ধরুন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের পরপর দুইটি ম্যাচ। একটি ওয়ানডে অন্যটি টি টোয়েন্টি। অপরিবর্তিত খেলোয়াড় নিয়ে খেললেও আপনি দুই ম্যাচের পারফর্ম্যান্সকে মেলাতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন। ওয়ানডে ফরম্যাটে যে প্রতিশ্রুতিশীল ও আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ দল, টি টোয়েন্টি ফরম্যাটে ঠিক তার উল্টো। প্রতিপক্ষের কাছে কোনো প্রতিরোধ না করেও গুঁড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সোনালি সময়টা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে মাশরাফির বিন মুর্তজার হাত ধরে। দেশের মাটিতে বলতে গেলে এখন আমরা পরাশক্তি। ক্রিকেটের মোড়লরাও এদেশে এসে ধরাশায়ী হয়েছে। সিরিজ জয়েও আমাদের ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। মাত্রই দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ও ওয়ানডেতে এসেছে আমাদের দারুণ সাফল্য। কিন্তু টি- টোয়েন্টি ফরম্যাটে আবারও ব্যর্থ টাইগাররা। উইন্ডিজদের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি টোয়েন্টিতে ম্যাচে ঝলক দেখালেও শেষ পর্যন্ত সিরিজ হারতে হয় সাকিবদের। টি- টোয়েন্টিতে কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ?
২০০৬ সালে প্রথম টি- টোয়েন্টি ফরম্যাটে আন্তর্জাতিকভাবে খেলা শুরু করে বাংলাদেশ। প্রথম দুই ম্যাচে যথাক্রমে জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে জয়লাভ করে আশার আলো দেখায়। কিন্তু এরপরের ম্যাচগুলোতে ধারাবাহিক ব্যর্থতায় আশার আলো যে নিভু নিভু করে যাচ্ছিল, তা এখনো চলমান। মাঝখানে ওয়ানডেতে বাংলাদেশ দারুণ উন্নতি করলেও টি- টোয়েন্টি ফরম্যাট যেন অবহেলা-অযত্মে পড়ে আছে। ২০১৪ সালে আইসিসি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবি টিম ম্যানেজমেন্টকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিসিবির এক জরুরি সভায় টিম ম্যানেজমেন্ট বা দলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের উপর অনাস্থা প্রকাশ করে বোর্ডের সদস্যরা। আফগানিস্তান ও নেপালের সাথে জিতে বাংলাদেশ দলের মূল পর্ব বা সুপার-টেন খেলা নিশ্চিত হলেও পতনের শুরু হয় গ্রুপ পর্ব থেকেই। ওই পর্বের শেষ ম্যাচে নবাগত হংকংয়ের কাছে টেস্ট খেলুড়ে বাংলাদেশকে পরাজয় লজ্জার সাথেই মেনে নিতে হয়েছে। এমনকি পরাজয়ের ব্যবধান এতটাই বেশি ছিল যে এক পর্যায়ে নেট রান রেটের শর্তের বেড়াজালে পড়ে বাংলাদেশের সুপার টেনে ওঠা নিয়েও আশংকা তৈরি হয়। এরপর আর একটা জয়ও আসেনি বাংলাদেশের। এমনকি কোনো ম্যাচে জয়ের আশা সঞ্চারেও ব্যর্থ হয়েছে স্বাগতিকেরা। যেখানে একদিনের আন্তর্জাতিকের বিশ্বকাপেও বড় বড় দলকে হারানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশ দলের সেখানে টি টোয়েন্টির বিশ্ব আসরে ঘরের মাঠে দলের ছিল এমনই দুরাবস্থা। টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার আগেই দলের দুরাবস্থা নিয়ে হিসেব কষতে বসতে হয়েছিল বোর্ডকে।
প্রথম টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয় ২০০৭ সালে। সেবার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এরপর আর টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বা কোনো সিরিজে বাংলাদেশ তেমন ভালো করতে পারেনি। বাংলাদেশ ২০০৯, ২০১০ ও ২০১২ সালের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে আয়ারল্যান্ডসহ সবগুলো ম্যাচে হেরেছিল। ২০১৪ সালে ঘরের মাটিতে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির বাছাইপর্বে হংকংয়ের বিপক্ষে ২ উইকেটে হারে বাংলাদেশ। এরপর মূলপর্বেও সবগুলো ম্যাচেই হারের মুখ দেখে বাংলাদেশের টি টোয়েন্টি দল। ২০১৬ সালের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতেও ভারতের বিপক্ষে জয়ের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হেরে যায় বাংলাদেশ। বাছাইপর্বে পর বড় দলগুলোর বিপক্ষে জয় পায়নি বাংলাদেশ। সেই টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওমানের বিপক্ষে জয়ের পর টানা ৮ ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে টি টোয়েন্টি সিরিজে এক ম্যাচে জয়ের পর আবারো টানা চার ম্যাচে হেরেছে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ৫৭ টি ম্যাচে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের জয় এসেছে ২৬ ম্যাচে, পরাজয় ২৯ ম্যাচে ও বাতিল হয়েছে ২ ম্যাচ।
