সাইফুল হক ২৬ শে জুলাই ১৯৫৬ সালে চট্রগ্রামের স্বন্দীপে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে স্কুলে থাকতেই রাজনীতি শুরু করেন। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন। ৮২-৯০ এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি’ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাইফুল হক। ১৪ জুন, ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধ যৌথ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার বিরোধিতা করে ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি’ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে শুরু করেন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কস পার্টি। তিনি গত এক দশক ধরে দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সাথে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালেখিতেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। ১৮টি বই লিখেছেন। বর্তমানের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বামদলগুলোর একটি ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ‘দুঃশাসন, জুলুম, দুর্নীতি, লুটপাট, পরিবারতন্ত্র রুখো’ এ আহ্বানে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ নামের এই ঐক্য প্রক্রিয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা ও সমন্নয়ক সাইফুল হক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থাসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে জবানের সাথে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাতুল ইসলাম রাফি।
আপনি মনে করেন কি, বর্তমান সরকার বা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে?
সাইফুল হক : না, আমি মনে করি না এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। কারণ এই নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। শুধু আমরা নই, সাধারণ জনগণই এ কথা বলছে।
এছাড়া এটা মনে করবার কিংবা বিশ্বাস করবার কোনো কারণও নাই। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও তার যে মর্যাদা বহু আগেই ভূলুণ্ঠিত করেছে। বিশেষত তারা সরকারের রাজনৈতিক আকাঙ্খা বাস্তবায়ন করার চেষ্টায় আছে। এবং এটা করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত করে ফেলে। একটি উদাহরণ দিই গত বছরের আগস্ট মাস থেকে কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপে বসেছে। কিভাবে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায় যা অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের সহায়ক হবে। এবং এতে সমাজের বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকসহ বিভিন্নজন তাদেরকে নানান পরামর্শ দিয়েছে যাতে করে সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন করা যায় সুশীল সমাজ কিংবা সাংবাদিক সমাজ তারা নানাভাবে সুপারিশ করেছে যাতে করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়। কিন্তু বছর ধরে সংস্কারের নামে পরামর্শ চলল, যে পরামর্শগুলো তারা পেল তা একদিনের জন্যও বাস্তাবায়নের কোন চেষ্টায় তারা করেনি। এতে বোঝা যায় তারা একেবারেই নামকাওয়াস্তে এই কাজ করেছে। বরঞ্চ তারা তাই করছে যা আমরা বলিনি; যেমন– ইভিএম চালু করার প্রক্রিয়া, যা আমরা বলিনি এবং মহাজোটসহ কয়েকটি দল ব্যতীত আর আর কেউই এটা সমর্থন করে না। তা সত্ত্বেও এগারো থেকে বারোগুণ বেশি দাম দিয়ে ইভিএম আমদানি করা হয়েছে অথচ আমাদের দেশের ভোটাররা এক্ষেত্রে অসচেতন এবং এটি চালানোর মতো দক্ষ জনবলও আমাদের নেই। এটাও একটি বিতর্কিত এবং অপ্রয়োজনী কাজ। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সেটাই নির্বাচন কমিশন করেছে। এর মধ্য দিয়ে অনুমান করা যায় যে, এরই মাঝে বিশাল একটি বাণিজ্যের ব্যাপার আছে। এর জন্য আমরা বলেছি এই নির্বাচন কমিশনের এটা আমূল পরিবর্তন দরকার, সংস্কার দরকার, এর খোলনলচে পরিবর্তন করা দরকার এবং রাজপথে এটা আমাদের অন্যতম বড় দাবি ছিল।
আমি নানান জায়গায় বলেছি যে, তারা আর নেতাদের ওপর ভরসা করতে পারছে না, তাই তারা অভিনেতা আমদানি করছে। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড এতটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে যে তারা এখন যারা শোবিজে আছেন, যাদের জনপ্রিয়তা আছে, তাদের ব্যবহার করে তাদের স্বৈরতন্ত্রকে দীর্ঘায়িত করার পায়তারা করছে।
বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদকে জনপ্রিয় করার জন্য সমাজের জনপ্রিয় ও আপাতভাবে গ্রহণযোগ্য তারকাদের ব্যবহার করা হচ্ছে?
