচনায় না গিয়ে শুধু উল্লেখ করতে চাই বেসরকারি খাতে নতুন প্রজন্মের সেবায় সরকারে ভুমিকা আসলে কতটুকু!

নতুন প্রজন্মের টেলিকম সেবায় শুরুতে সরকারের ভুমিকা হচ্ছে প্রস্তাবিত ফ্রিকুয়েন্সি স্প্রেকট্রাম (তরঙ্গ) ফাঁকা আছে কিনা সেটা যাচাই করা, নতুন স্পেকট্রামের কিছু অংশ অন্য কোন সামরিক বেসামরিক ব্যবহার করলে সেগুলো রি-অ্যারেঞ্জ করা। বিকল্প স্পেকট্রামের অপশন থাকলে দেশীয় জনসংখ্যার ঘনত্ব ও স্পেকট্রাম নয়েস বিবেচনা করে বেস্ট স্পেকট্রাম বা স্পেকট্রাম গুলো নির্ধারণ করা এবং অকশন দিয়ে সঠিক সময়ে নতুন বা পুরানো কাস্টমার খোঁজা।

টু-জি’র পর টেলিকমে বাংলাদেশ নতুন কাস্টমার খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছে। থ্রি-জি সেবার অকশন দিতে দেশটি প্রায় ১০ বছর দেরি করায় থ্রি-জি সেবায় ইনভেস্টমেন্ট বাংলদেশের টেলিকম অপারেটরদের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে উঠেছে। যেখানে ১ম ২য় ও ৩য় বিশ্বের দেশে দেশে থ্রি-জি সেবা বিগত ২০০৫ থেকেই ক্রমাগত রেভেনিউ জেনারেইট করেছে, সেখানে বাংলদেশে থ্রিজি সেবা ম্যাচিউর হয়েছে ২০১৩-১৪ এর পরে, ঠিক যে সময়ে বিশ্বে ফোরজি শুরু হয়ে গিয়েছিল পুরাদমে। ফলে একটা প্রজন্মের সেবা থেকে রেভেনিউ জেনারেইট হয়নি বরং অসময়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে। বর্তমানে তিনটি প্রধান অপারেটর থ্রি-জি এবং ফোরজি সেবার যৌথ ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে আছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের দেশে দেশের টুজি ও থ্রিজি’র অন্তত একটি প্রজন্ম পুরো পুরি বন্ধ করে দিয়ে স্পেকট্রাম রি-লোকেশন এর কাজ হচ্ছে। সাউথ কোরিয়ায় এলজি ইউ+ ২০১২-১৩ তে টুজি বন্ধ করেছে। ভোডাফোন নেদারল্যান্ডস ডিসেম্বর ২০১৯ এ থ্রি-জি সেবা পুরপুরি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে।

সরকারি টেলিটককে তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়ে রাখা হয়েছে অথচ এই তরঙ্গগুলোর কোন ব্যবহার নাই। টেলিটকের থ্রি-জি ব্যবহারকারী মাত্র ১% এবং তারা এখনও ফোরজি সেবা চালু করতে পারেনি

 

আমরা দেখতে পাচ্ছি তরঙ্গ বরাদ্দে বাংলদেশের সরকার ও রেগুলেটরি কমিটিগুলোর স্পষ্ট ব্যর্থতা আছে :

১. থ্রি-জি তরঙ্গ অন্তত ১০ বছর দেরিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

