মুক্তিযুদ্ধ ‘ভিজে দিবস’ কিভাবে হয়?

মুক্তিযুদ্ধ ‘ভিজে দিবস’ কিভাবে হয়?

ফেলানীর কথা কি মনে আছে? থাকার কথা, থাকা উচিৎ। তবুও একবার মনে করিয়ে দেই, সালটা ২০১১, ৭ই জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতারে ঝুলতে দেখা যায় একটি লাশ। ফেলানীর লাশ। বাংলাদেশের মেয়ে, হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ, লাশটা ঝুলছিলো বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাঁটাতারে! মর্মান্তিক সেই দৃশ্য সবার মনে থাকার কথা। এখন আসি বর্তমান প্রেক্ষাপটে। ফেলানীর কথা কেনো তুলতেছি সেটা আগে ব্যাখ্যা করি। ভারত বাংলাদেশের বন্ধু। এটাই শুনে বড় হয়েছি আমরা। গত দশবছরে ভারতের সাথে বন্ধুত্ব খুবই শক্তিশালী অবস্থানে গিয়েছে। তবে এই বন্ধুত্ব কার সাথে? বাংলাদেশের সাথে নাকি আওয়ামী লীগের সাথে? যদি বাংলাদেশের সাথেই হতো তবে সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি কেন? অনেক প্রশ্নই আসে। উত্তরের ধাঁধা বড্ড জটিল। তবে ২০১১ সালে ফেলানী হত্যাকান্ড এবং তার লাশের মর্মান্তিক প্রদর্শনই তার প্রমাণ। ফেলানীর কথা দিয়ে শুরু করেছি মাত্র। আরো আছে সুন্দরবন, বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রিংলা’র উচু গলায় অনধিকার চর্চা, ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বাংলাদেশে ভারতীয়দের কর্মসংস্থান যার দরুন বাংলাদেশ আজ ভারতের রেমিটেন্সের ২য় প্রধান উৎস, এছাড়া তিস্তা-ফারাক্কা আরো, আরো অনেক। বাণিজ্য ঘাটতির কথায় না আসি। সেটা অনেক বাংলাদেশির ক্ষোভের কারণ হবে। একপক্ষীয় দৃষ্টিতে কিছুই বলবোনা।  আসছে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট কাটার কোন ইচ্ছা আমার নাই।

১৯৭১ এ যুদ্ধটা কার ছিল? ভারতের না এই বাংলার আপামর জনগণের? মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু এই সাহায্যের রাজনীতি নিয়ে কথা না বলা অন্যায়।

 

বিজয়ের মাস চলছে, সামনে জাতীয় নির্বাচন, টানটান উত্তেজনায় দেশ। বিজয়ের মাস আসলেই একটা তর্ক সামনে আসে। ১৯৭১ এ যুদ্ধটা কার ছিল? ভারতের না এই বাংলার আপামর জনগণের? মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু এই সাহায্যের রাজনীতি নিয়ে কথা না বলা অন্যায়।  মুক্তিযুদ্ধ ছিলো শুধু ভারত বনাম পাকিস্তান যুদ্ধ, এটা মনে করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি? জানি নেই তবে কেনো প্রশ্ন আসে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দৌলতে এখন সবই জানা যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে বৈকি! হিন্দিতে তেনারা ১৬ই ডিসেম্বরকে আদুরে নাম দিয়েছেন ‘ভিজে দিবস’। ভিজে বলতে বাংলায় বিজয়কেই বোঝায়, হিন্দি চলচিত্রের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে আমরা সবাই তা জানি। তেনারা এই ‘বিজয়’ এর গৌরব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের দিতে নারাজ! তাদের মতে এই বিজয় শুধুই ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর! তাদের মতে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধই করেনি! যুদ্ধটা ছিলো ভারত বনাম পাকিস্তানের আর এই যুদ্ধ দিয়েই বাংলাদেশের হঠাৎ জন্ম! কি? কথাটা শুনে অনেকেই চটে যাচ্ছেন বুঝি? চটে লাভ নাই, এটাই ভারত রটিয়ে যাচ্ছে, হ্যাংলা লুঙ্গি পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে না ভারতের চৌকস সেনা বাহিনীর কাছে হেরেছে এই ভেবেই সন্তুষ্টির ঢেঁকুর তুলছে পাকিস্তান আর বাংলাদেশ? হ্যাঁ সেই বাংলাদেশ যেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি এখনো বাঙালিদের চেতনা ভেজানো চিরতার জল গেলাচ্ছেন এবং মহান সরকার রূপে অধিষ্টিত হয়েছেন, তাদের এই ব্যাপারে কোনই মাথা ব্যাথা নেই! কারন একটাই ভারত আমাদের বন্ধু ওরা যা বলবে তাই। ওরা যদি বলে মুক্তিযুদ্ধ হয় নাই যুদ্ধ করেছে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি আর একথা টাইগার সিনেমার সালমান খান তবে এই সরকার তাই মেনে নিবে। কি? হাস্যকর শোনাচ্ছে? শোনালেও এটাই সত্যি! আমরা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা শুনি তা আর কিছুই না বরং ভারতের প্রভুত্ববাদকে খুব চৌকসভাবে গ্রহণ করা মাত্র! হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের যে গল্প আমরা শুনি, বলি, গর্ববোধ করি সবকিছুই ফিকে হয়ে যায় যখন ভারতের মিডিয়া থেকে রাজনৈতিক সবাই মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে।