বাংলাদেশের কি কোনো নির্দিষ্ট টি টোয়েন্টি স্কোয়াড আদৌ আছে? টি টোয়েন্টি ২০০৬-০৭ সাল থেকে শুরু করা হলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে টি টোয়েন্টি এসেছে মূলত ২০০৯ বা ২০১০ সাল থেকে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটারদের জন্য দারুণ মাধ্যম কিন্তু এটা মূলত ফ্র্যাঞ্চাইজি-ভিত্তিক। এখানে অধিকাংশই বিদেশি খেলোয়াড়দের দাপট থাকে। আগে একাদশে চারজন বিদেশি খেলাতে পারত। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো পাঁচজন বিদেশি ক্রিকেটার খেলানোর অনুমতি পেয়েছে। ফলে দেশি ক্রিকেটারদের সুযোগ আরো কমে গেছে। বাংলাদেশের টি টোয়েন্টি দলটা মূলত ওয়ানডে ও টেস্ট স্কোয়াডের সংমিশ্রণ। যারা ওয়ানডে খেলছে, তারাই টেস্ট খেলছে, আবার তারাই টি টোয়েন্টি খেলছে। কিন্তু অন্যান্য দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকায় তিন ফরম্যাটের খেলোয়াড়দের মধ্যে তারতম্য থাকে। নির্বাচকরা যে ব্যাপারটা ভাবেন না, এমনটা নয়। গত শ্রীলংকার বিপক্ষে সিরিজে সাব্বির রহমানকে দলে নেয়া হয় টি টোয়েন্টির কথা মাথায় রেখেই।
টি- টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের ভালো করতে হলে খেলোয়াড় বেশি বেশি তুলে আনতে হবে। তিন ফরম্যাটের জন্য আলাদাভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরোয়া লিগ খুব দরকার। খেলোয়াড়রা কে কোন ফরম্যাটে ভালো সহজেই বোঝা যাবে। যার ফলে দল গঠনেও সুবিধা হবে। টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে শুধু ব্যাটিংটা জানলেই হবে না, কখনো ভালো বলে ঝুঁকি নিয়ে মারতে হয়। সেক্ষেত্রে কব্জির জোর ও বলের সাথে চোখের যোগাযোগটা জরুরি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আত্মবিশ্বাস রাখা। এখানে বাংলাদেশের ঘাটতি চোখে পড়ার মতো। আত্মবিশ্বাসের অভাবে ব্যাটসম্যানরা দলকে ভালো সংগ্রহের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে না। এমনকি উইকেট পড়তে থাকলে বাকি ব্যাটসম্যানদের চাপ নেওয়াটাও অনেক ক্ষেত্রে দূরূহ হয়ে যায়। ওয়ানডে ফরম্যাটে যেমন থিতু হওয়ার জন্য সময় পাওয়া যায়, টি টোয়েন্টিতে কম ওভার হওয়ার কারণে ব্যাটসম্যানরা সময় কম পায়। বাংলাদেশ এমন ক্রান্তিলগ্ন উতরানোয় এখনো পরিপক্ক হতে পারেনি। টাইগারদের আরেকটি বড় সমস্যা, এরা আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে খেলতে থাকে। যার ফলে অহেতুক ছেড়ে দেওয়া শট খেলতে গিয়ে বাজেভাবে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে দলের পরাজয় ত্বরান্বিত করে। তাছাড়া, বাংলাদেশ তুলনামূলক অনেক কম ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়। ফলে নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়া ও ভুল-ত্রুটি শুধরে নেওয়ার সুযোগ অন্যদের তুলনায় কম। টাইগারদের টি টোয়েন্টিতে বাজে পারফর্ম্যান্সের আরেকটি অন্যতম কারণ বোলারদের ব্যর্থতা। বোলাররা দু’হাত ভরে দিয়ে দেন প্রচুর রান। যার ফলে ব্যাটসম্যানদের পরাজয়ের ব্যবধান কমানো ছাড়া করার থাকে না কিছুই।
তবে আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের আসর। এই আসরকে কেন্দ্র করে দেশের ক্রিকেটাররা তাদের প্রতিভা আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে। আগের আসরগুলোর তুলনায় আস্তে আস্তে অনেকটাই গোছানো আয়োজন হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হচ্ছে যথেষ্ট। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ভালো দল হয়ে ওঠার জন্য এর বিকল্প নেই। ভবিষ্যতের টি-টোয়েন্টির বিশেষজ্ঞ তৈরিরও কারখানা বলা যায় বিপিএলকে। সে লক্ষ্যে এখন থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো দরকার। বিসিবিকেও বিপিএলের প্রতি আরো মনোযোগী হতে হবে। এখন পর্যন্ত বিপিএল থেকে তেমন কেউ ঝলক দেখাতে পারেনি মেহেদি মিরাজ ছাড়া। তবে প্রত্যেকটি আসরেই আশার আলো হয়ে কেউ কেউ জ্বলে ওঠেন। কিন্তু আলোর দ্যুতি ছড়ানোর আগেই নিভে যান। টি টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের দুরাবস্থা কাটানোর জন্য এদেরকে ধরে রাখার কাজটা সিদ্ধহস্তে বিসিবিকেই করতে হবে।