ক্রিকেট কেন যে কোনো খেলারই সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় এর অনুনেয়মতা। অনেক সময় যখন মনে হয় যে ম্যাচে চিত্রনাট্য লেখা শেষ ঠিক সে সময়ই ক্লাইমেক্স যেন পুরো চিত্রটাই বদলে দেয়। বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার শেষ টি টিয়োন্টি ম্যাচেই যেমন আলোচনা করার বহু অনুষঙ্গ ছিল। সব ছাপিয়ে আলোটা নিজের করে নিয়েছেন তানভীর আহমেদ। তাতে তিনি গর্বিত হয়েছেন কি না জানা নেই তবে বাংলাদেশকে তিনি উপহার দিয়েছেন লজ্জা, কলঙ্ক এবং চরম বিব্রতকর মুহুর্ত।
বছরে নিজেদের শেষ টি টোয়েন্টি, সেটিও সিরিজ নির্ধারনী। এমন অবস্থায় অবধারিতভাবেই আলোচনার কেন্দ্রে থাকার কথা ছিল ক্রিকেটিয় বিষয়গুলো। প্রথম পাওয়ার প্লেতে প্রায় নব্বইয়ের মত রান দেয়া, সেখান থেকে দুর্দান্তভাবে ম্যাচে ফেরা, মাহমুদুল্লাহর গোল্ডেন আর্ম কিংবা লিটনের ঝড়ো শুরু; বিষদ আলোচনা করা যেত এসব নিয়ে। কিন্তু তার সুযোগ হলো না। আমি শুধু কালকের ম্যাচই না, এই সিরিজ এবং তারও পিছনে গিয়ে দেখতে চাই যে তানভীরিয় কর্মের হালত।
কালকের ম্যাচের নো বল দু’টি আপাতত একপাশে সরিয়ে রাখি। তার আগের ম্যাচেই বাংলাদেশের দুই আম্পায়ার মিলে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন চারটি। এর একটিকেও মানবিক ভুল বলার সুযোগ নেই। কেননা, একটির চেয়ে আরেকটি সিদ্ধান্ত ছিল জঘন্য। সাকিব ব্যাটিংয়ের সময় আম্পায়ার ওয়াইড কল করার পর রিপ্লেতে দেখা যায় সেটি ব্যাট ছুয়ে কিপারের গ্লাভসে গিয়েছিল। উইন্ডিজ আপিল না করায় সেটি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। কিন্তু ব্যাটিংয়ের সময় উইন্ডিজের বিপক্ষে যে দুটি এলবিডব্লু তারা দিয়েছেন আশ্চর্যভাবে এর একটি ব্যাট ছুয়ে প্যাডে লেগেছে; অপরটি প্যাডেই লাগেনি! দুবারই রিভিও এর কল্যাণে রক্ষা পান ব্যাটসম্যান। তার আগে লেগ সাইডে ছয়জন ফিল্ডার রেখে বোলিং করার পরেও নো ডাকার কথা মাথায় আসেনি তাদের!