এই যে নির্বাচন কমিশন, সেটা মূলত সরকারের টুলস হিসেবে কাজ করছে। সরকারের ছক অনুযায়ী তারা তাদের সিডিউল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে আরো পাঁচ বছর তাদের এই স্বৈরাচার চালিয়ে যাওয়ার বৈধতা পাওয়ার পায়তারা করছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটা দৈন্যের ব্যাপার যে তারা একটি ঐতিহাসিক, স্বীকৃত দল হিসেবে তাদের পুরনো-নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিবর্গের উপর আর আস্থা রাখতে পারছেন না। আমি নানান জায়গায় বলেছি যে, তারা আর নেতাদের ওপর ভরসা করতে পারছে না, তাই তারা অভিনেতা আমদানি করছে। আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড এতটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে যে তারা এখন যারা শোবিজে আছেন, যাদের জনপ্রিয়তা আছে, তাদের ব্যবহার করে তাদের স্বৈরতন্ত্রকে দীর্ঘায়িত করার পায়তারা করছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এই কৌশল দেখা যায়। নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিন্তা করলে, একজন অভিনেতা কিংবা গায়ক কি কোনও দলকে সমর্থন করতে পারে না? দলের পক্ষে প্রার্থী হতে পারে না? অবশ্যই পারে। কিন্তু, সেটা তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যখন সারা বছর কোন খবর থাকে না এবং নির্বাচনের আগে হঠাৎ তাদের আবির্ভাব হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনৈতিকতা সন্ত্রাস ও আইনের বেআইনি ব্যবহার এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এর থেকে মুক্তির জন্য কী ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন বা প্রচেষ্টা দরকার বলে মনে করেন?
এক্ষেত্রে প্রথমত বলব আইন শুধু সংবিধানে আছে, বিভিন্ন ধারা-উপধারায়, কাগজপত্রে আছে, বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। মূলত আইন হলো বর্তমানে যারা বিত্তশালী সম্পদশালী অর্থাৎ যারা ক্ষমতাসীন তাদের জন্যই আছে। যাদের ক্ষমতা আছে বিত্ত আছে, ঐশ্বর্য আছে তাদের সাথে আইন এক ধরনের আচরণ করে এবং যাদের এসব নেই তাদের সাথে অন্য ধরনের আচরণ করে। সরকার কিন্তু প্রতিনিয়ত নতুন আইন করছে। যা তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। ইতোমধ্যেই সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, শ্রম আইন, নিরাপদ সড়ক আইন ছাড়াও বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে এর কিছু কিছু অবশ্যই জনবান্ধব। কিন্তু অধিকাংশ আইনই জনগণের স্বার্থ পরিপন্থী জনগণের স্বার্থবিরোধী। যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশকে অত্যাধিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যারা জনগণের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ। ও গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের আইন কখনোই কাম্য নয়। মূলত দমনের মাধ্যমে শোষণ করার হাতিয়ার এটি। নাগরিক অধিকার হরণকারী একটি আইন। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আপনাদের এবং বাম বলয়ের আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক অবস্থান কেমন হবে?
প্রথমত বলি, আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি। এটার প্রেক্ষিতটা অবশ্য বলা দরকার, আমরা একটা অবাধ নির্বাচনের জন্য যে দাবিগুলো দিয়েছিলাম, কার্যত কোনো দাবি আদায় করা যায়নি, কোনো দাবি বাস্তবায়ন করা হয় নি। সর্বশেষ গত ৬ তারিখ আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমাদের বামজোটের যে সংলাপ হয়েছে আমরা সেখানেও পুরো বক্তব্যটা দিয়েছি, কিন্তু কোনো কিছুই তারা আমলে নেননি। এভাবে কোনো দাবি আদায় না হয়েও আমরা যাচ্ছি বাধ্য হয়ে। কারণ এই মুহূর্তে সরকারকে বাধ্য করার মতো কোনো গণজাগরণ আমরা তৈরি করতে পারছি না। এবং এই দায়িত্ব নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এটা পারছি না বিধায় নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের দাবিগুলোকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করা, মানুষকে সচেতন করা, সংগঠিত করা আমাদের ক্যাম্পেইনের বড় একটা অংশ হিসেবে থাকছে। কোনো বিরোধী দল নির্বাচনে না গেলে একতরফা নির্বাচনের রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সরকার চেষ্টা করেছিল বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার জন্য, কিন্তু এবার সরকার চেষ্টা করছে বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে না আসে। এটি আমাদের বিবেচনার মধ্যে আছে। তাই আমরা ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাটিকে অব্যাহত রাখার জন্য আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। আমরা সরকারকে বলেছি একটা অবাধ পরিবেশ তৈরির কথা এবং সরকার ও নির্বাচন কমিশন সে আশ্বাস দিয়েছে। এটি আমরা বাস্তবায়িত হতে দেখতে চাই। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো অবাধ পরিবেশ তৈরি হয় নি। গত দশ বছর ধরে মানুষ তার ভোট দেয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি বলে মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত একটা ক্ষোভ আছে। মানুষ ন্যূনতম একটা সুযোগ পেলে একটা জাগরণের সম্ভাবনা আছে। এটি এমন একটি দেশ যেখানে মানুষ দু’বেলা না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু ভোটের অধিকারটা খোয়াতে চায় না। ভোট দিতে না পারার ব্যাপারটা তাদের জন্য খুবই মারাত্মক পর্যায়ের। ফলে এবার মানুষের মধ্যে তার ভোট দেয়ার গণতান্ত্রিক অধিকারটা চর্চা করার প্রবল আগ্রহ আছে বলে আমাদের ধারণা। এজন্য আমরা ন্যূনতম একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে চাই। আমরা আশা করি মানুষ ব্যাপক হারে রাস্তায় নামবে। এজন্য আমরা আহ্বান করি এবার ভোট কেন্দ্রকে সকাল থেকে পাহারা দিয়ে রাখার। ভোট জাগরণের আকাঙ্ক্ষার পাশে আমরা দাড়াতে চাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা নির্বাচনে থাকবোই এরকম কোনো গ্যারান্টি নেই। যদি দেখি যে ২০১৪ সালের মতো পরিবেশ চূড়ান্ত তামাশায় পরিণত হচ্ছে তখন আসরা নির্বাচন বর্জনও করতে পারি। নির্বাচনের প্রস্তুতিটাই আমাদের মূল মনোযোগের জায়গা। আমরা প্রার্থীরা যেমন তাদের ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। পাশাপাশি আমাদের ইশতেহার তৈরি করার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রস্তুতির ব্যাপারটাও আমাদের প্রক্রিয়াধীন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরূদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলা, পাশাপাশি শাসকশ্রেণির অপরাজনীতি, স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতি এর বিরূদ্ধে জনগণের উত্থান এবং জনগণের নিজস্ব শক্তি যাতে বিকশিত করা যায় সেই চেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে।
সরকারের কাছে বারবার দাবি করছি, নির্বাচন কমিশনকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার কথা বলছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসন সরকারি দলকে জিতিয়ে দেয়ার সমস্ত চেষ্টা তারা অব্যাহত রেখেছে। ফলে ন্যূনতম কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো তৈরি হয়নি।
প্রথমেই আপনি বলেছিলেন কোনো সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি এই পর্যন্ত, তারপরও আপনারা নির্বাচনে যাচ্ছেন। কেন?
সেটা বলেছি মানুষের উপর আমরা একটা আস্থা রাখতে চাই, সুযোগ পেলে মানুষের একটা ভোট জাগরণের একটা সম্ভাবনা আছে। আমরা গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পক্ষে দাঁড়াতে চাই। যে মানুষ দশ বছর ধরে প্রতারিত হয়েছে, যে মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি, সে মানুষের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, তার পুঞ্জীভূত আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনাকে আমরা নাকচ করে দিতে পারি না। সে বিশ্বাস থেকেই আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। নির্বাচন যেভাবেই হোক, থাকবোই— বামজোটের অবস্থানটা এরকম না। আমরা থাকতে চাই, থাকার পরিবেশ তৈরির জন্যে আমরা কথা বলছি, সরকারের কাছে বারবার দাবি করছি, নির্বাচন কমিশনকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার কথা বলছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসন সরকারি দলকে জিতিয়ে দেয়ার সমস্ত চেষ্টা তারা অব্যাহত রেখেছে। ফলে ন্যূনতম কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো তৈরি হয়নি। এরকম প্রবল প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি একটা ঝুঁকি নিয়ে, এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছি, সেক্ষেত্রে যা করবো তা একেবারে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।
যে সব বাম সংগঠন সরকারের সাথে থেকে ক্ষমতায় আছে এবং আবারও ক্ষমতায় আসার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে, তাদের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী?
আমরা আগেও বলেছি, আমরা মনে করি যে তারা এই আওয়ামী লীগের যে দুঃশাসন তারা তার রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। এবং বর্তমান সরকারের যে অপরাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ণ এবং দুঃশাসন এই পুরো গণবিরোধী রাজনীতির একটা পরিশিষ্ট হিসেবে তারা এখানে ভূমিকা পালন করছে। এদেশের কোনো বাম আন্দোলন বা কোনো বিপ্লবী পরিবর্তনে কোনো আকাঙ্ক্ষাকে তারা ধারণ করে না এবং ধারণ করার কোনো অবকাশও তাদের নেই। তারা এখন বাম নামে আছে সমাজের মধ্যে বাম প্রগতিশীলদের যে গ্রহণযোগ্যতা আছে সেটাকে খানিকটা ব্যবহার করার জন্য। আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে তাদের রাজনীতিকে আলাদা ভাবার কোনো অবকাশ আগেও ছিল না, এখনো নেই।
গণতান্ত্রিক দেশ গঠনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া জরুরি কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বা দেশ গঠনের জন্য বামদের কি কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে? থাকলে সেটা কি জনগণের কাছে জনপ্রিয় করার কোন উদ্যোগ আছে?
আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা আছে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। এই নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি কালো টাকার খেলা। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় কোনো সৎ, সংগ্রামী, দেশপ্রেমিক, আত্মনিবেদিত প্রাণ, নেতা-সংগঠকদের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দিতা করা, জয় লাভ করা কার্যত অসম্ভব। তাই এই টাকার খেলার নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। এজন্য আমরা ৫৪ দফা প্রস্তাবনা এবং আমাদের পার্টির ২৩ দফা প্রস্তাবনা দিচ্ছি। নির্বাচন কমিশনের সাথে আমাদের গত সভাতে আমরা এটি দিয়েছি। আমরা একমত যে, আমাদের বক্তব্যগুলো এখনো খুব বেশি জনপ্রিয় করতে পারি নি। আওয়ামী জোটের সাথে বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। কালো টাকার নির্বাচনের হাত ধরে জাতীয় সংসদ যখন দাগী অপরাধীদের এককটা সমিতিতে পরিণত হয়েছে। এই প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো বিরোধী অবস্থান আমরা দেখি নি। আমাদের পার্টির সুস্পষ্ট বক্তব্যে আমরা বলেছি, বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ভোটের আনুপাতিক- সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতিটাকে তৈরি করা দরকার। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সারা দেশে যদি আমরা দশ লক্ষ ভোট পাই, সংসদে কয়েকটি আসন অর্জন করে আমরা দলকে উপস্থাপন করতে পারি। সংসদকে অনেক বেশি রিপ্রেজেন্টেটিভ করার জন্য নেপালসহ পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
আগে ব্যবসায়ীরা দলগুলোকে চাঁদা দিতো, এখন ব্যবসায়ীরা চাঁদা দেয়ার পরিবর্তে নিজেরাই রাজনীতি করে। অর্থনৈতিক ক্ষমতাসহ রাজনৈতিক ক্ষমতাটাকেও তারা নিরঙ্কুশ করতে চায় যা ভবিষ্যতের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এই ব্যাপারে যারা সত্যি সত্যি রাজনীতি মনস্ক তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
সেক্ষেত্রে আসন বিন্যাসের ব্যাপারটা কীভাবে হবে?
যদি আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়, তবে বিস্তারিত করার জন্য হয়তো আমরা ভাবতে পারি। পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেটি কাল টাকার ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়েছে, এই কথাটা আমরা ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বলছে না। এজন্য অবসরপ্রাপ্ত আমলা, ব্যবসায়ী, বিত্তবান, দাগী অপরাধী, সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করছে। যেটা বাংলাদেশের জন্য আগামীতে খুবই ভয়াবহ প্রবণতা। এবারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হওয়া দরকার। আগে ব্যবসায়ীরা দলগুলোকে চাঁদা দিতো, এখন ব্যবসায়ীরা চাঁদা দেয়ার পরিবর্তে নিজেরাই রাজনীতি করে। অর্থনৈতিক ক্ষমতাসহ রাজনৈতিক ক্ষমতাটাকেও তারা নিরঙ্কুশ করতে চায় যা ভবিষ্যতের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এই ব্যাপারে যারা সত্যি সত্যি রাজনীতি মনস্ক তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
যদি এবারও কারচুপির নির্বাচন হয়, তবে তা প্রতিরোধ করতে মাঠে থাকবে?
আমরা নিশ্চয়ই প্রতিরোধ করার জন্য এবার নির্বাচনে যাচ্ছি। আর আমরা আশা করি প্রতিরোধের মনোভাব নিয়েই মানুষ এবার নির্বাচনের কথা চিন্তা করছে। এজন্য ভোটের ফলাফল চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে অবস্থানের কথা বলছি। এতে যারা ভোটকেন্দ্রে জালিয়াতি করতে চাইবে তাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব হবে না। আমরা যেমন উদ্যোগ গ্রহণ করবো, সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলকেও উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলবো। প্রতিটা প্রার্থীর ন্যূনতম ভোটও যেন গণনা করা হয়।
আইনের নামে বে-আইনি শাসন, সংবিধানের দোহাই দিয়ে স্বৈরাচারী শাসন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার এবং মিডিয়াকে অবৈধ ক্ষমতার জন্য ব্যবহারের এই সময়ে কী ধরনের রাজনীতি জনগণকে স্বার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনে উদ্যোগী করতে পারে?
এই সময়কালের প্রধান বিষয় হলো আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি সে স্বপ্নটাকে মানুষের সামনে আনা দরকার। একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ণের বাইরে আমরা একটা উন্নত, গণতান্ত্রিক, মানবিক, মানুষের প্রতি সংবেদনশীল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি, এই ভিশনটা রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে আনতে পারেন। সাংবিধানিক কিছু সংস্কার আমরা চাই। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা সক্রিয় করতে চাই। সংবিধানের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ও সাম্প্রদায়িক ধারাগুলোর পরিবর্তন দরকার।