তেনারা এই ‘বিজয়’ এর গৌরব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের দিতে নারাজ! তাদের মতে এই বিজয় শুধুই ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর! তাদের মতে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধই করেনি! যুদ্ধটা ছিলো ভারত বনাম পাকিস্তানের আর এই যুদ্ধ দিয়েই বাংলাদেশের হঠাৎ জন্ম!

 

উপমহাদেশীয় বা আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারত কতটা গুরুত্বপুর্ণ তা বলাই বাহুল্য। রাজনৈতিক, ভৌগলিক, ঐতিহাসিক সংস্কৃতিক সব দিক থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী এই দেশ। সেই শক্তির অহংকারেই ‘তালগাছটা আমার’ নীতি মেনে চলে দেশটি। নেপালের সাথে ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তিই তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই এদেশের উপর ছড়ি ঘোড়াচ্ছে ভারত। ফারাক্কা বাধ, তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য সম্পর্ক সবকিছুতেই ভারতের স্বার্থ জয় লাভ করছে। গত দশবছরে যা বেড়েছে বহুগুণে। খুব ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়েই উদাহরণ দেয়া যায়, আমরা যখন রামপালে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে ব্যস্ত, আমরা বলছি সুন্দরবন টিকলে দেশ টিকবে, বিশ্বকে জানাতে চেষ্টা করছি পর্যটনের স্বর্গ আমাদের সুন্দরবন। তখন এই সরকার সুন্দরবন বিক্রি করে ভারতের প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিল বিদ্যুৎ উৎপাদন করার অজুহাতে। পুরো বিশ্ব যখন নবায়ণযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে আমরা তখন কিনা ৬০ এর দশকে বাদ হয়ে যাওয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আপন করে নিচ্ছি! তাও ভারতের কাছে মাথানত করে। এদিকে আমাদের সুন্দরবন যখন ধ্বংস হচ্ছে তখন ভারত তাদের অংশের সুন্দরবনকে নানা ভাবে বিশ্ববাসীর কাছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রচার করছে। তো ঐ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে লাভটা হল কার? সহজ অঙ্কেই তা প্রমাণ করা সম্ভব। রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে বিরাট ব্যবসার সুযোগ, অন্যদিকে সুন্দরবনকে নিজেদের দাবি করে বিশ্ব পর্যটকদের আমন্ত্রণ! মানে এক ঢিলে দুই পাখি! এদিকে বাংলাদেশ পাচ্ছে কি? প্রথমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে সুন্দরবনের মত বিরাট প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হবে যার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ আরহণ বন্ধ হবে। জীবিকা বঞ্চিত হবে লাখো মানুষ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পরবে পরবর্তী প্রজন্ম! এদিকে আমাদের সম্পদ দিয়ে তৈরি করা বিদ্যুৎ কিনে আমরাই ক্ষতির মধ্যে পড়বো। মানে যেদিক থেকেই দেখি আমাদেরই লোকসান। তবুও ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা স্বাধীন বাংলার এই লোকসান সহ্য করে যাবে ঐ ‘চেতনাধারী’ সরকার। কেউ কিছুই বলতে পারবে না। আর ভারত হবে বাংলাদেশের আজন্ম এবং পরীক্ষিত বন্ধু! আর সিনেমার নামে সংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথা নাই বা বলি। সুন্দরবনের কথাটা শুধু উদাহরণ স্বরূপ বলা। এমন আরো আছে। ফেলানীকে না হয় ফেলেই দেই।

এত কথা বলার একটাই কারণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে শুধু চাটুকারিতার কাছে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, লাখো মায়ের সম্ভ্রম, শহীদের রক্ত বিক্রি করে দিচ্ছিনা তো? নরেন্দ্র মোদি, ভারতীয় গণমাধ্যম, ভারতের বিমান বাহিনীর দেওয়া টুইটে বিজয় দিবসের বার্তা যেখানে মুক্তিযুদ্ধকে শুধুই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলা হচ্ছে সেটাকে মেনে নিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের চেতনা হারাচ্ছি না তো? আর এসব দেখেও চেতনাবাজ সরকার চাটুকারিতাই প্রমাণ করছে না কি? ভেবে দেখার সময় হয়েছে।