কালকের চিত্র তো সবারই জানা। এমন আম্পায়ারিং কি অস্বাভাবিক? আমার কাছে কিন্তু মনে হয় নি। কারণ, যে ঘরোয়া লিগে তারা পরীক্ষা দিয়ে আসেন তার হালত আমাদের জানা। নির্দিষ্ট দলের পক্ষে না বিপক্ষে সিদ্ধান্ত যাবে, তা আগে থেকেই মনঃস্থির করে আম্পায়রদের মাঠে নামার অভিযোগ বহুদিনের। বিশেষ করে, বিসিবির প্রভাশালী কর্তারা যে সকল দলের সাথে সরাসরি যুক্ত তার পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়া চাপ নিয়েই তারা মাঠে নামেন। প্রিমিয়ার ডিভিশনেই এটা হয় এবং এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। তা যে কেউ গা করেনি সেটা তো স্পষ্টই।
তৃতীয় বিভাগের হালত কতটা খারাপ সেটি নিয়ে দেশের এক প্রধান দৈনিক তো বিশদ রিপোর্টই করেছে। সেখান থেকে পাওয়া একটি তথ্য তুলে ধরলেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করা যাবে। যে দলটিকে হারতে হবে তার কোনো এক খেলোয়াড় ভালো ব্যাটিং করলে খোদ আম্পায়রই তাদের সালাহ দেয় মাঠ ছাড়ার! এমন যখন অবস্থা তখন অভ্যাশবসত তানভীর লিটনকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন এটাই তো স্বাভাবিক! উইন্ডিজ প্রকাশ্যে দাবি করেছে ৫০-৫০ প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষে গিয়েছে। সাথে অবশ্য তারা এও বলেছে যে, তারা কোনো প্রতারণার অভিযোগ আনছে না। সেটা ক্রিকেটিয় ভদ্রতা হিসাবে তারা বলতে পারেন। কিন্তু যাদের বিপক্ষে এই অভিযোগ তারা তো নিয়তই প্রহসনমূলক ম্যাচ পরিচালনা করে থাকেন।
সবচেয়ে বিব্রতকর যে বিষয়টি তা হলো, আমরা বরাবরই আম্পায়ারের অন্যায় সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছি। ’১৫ বিশ্বকাপ কিংবা চলতি বছরের নিদাহাস ট্রফির কথা তো ভোলার সুযোগ নেই। সেই আমাদের বিপক্ষেই এবার এমন অভিযোগ! এমন জঘন্য আম্পারিং এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একবার নো ডাকলেও কথা ছিল, একই ওভারে এর আগেই একটি বৈধ ডেলিভারিকে নো ডেকেছেন তানভীর। সিরিজ নির্ধারনী একটি ম্যাচে, যেখানে প্রতিপক্ষ দারুণ শুরু করেছে তখন এমন সিদ্ধান্ত যে কাউকেই তাতিয়ে তুলবে।
ক্রমাগত স্বেচ্ছাচার, অনিয়ম এর ফলাফল কি হতে পারে তার স্পষ্ট একটি নমুনা আমরা কালকে দেখলাম। ধরুন তানভীরকে সড়িয়ে অন্য কাউকে আনলেন পরের ম্যাচে, তাতে অবস্থা বদলাবে? হ্যাঁ, এমন জঘন্য হয়তো হবে না কিন্তু খুব ভালো কিছুও হবে না। কারণ, যারা আছেন সবাই একই মানের; একই চক্রের মধ্যে আটকা। উন্নতি যে করবেন তার অন্তরায় তো খোদ বোর্ড নিজে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে টেস্ট বাদে ওয়ান ডে এবং টি টোয়েন্টিতে দেশের আম্পায়াররা থাকেন। সামনে যে এমন পরিস্থিতি আবার হবে না, সেটি যদি ঘরোয়া লিগের চিত্র না বদলায় তাহলে বলা যাবে না। মানুষ অভ্যাসের দাস, যেটি সব সময় করে এসেছেন আচমকা আন্তর্জাতিক ম্যাচে তা থেকে তারা বেরিয়ে আন্তর্জাতিক মানের হয়ে যাবেন এইটা ইয়াকিন করাও অসম্ভব।