২. বেসরকারি খাতে সেবার অবকাঠামো তৈরির সুযোগ দিয়ে সেখান থেকে সার্ভিস রেভেনিউ আয়ের দিকে বেশি নজর না দিয়ে সরকারের লক্ষ ছিল তরঙ্গের অকশন থেকে বেশি টাকা তুলে আনা। এটা একটা পশ্চাৎপদ চিন্তা এবং আর্থিকভাবে লোকসানের মডেল। আমরা দেখছি, ক্যাপেক্স বাড়ানোর এই মডেলে বাংলদেশে থ্রিজি ও ফোরজিতে মাত্র তিনটা বেসরকারি নেটওয়ার্ক অপারেটর আছে। অথচ এমন উচ্চ ঘনবসতির মোবাইল মার্কেটে আরো বেশি অপারেটর থাকার কথা ছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এখনও নেটওয়ার্ক শেয়ারিং, এমভিএনও অপারেটর বা শুধু ইনভেস্টমেন্ট নির্ভর ভার্চুয়াল অপারেটর আসেনি সরকারের কৌশলগত ভুল নীতির কারণে। কেননা এখানে তরঙ্গ কেনার খরচ খুব বেশি হওয়ায় নতুন অপারেটর ঝুঁকি নিতে চায় না।

৩. সরকার দলীয় কিংবা আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ থাকা ব্যবসায়ীদের ওয়াই ম্যাক্স দিতে গিয়ে দেশ বিরোধী চুক্তি করেছিল। বাংলা লায়ন ও কিউবিকে সম্পুর্ণ ভিন্ন টেকনোলজির লাইসেন্স দেয়ার সময় ফোরজি’র উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে ফোরজি লঞ্চকে ইচ্ছা করে ২ বছরের বেশি সময় আইনি ঝামেলায় ফেলে রাখা হয়েছে।

৪. প্রায় সরকারি টেলিটককে তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়ে রাখা হয়েছে অথচ এই তরঙ্গগুলোর কোন ব্যবহার নাই। টেলিটকের থ্রি-জি ব্যবহারকারী মাত্র ১% এবং তারা এখনও ফোরজি সেবা চালু করতে পারেনি।

অর্থাৎ স্পেকট্রাম বা তরঙ্গ ব্যবহারের ইনডেক্সে বাংলদেশের টেলিকম থেকে বেশি রেভিনিউ আসছে না, অন্তত থ্রিজি ও ফোরজি থেকে। এখানে সরকারী নীতি ও কারিগরি ব্যবস্থাপণা ব্যর্থতা দৃষ্টিকটু। সাধারণ নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীরা সাধারণ কারিগরি জ্ঞানে পিছিয়ে বলে এই আলোচনা সমাজে নাই।

৫. এটা বুঝা গুরুত্বপুর্ণ যে, যেহেতু একটি নতুন প্রজন্ম দোরগোড়ায় তাই আগামী ২-৩ বছরের মধ্যেই একই সাথে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের সেবার উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয় এবং খরুচেও বটে। তাই এখানে সরকারের একটা নতুন তরঙ্গ রি-লোকেশান পরিকল্পনা দরকার যাতে নিচের দিকে তরঙ্গগুলো ফোরজি, ফোরজি অ্যাডভান্স এবং সামনের দিনে ফাইভজি’র জন্য উন্মুক্ত হয়।

যখন বেসরকারি অপারেটরগুলো ফাইভজি’র সেবার বিজনেইস কেইস (মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন ড্রিভেন) দেখতে পাবে তখন তারা ফাইভজি সেবা নিজেরাই নিয়ে আসবে, এখানে সরকারের কৃতিত্বের কিছু নেই। সরকারের যা দরকার সেটা হল নতুন টেকনোলজি যা দ্রুত আসতে পারে তার জন্য নতুন স্পেকট্রাম নীতিমালা তৈরি করা, নিচের দিকের তরঙ্গগুলো যেহেতু ইকোসিস্টেম এবং পরিবেশের জন্য কিছুটা ভালো তাই নিচের দিকের তরঙ্গ ফাঁকা করার ইনিশিয়েটিভ নেয়া। আমরা উল্লেখ করতে পারি শুধু এক্সপার্টের অভাবে থ্রিজি তরঙ্গ অকশন দেরি হয়েছিল এবং স্থির করা দিনক্ষণও পিছাতে হয়েছিল। গ্রামীণ ফোনের তরঙ্গ এক্সপার্ট গিয়ে বিটিয়ারসি’কে সে যাত্রায় উদ্ধার করে। বাংলাদেশের সরকার ও রেগুলেটরি কমিটি গুলোর কারিগরি জ্ঞানের অভাবে সেবাটি প্রায় ১০ বছরে পরে বাংলদেশে এসেছে, এটা বড়ই লজ্জার।

