আমরা মনে করি শুধু নারীর অনুমতি ছাড়া তার শরীরে হাত দিলে বা অশোভন ভাষা প্রয়োগ করলেই নারীর প্রতি যৌন হেনস্থা করা হয়। আসলে নিজের শরীর জন সম্মুখে আমরা কিভাবে উপস্থাপন করছি তার উপরও যৌন হয়রানির বিষয়টি নির্ভর করে। অনেক সময় নিজের অঙ্গের অশোভন উপস্থাপন নারীর জন্য তীব্র অস্বস্তির কারণ হয়। প্রত্যেক পুরুষের উচিত এই বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখা। হালে হ্যাশ ট্যাগ মিটু আন্দোলন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা শুনতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ এটাকে অপছন্দের পুরুষকে ফাঁদে ফেলতেও ব্যবহার করছেন। আবার কেউ কেউ সমাজে নারীর সম্মানের দিকটি প্রাধান্য দিয়ে সাহস করে নিজেদের ঘটনাগুলো সাহসের সাথে তুলে ধরছেন। এ সবের বাইরে নিজের আচরণ ঠিক করতে পারলে এই ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এই সময়ের প্রেক্ষিতে দরকারি এই লেখাটা লিখেছেন, পাকিস্তানের খ্যাতিমান লেখিকা রাফিয়া জাকারিয়া। ডন থেকে জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন উম্মে সালমা।
আজকের দিনে প্রতিটি (পাকিস্তানি) নারীর সাথে এমনটি ঘটে চলেছে। আপনি বিমানে বা ট্রেনে আরোহণ করলেন অথবা বাসে চড়েন অথবা আপনি একটি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমান বা একটি রেস্টুরেন্টে বসলেন। তখন একজন পুরুষ আপনার পাশে অথবা আপনার সম্মুখে আসন গ্রহণ করলেন। দেখা গেল, সেই পুরুষ মানুষটি খুব শীঘ্রই ঐ জায়গার উপর নিজের আধিপত্য জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এমনকি ঐ ব্যক্তিটি চান আপনি সজাগ হোন এই ব্যাপারে যে তিনি একজন পুরুষ মানুষ আর আপনি একজন নারী এবং এই জনসাধারণের স্থানগুলো প্রথম এবং সর্বাগ্রে পুরুষেরই আয়ত্তাধীনে থাকে।
হয়তো বা পুরুষটি আপনাকে লক্ষ্য করেছে, তারপরেও আপনার উপস্থিতি তার কাছে বিস্মৃত। এরকম পরিস্থিতিতে কিছু কিছু ব্যাপার ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যতটুকু পারে সে জায়গা দখল করে বসে; এরপর সিটের পিছনে তার বাহুদ্বয় এমন ভাবে ছড়িয়ে রাখে যাতে এগুলোও সর্বোচ্চ জায়গা দখল করতে পারে। এরপরই দেখা যায়, সে অন্যমনস্কভাবে তার সালোয়ার বা ট্রাউজার পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
যাই হোক, একটি দেশে এসব আচরণ পুরুষত্বের নির্ভেজাল অহংবোধ এবং গ্রহণযোগ্য আচরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
গত সপ্তাহান্তে, এরকমই কিছু ঘটেছিল একজন নারী অধিকার কর্মীর সাথে, যিনি মাত্রই তখন বিমানে আরোহণ করেন। পায়জামা পাঞ্জাবি পরিহিত একজন পুরুষ এসে ঠিক তার পাশে আসন গ্রহণ করলো। যখনই সবাইকে সিটবেল্ট বাঁধতে বলা হলো, সেই ব্যক্তিটি বিনা বিবেচনায় নিম্নস্তরের অমানুষসুলভ আচরণগুলো আরম্ভ করলো। কোন রকম লজ্জিত অথবা ক্ষমা প্রার্থনা করা ছাড়াই সে এ ধরনের একটা কাজ করে বসলো। এমন কি তার পাশে বসা ভদ্রমহিলাটির অস্বস্তিবোধ হচ্ছে কি না সেই বিবেচনাবোধটাও পুরুষটির নেই। তারপর সে বারংবার একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকলো।