এখানে অনেকে বলছেন যে লিটন ওয়াক করতে পারত। আমি ঠিক নিশ্চিত নই সেটি করার সুযোগ তার ছিল কি না। বৈধ ডেলিভারি হলে ব্যাটসম্যান সেটা করতে পারেন। এখন নো বল বহাল থাকাবস্থায় লিটন যদি ওয়াক করতেন তাহলে তাকে ঠিক কি আউট দেয়া হত? এমন পরিস্থিতিই তো এর আগে দেখা যায়নি। সুতরাং লিটন ওয়াক করলে পরিস্থিতি আরো জটিল হত। এইটা বলে আমি অবস্থানটাকে সমর্থন করছি তাও না; আসলে এই পরিস্থিতিতে কোনটি ঠিক হতো ব্যাখ্যা করা দুষ্কর।
বাংলাদেশ যে দারুণ শুরু পরে খড়কূটার মত উড়ে গেল তার মূল কারণ ঐ সিদ্ধান্ত। এটিকে ক্রিকেটিয় ভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ আমি দেখছি না। কারণ, তানভীরের সিদ্ধান্তটি পুরো মোমেন্টামই বদলে দিয়েছে। উড়তে থাকা লিটন এর পরেই আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। যেভাবে জীবন পেয়েছিলেন তার চেয়ে ফিরে যাওয়াই বোধ করি বেহতার ঠেকছিল তার কাছে। এর প্রভাব পুরো দলেই পড়েছে। অপরদিকে উইন্ডিজকে বিষয়টি করেছে উজ্জীবিত। আমরা সব সময়ই বলি, ক্রিকেট ৪০% স্কিল আর ৬০% সাইকোলোজিকাল গেম। শর্ট বলে দুর্বলতার কথা এখানে আমি মানছি না, লিটন নিজেই শর্ট বল দুর্দান্ত খেলছিলেন। সৌম্য এক ওভার অস্বস্তিতে ভুগলেও শর্ট বলে দারুণ এক ছয় মেরেছেন। যেটি হয়েছে; তানভীরের সিদ্ধান্ত খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে ম্যাচ থেকে নাই করে দিয়েছিল; ফলাফল ব্যাটিংয়ের চূড়ান্ত বিপর্যয়।
অন্য সব বিষয়ের মত এ বিষয়টিও যদি কিছুদিন হৈচৈ এর পর আড়ালে চলে যায় তাহলে সেটি হবে আশঙ্কার। এখানে আমাদের ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িত। এমন চলতে থাকলে যেটি চরম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। আর ঘরোয়া ক্রিকেটে যদি ক্রিকেটের বদলে সেট করা ম্যাচ হতে থাকে তাহলে এটি ঘটতেই থাকবে। এখন, বিষয়টা হচ্ছে অনুধাবনের। কর্তারা কি ক্লাবের স্বার্থে পুরো জাতিকেই লজ্জা উপহার দিবেন কি না সেটির। যদি, এই ম্যাচ তাদের মধ্যে কোনো পতিক্রিয়ার জন্ম না দেয় এমন দৃশ্য আরো বহুবার দেখা যাবে। হয়তো তা তানভীরের বদলে অন্য কেউ জন্ম দিবেন।
এখানে আরেকটি বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনায় আসবে। ব্রেথওয়েট যেটা করেছেন সেটি ঠিক কি না? হয়ত ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা বলে অনেকে বলবেন অন্যভাবেও এর প্রতিবাদ করা যেত। সে অন্যভাবের ব্যাখ্যা বোধহয় কারো কাছেই নেই। আমি আমার জায়গা থেকে এটিকে সমর্থন করছি, যেমন করেছিলাম নিদাহাসে সাকিবের সময়ও। হ্যাঁ, দুজনের কেউই ক্রিকেটিয় আচরণ করেননি; কিন্তু আম্পায়াররা যদি এমন প্রহসন করেন তাহলে প্রতিবাদ না করাটাও কেমন যেন। দিন শেষে খেলোয়াড়রা মানুষ, তাদেরও আবেগ রয়েছে। সাকিবকে নিদাহাসে সমর্থন করার পরে ব্রাথওয়েটকে ক্রিকেটিয় আচরণ বিষয়ে জ্ঞান নসিহত করা হবে দ্বিমুখীতা। যা আমার ধাতে নেই।
আমরা খেলেই জিততে জানি। কালকেও যেভাবে এগুচ্ছিল সব তাতে লিটনের আউটের পরেও আমরা ম্যাচ থেকে ছিটকে যেতাম না। বরং, যেনতন উপায়ে ক্লাবগুলোকে ম্যাচ জিতিয়ে অভ্যস্ত আম্পায়ারদের একজনের কারণে সকলের মাথা হেট হলো। কেউ কি নেই বিসিবিতে যিনি এর প্রতিবাদ করবেন?