নির্বাচনী মূলা না ঝুলিয়ে কাজের কাজ চাই। জন ঘনত্ব এবং পরিবেশ বিবেচনায় ঠিক কোন তরঙ্গ বা তরঙ্গ গুলো বাংলদেশের পারস্পেক্টে ভাল হবে সেই প্রস্তুতি নিন যাতে সঠিক সময়ে অকশন কল করতে পারেন। বাকি কাজ বেসরকারি খাত এগিয়ে নিবে। সেখানে আপনাদের কোন ভুমিকা নাই। এটা কারগরি আলোচনা ও কারগরি সক্ষমতা আনার বিষয়, নির্বাচনী মূলা ঝুলানোর নয়।

 

এখানে নির্বাচনী মূলা না ঝুলিয়ে কাজের কাজ চাই। জন ঘনত্ব এবং পরিবেশ বিবেচনায় ঠিক কোন তরঙ্গ বা তরঙ্গ গুলো বাংলদেশের পারস্পেক্টে ভাল হবে সেই প্রস্তুতি নিন যাতে সঠিক সময়ে অকশন কল করতে পারেন। বাকি কাজ বেসরকারি খাত এগিয়ে নিবে। সেখানে আপনাদের কোন ভুমিকা নাই। এটা কারগরি আলোচনা ও কারগরি সক্ষমতা আনার বিষয়, নির্বাচনী মূলা ঝুলানোর নয়।

ফাইভজি শুধু ভয়েস ও ডেটা’র নেটয়ার্ক নয়, ভয়েস ও ডেটার জন্য চতুর্থ প্রজন্মের এল্টিই এবং এল্টিই এডভান্সড যথেষ্ট। এল্টিই এডভান্সড দিয়ে ইউজার লেভেলেই গিগাবিটের কানেক্টেড সোসাইটি তৈরির রোডম্যাপ করছে বিশ্বের বড় বড় নেটয়ার্ক অপারেটর গুলো। ইতিমধ্যেই ১জি স্পীড টেস্টেড, ২জি স্পীড ল্যাবে পরিক্ষিত।

ফাইভজি ভিন্ন স্তরের টেলিকম, মূলত ইন্ডাস্ট্রি ফোকাসড! এখানে ড্রাইভার লেইস ভেহিকল, রিমোট সার্জারি, ম্যাসিভ কানেক্টিভিটি, ম্যাসিভ রিমোট অটোমেশন, মিশন ক্রিটিক্যাল রিমোট এক্টিভিটি, লার্জ স্কেইল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিমোট অপারেশন, এডভান্সড রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম, স্মার্ট সিটি ম্যানেজমেন্ট, পোর্ট মেনেজমেন্ট, ভেহিকল মেনেজমেন্ট, ভেহিকল পুলিং, ইউটলিটি ম্যানেজমেন্ট, স্মার্ট এডুকেশন, স্মার্ট এগ্রিকালচার, ম্যাসিভ ডিভাইস কানেক্টিভিটি ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে প্রায় সব ছোট বড় শিল্প খাতে বিপ্লব আনা হবে যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং রোবোটিক অপারেশন ফাইভ-জির সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে ‘অটোমেশন’ ড্রিভেন আরেকটি শিল্প বিপ্লব ঘটাবে।

এই বিপ্লবে গতানুগতিক কর্মসংস্থান গতি হারাবে এবং নতুন নতুন কারগরি খাতে কর্মসংস্থান বাড়বে। নতুন সরকারের উচিৎ হবে সেই সব খাত গুলো আইডেন্টিফাই করে সেভাবে শিক্ষা, শিল্প ও রেগুলেটরি প্রস্তুতি নেয়া। নির্বাচনী ফানুস উড়ানো এখানে অনভিপ্রেত!