পাঁচ মিনিটের মতো সময়ের মধ্যে লোকটি তার নিজের গোপন অঙ্গে একবার বা দুইবার না আক্ষরিক অর্থে পনেরো বার স্পর্শ করেছিল। এ সবই ঘটেছিল ছোট একটা পরিসরে এবং এরকম একটা পরিস্থিতি ছিলো যেখান থেকে মহিলার স্থান ত্যাগ করাও সম্ভব ছিল না।
আমরা এ ঘটনাটি জানি কেননা ভদ্রমহিলাটি তার ফোনে যা যা ঘটেছিল সবই ধারণ করেছিলেন। ভিডিওটিতে দেখা যায়, পাঁচ মিনিটের মতো সময়ের মধ্যে লোকটি তার নিজের গোপন অঙ্গে একবার বা দুইবার না আক্ষরিক অর্থে পনেরো বার স্পর্শ করেছিল। এ সবই ঘটেছিল ছোট একটা পরিসরে এবং এরকম একটা পরিস্থিতি ছিলো যেখান থেকে মহিলার স্থান ত্যাগ করাও সম্ভব ছিল না। বিমানটি অবতরণের সময় এফআইএ’র কর্মকর্তাবৃন্দ সেই ব্যক্তিটির সাথে দেখা করেন। একজন কর্মকর্তা খুব স্বাভাবিকভাবেই মহিলাটির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “সে তো আপনাকে স্পর্শ করে নি, করেছিলো কি?” এটি ছিল খুব সাধারণ একটি প্রতিক্রিয়া। ধরেই নেয়া হয় নারীরা সর্বংসহা, কড়া সমালোচনা করার কোনো অধিকার তাদের নেই। এখানেও তাই ঘটেছিল। একজন মহিলার অস্বস্তিবোধ শুধুমাত্র কিছু পুরুষদের কামুক স্বভাবের পরিচয় তুলে ধরার জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাদের আচরণের ভিন্নতা কিছুটা পশুদের মতোই যারা নিজেদের মধ্যে একজন আরেকজনকে নিয়মমাফিক স্পর্শ করে, প্রহার করে এবং আঁচড় দেয়। আবার কখনো তাদের আচরণ অতি মানবীয়ও হয়ে থাকে।
অতঃপর সেই পুরুষটি তার নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেয় এবং প্রকাশ্যে ক্ষমাও চায়। মহিলাটিও সেটা গ্রহণ করে নেন। যাইহোক, অনেক ক্ষেত্রেই মহিলাদের অভিযোগ করার কোনো জায়গা থাকে না। তাই তারা কোনো অভিযোগও করে না। কোথাও কি কেউ পুরুষদের আহ্বান করে যারা স্বেচ্ছায় অথবা হঠকারিতার সাথেই হোক প্রকাশ্যে তাদের ব্যক্তিগত জায়গা স্পর্শ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে? কবে পুরুষদের উন্মুক্ত স্থানগুলোতে নিয়ম কানুন মেনে চলতে নির্দেশ দেয়া হবে? কবে তাদের উপলব্ধি হবে তাদের এই আচরণগুলো মহিলাদের তীব্রতর অস্বস্তি তৈরি করে? যে সকল মহিলা এই অবমাননাকর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যায় তারাই কেবল বলতে পারে এই যৌন হয়রানির জন্য কোনো স্পর্শের প্রয়োজন হয় না অথবা ঐ ব্যক্তিটি সম্পর্কে ধারণা নেওয়ারও প্রয়োজন হয় না। কেন পুরুষেরা প্রকাশ্যে নিজেদের স্পর্শ করাকে এত বেশি প্রাধান্য দেয় যেখানে নারীরা চরমমাত্রায় অস্বস্তি অনুভব করে? কেন একজন নারী শারীরিকভাবে নিকটস্থ হলেই একজন পুরুষ বার বার এ ধরনের আচরণ করে?
যে দেশগুলোতে লিঙ্গ-সমতাকে প্রাধান্য দেয়া হয় এবং মহিলাদের দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে চলাফেরা করতে হয়, সেখানে পুরুষদের এরকম আচরণ সংগত নয়। এমনকি প্রকাশ্যে কারো নিজেদের প্রাইভেট পার্টস অসংখ্যবার স্পর্শ করাটা স্বাভাবিকভাবেই অগ্রহণযোগ্য, অমার্জিত এবং কোন ভাবেই সামাজিক শালীনতার ভেতর পড়ে না।
যখন বিমানের ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়, অসংখ্য পুরুষ (এবং কিছু মহিলারাও) জোর দিয়ে বলতে থাকে শারীরিক চাহিদার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। যাই হোক, যদি তাই সত্যি হতো, তাহলে সমগ্র পৃথিবীতে এ ধরনের আচরণ সবসময়ই ঘটতো এবং একই ফ্রিকোয়েন্সিতে ঘটতো। প্রকৃতপক্ষে সেটা ঘটে না। যে দেশগুলোতে লিঙ্গ-সমতাকে প্রাধান্য দেয়া হয় এবং মহিলাদের দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে চলাফেরা করতে হয়, সেখানে পুরুষদের এরকম আচরণ সংগত নয়। এমনকি প্রকাশ্যে কারো নিজেদের প্রাইভেট পার্টস অসংখ্যবার স্পর্শ করাটা স্বাভাবিকভাবেই অগ্রহণযোগ্য, অমার্জিত এবং কোন ভাবেই সামাজিক শালীনতার ভেতর পড়ে না।
ব্যাপারটি এমন নয় যে অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির বিশেষ করে পশ্চিমের উদার নীতির দেশগুলোতে এই ধরনের আচরণ নির্মূল করতে কোনো সমস্যা হয় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ইতালিতে গত দশকে এই জঘন্য প্রবৃত্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তখন আদালত স্বীকার করেছিল যে মাঝে মাঝে পুরুষরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে বসেন। কেননা এটি তাদের কুদৃষ্টিকে নিবৃত্ত করে এমন একটি সাংস্কৃতিক অনুশীলন হিসেবে তারা এটা করতে উদ্যোগী হয়। আদালত সেই সময় ঘোষণা দিয়েছিল, এখনই আসল সময় এই ধরণের আচরণকে এবং এই সবের পক্ষে-বিপক্ষে জনমতের তোয়াক্কা না করে নির্বিশেষে এই চর্চাকে সমূলে উৎপাটন করা। এখনই সময় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
সবসময় প্রচার করা হয় নারীদের সমান অধিকার আছে এবং তাদেরও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি তারা ন্যূনতম সম্মানটাই না পায় যখন তারা উন্মুক্ত স্থানে থাকে; তাহলে নারী স্বাধীনতাকে যে সম্মান দেওয়া হয় তা কেবল একটি মিথ্যা প্রবঞ্চনা।
এখন পাকিস্তানেরও (পাঠক পড়ুন বাংলাদেশেরও) সময় এসেছে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার। মহিলাদের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী এরকম জঘন্য আচরণের জন্য অবশ্যই প্রকাশ্যে পুরুষদের এইসব আচরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং জরিমানা করা উচিত। সবসময় প্রচার করা হয় নারীদের সমান অধিকার আছে এবং তাদেরও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি তারা ন্যূনতম সম্মানটাই না পায় যখন তারা উন্মুক্ত স্থানে থাকে; তাহলে নারী স্বাধীনতাকে যে সম্মান দেওয়া হয় তা কেবল একটি মিথ্যা প্রবঞ্চনা। অবশ্যই এখানে অনেক পুরুষ আছেন যারা দ্বিমত পোষণ করবেন এবং বলবেন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানে তাদের যা খুশি তাই করার অধিকার আছে। তবে যাহোক, আশার বাণী হলো কিছু সংখ্যক পুরুষ এ লেখাটি পড়বে এবং নিজেদের সাথে মিলিয়ে দেখবে। তারা বিবেচনা করবে জনসাধারণের স্থানে তাদের চেতন বা অবচেতন মনের কোন কোন অভ্যাস মহিলাদের তীব্র অস্বস্তির ভেতর ফেলে।
একটি ন্যায়সঙ্গত এবং ন্যায্য সমাজ কখনোই গঠিত হতে পারে না যতক্ষণ না পর্যন্ত উভয় লিঙ্গকে যথার্থ সম্মান দেওয়া না হবে। একটি সমাজে ন্যায়পরায়ণতার অস্তিত্ব থাকতে পারে না যখন পুরুষেরা উন্মুক্ত জায়গাগুলোতে কর্তৃত্ব এবং প্রভাব বিস্তার করে। এবং এটাকে আপনি কথ্য বা অকথ্য যাই বলেন না কেন, এদের আচরণ পরিবর্তনের জন্য সনির্বদ্ধ অনুরোধ করা মানেই একটা মেকি হাসি এবং ধিক্কারের মুখোমুখি হতে হয়। তারা আসলে ভালো করেই জানে তেমন কিছুই হবে না। এসকল পুরুষ সম্ভবত কয়েকটা পরিচ্ছদ শেষ করার আগেই এই অনুচ্ছেদটি পাঠ করা বন্ধ করে দিবে।
প্রত্যেকের জন্য বলছি, দয়া করে লক্ষ্য করবেন। যদি কোনো পুরুষ মানুষ থাকে যারা নারীর সমতাকে সমর্থন করে, তাদের সর্বসাধারণের উন্মুক্ত স্থানগুলোতে প্রবেশের সমানাধিকারের পক্ষে কথা বলে তাদের অবশ্যই একটি বিষয়ে পরিষ্কার থাকতে হবে। আর সেটি হলো, যখন তারা কোনো উন্মুক্ত পরিবেশে একজন মহিলার পাশাপাশি সহাবস্থান করবে, তারা অবশ্যই তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকবেন।