জোয়ার শব্দটা যেন অজান্তেই আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। এটি আরো স্পষ্ট বোঝা যায় নির্বাচনের সময়। গণজোয়ার, উন্নয়নের জোয়ার; আরো কত যে জোয়ার আছে তার ইয়াত্তা নেই। তবে, জোয়ার-ভাটার সাথে আমাদের যে এক গভীর সম্পর্ক আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। জোয়ার-ভাটার মতই আমাদের মনের অবস্থা ঠাহর করাও বেশ মুশকিল। যাই হোক, ভূগোল বা আবহাওয়া সম্পর্কিত কোনো বয়ান দেয়ার উদ্দেশ্যে জোয়ারের জিকর করি নি। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে বাংলাদেশ-উইন্ডিজ দ্বিতীয় টি টোয়েন্টি দেখার পরেই এটি আমার মাথায় ঢুকেছে।
বিশদ ব্যাখ্যাতেই যাই বরং। গত ম্যাচে ব্যাটসম্যানদের আত্মহুতিতে কিছুক্ষণ হতভম্ভ হয়েছিলাম। বেশ কবার চেষ্টা করেও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে দলটি আগের ম্যাচেই উইন্ডিজের বোলারদের লাক্কাতুরায় লজ্জায় লাল করেছে তারাই কি করে পুরো অন্য আবতারে হাজির হলেন? ব্যাটিং শেষেই জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে বোলারদের বেধড়ক পিটুনি খেতে দেখে বোধশূন্য হইনি। ম্যাকেঞ্জি বলেছেন, অতি আত্মবিশ্বাসই কাল হয়ে দাঁড়ানোয় লুটিয়ে পড়েছিল পুরো দল। আদমির ক্রিকেটাঙ্গনে অভিজ্ঞতা এবং খেলোয়াড়দের কাছ থেকে চিনার কথা চিন্তায় নিয়ে কবুল করে নিয়েছিলাম বিষয়টি। তখন থেকেই সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম মিরপুরে কি দেখা যায় সেটি নিয়ে। যা দেখলাম, তাতে আমার মনে হয়েছে আমাদের খেলোয়াড়দের মনেও জোয়ার ভাটার টান ব্যাপক প্রভাবই ফেলে। খড়কুটোর মতন যাদের কাছে উড়ে গেল ঠিক পরের ম্যাচেই তাদের উপর এমন তাণ্ডব!
শুরু থেকেই শুরু করি। লিটনকে ইদানিং আমার কাছে একটি ধাঁধাঁর মতন মনে হয়। বান্দার যোগ্যতা নিয়ে কখনোই সন্দিহান ছিলাম না। নিয়ত খেলার সাথে থাকার ফলে জ্ঞাত তার সামর্থ্য সম্পর্কেও। কিন্তু, যে বিষয়টি কিছুতেই হিসাবে মেলে না, সেটি হচ্ছে; যখনই মনে হয় যে লিটন কেবলই সামর্থ্যের উপর সুবিচার করতে শুরু করেছেন তখনই ড্রেসিংরুমের পথ ধরে আমার চিন্তার ওপর অবিচার করার এত আগ্রহ কেন তার? গত ম্যাচে যে শটটি খেলে আউট হয়েছেন তাতে তার পক্ষে দু’কলম লিখলেই কর্ণ গহবরে শ্রুতি মধুর কিছু শব্দ ভেসে আসার সম্ভাবনা ছিল। মিরপুরে পয়লা বল থেকেই যেন ম্যাজিকের মত বদলে গেলেন তিনি। একের পর এক চোখ জুড়ানো সব শট। কখনো নিখুঁত টেকনিকের সাথে কখনো ক্ষেপাটে টি টোয়েন্টির চাহিদা মেনে। কখনো ফিচলে বুদ্ধিতে তো কখনো বোলারের গতিকে বোলারের বিপক্ষেই অস্ত্র বানিয়ে! এমন ইনিংস যে খেলতে পারে তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলাও যখন পাপ বলে মনে হচ্ছিল তখনই যেন তার মনে হলো, এক দিনে অনেক কিছু দেখানো হয়ে গিয়েছে। যে বলটিতে বোল্ড হলেন; তার মতন একজন কি করে ঐ বলটিকে কাট করার যোগ্য বিবেচনা করলেন সেটিই তো বিস্ময়কর। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার গড় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। তার যে মান তাতে মাঝে মধ্যে এমন ইনিংস তৃপ্তি দেবার বদলে আফসোস বাড়ায়। ঠিক জানিনা সমস্যাটা কোথায়, তবে এর সমাধা যদি লিটন সময়মত খুঁজে পান; ঝুঁকি নিয়ে হলেও লিখে দিতে পারি খুনে মেজাজের একটি অসাধারণ ব্যাটসম্যানই পাবে বাংলাদেশ।
সৌম্যর সমালোচনায় যত শব্দ খরচ করেছি তার শোধ তুলতে তার উদ্যোগটিও বেশ লাগছে। আজকে যেভাবে আউট হলেন, সেটি চরম দুর্ভাগা না হলে সম্ভব না। ঐরকম ক্যাচ কালভেদ্রেই দেখা যায়। সমালোচনাকে সুখালোচনা করে তিনি যদি নিয়ত সার্ভিস দেন, বেশ খুশিই হব। শট খেলার সামর্থ্য তার যে রয়েছে সেটি আবারো দেখিয়েছেন তিনি। সমস্যাটা যে আসলে কার সেটি নিয়েই দ্বিধায় ভুগছি। আমি একাধিকবার তার যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছি, কিন্তু যারা তার যোগ্যতা সম্পর্কে স্থির বিশ্বাসী তাদের কাছে একটি সাওয়াল আছে অধমের। শেষ ক’ ম্যাচ বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে যে, ওপেনিং বা লোয়ার অর্ডারের চেয়ে তিনেই তিনি সাবলীল। তা, এখান থেকে তাকে টানা হেচড়া করা কেন? এক দু’ ম্যাচ খারাপ করলে সমালোচনা হয় এটা সত্য; কিন্তু তার ওপর যখন অটল আস্থা; তখন সে সমালোচনার ভয়ে তাকে বাঁচানোর বিদঘুটে সব পদ্ধতি বাড় করার চেষ্টা না করে তিনেই নামানো হোক। তাতে আমার মতন যারা শব্দ করাতে তাকে কচুকাটা করেছে তাদের নিয়ে নাহয় পরিহাসই হোক; তবু দলের তো উপকার হয়।
টি টোয়েন্টি দলে সিনিয়র চারজন অবশ্য এতটা উচাটন মন নিয়ে খেলেন না। বরং, মাঝে মধ্যে বাদ দিলে বাংলাদেশের জোয়ালাটা তারাই টেনে নেন। ব্যাটিংয়ে আজকেও যেটি করেছেন সাকিব-মাহমুদুল্লাহ। তবে জোয়ার ভাটার টান যে তাদের মধ্যেও একদমই দেখা যায় না তা না। দলের সবচেয়ে পরিশ্রমী খেলোয়াড় মুশফিক যেমন গত ম্যাচে আচমকা ক্লান্ত বোধ করলেন রান নেয়ার সময়! নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে বরং এক রকম অপেক্ষায়ই যেন ছিলেন কে স্ট্যাম্পটি ভাঙতে পারে সেটি দেখার জন্য! খোদার দরবারে শুকরিয়া যে, এমন ইচ্ছে তাদের কালভেদ্রে জাগে। যেটির বিপরীতে সৌম্য আর লিটন।
মিরাজ নিয়ত এক গওহরে পরিণত হচ্ছেন। বোলিং এ উন্নতির ছাপ স্পষ্ট। ব্যাট হাতেও কার্যকারিতার প্রমাণ রেখেছেন। ইতিবাচক বিষয় সাইফুদ্দিনকে নিয়মিত সুযোগ দেয়াটা। বাংলাদেশে এখন দু’জন বিশ্বমানের স্পিন অল রাউন্ডার রয়েছে। সাইফুদ্দিনকে যদি যথাযথ সমর্থন দিয়ে তার সামর্থ্যটাকে কাজে লাগানো যায় তাহলে বাংলাদেশের জন্য সেটি হবে একটি বাড়তি পাওনা। অভাগা বলা যায় আরিফুলকে। বান্দা জার্সি গায়ে মাঠে তো নামছেন বটে, তবে না সুযোগ পাচ্ছেন ব্যাটিংয়ে কিছু করার না বোলিংয়ে। এমন অবস্থায় যেটি হয়, একবার সুযোগ আসলে বাড়তি কিছু করার তাড়নায় পরিস্থিতি প্রতিকুল হয়ে যায়। আরিফুল যদি সুযোগ পান, আর তাতে যদি আমার আশঙ্কা বাস্তবে রুপ নেয়, তাহলে নির্বাচকদের কাছে অনুরোধ থাকবে এ বিষয়টি মাথায় রাখার। কাউকে ছুড়ে ফেলে দেয়ার প্রবণতা আমাদের প্রাচীন কালের। তা, ছুড়ে ফেলার আগে একটু পরখ করে নিতে দোষ কি?
মোস্তাফিজ এ ম্যাচে রান দেয়ায় হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। প্রতিপক্ষ যখন দু’শোর বেশি তাড়া করতে নামে তখন কারো ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না। দুর্ভাগ্য সে ঝড়টি গিয়েছে ফিজের ওপর দিয়ে। তবে, এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন; যেটি এর আগেও অনেক লেখায়ই বলেছি; মোস্তাফিজের বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনা তার নিজের জন্যই প্রয়োজন। পিচে যখন কাটার ধরে না বা তা ওপর যখন ব্যাটসম্যান চওড়া হন তখন স্টক বল সীমিত হবার কারণে তিনি প্রায়ই পরিস্থিতি নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসতে পারেন না। বিশ্বের ওয়ান ডে র্য্যাঙ্কিয়ে যিনি পাঁচ নাম্বারে তিনি কোন জাতের সেটি নিয়ে সাওয়াল তুলে নিজেকে কৌতুকর চরিত্র হিসাবে উপস্থাপনের ইচ্ছে নেই। যেটুকু বলা তা এই জন্য যে, পাঁচে যখন পৌছুতে পেরেছেন এক ও অসম্ভব কিছু না। সেটি করতে গেলে বাড়তি অস্ত্র তার জন্যই সহায়ক হবে।
ম্যাচের মূল নায়কের জিকরই তো করা হলো না! সাকিব আল হাসান। আমি সাধারণত একজনের সাথে আরেকজনের তুলনা করতে পছন্দ করি না। তাই, মাশরাফির বদলে অধিনায়ক হিসাবে সাকিব কেমন করছেন তাতে আমার আগ্রহ কম। আমি বরং যেটিতে মুগ্ধ হচ্ছি তা হলো শেষ যেবার পূর্ণকালীন অধিনায়ক ছিলেন সে সাকিব আর এই সাকিবের মধ্যকার পার্থক্য দেখে। হ্যাঁ, দলে আগের চেয়ে পারফর্মার বেড়েছে; কিন্তু তাদের মধ্যেও সামনে থেকেই তার নেতৃত্ব দেয়াটা অসাধারণ। মিরপুরে পাঁচ উইকেট নিয়ে আরো একটি ইতিহাস গড়লেন তিনি। সাকিব সাকিবের মত করে দলকে কোথায় নিয়ে যেতে পারেন সেটি দেখার একটি কৌতুহল রয়েছে আমার। তিনি আগের চেয়ে অনেক স্থির, কৌশলী। সমস্যাটা যথারীতি ঐ জোয়ার-ভাটাতেই। মাঝে মধ্যেই কৌশলী সাকিব সাধারণ কৌশলটাও যেন ভুলে যান, এর খেসারত দিয়ে ম্যাচও হারতে হয়েছে।
হয়ত কালকেই গল্পটা বদলে যাবে। অথবা, জন্ম নিবে আরো একটি আনন্দক্ষণের। জগতটা যখন খেলার তখন এটাই স্বাভাবিক। আমি জানি না, কেউ একমত হবেন কি না; এ দলটার সামর্থ্য রয়েছে ইতিহাস সৃষ্টি করার। সেটার জন্য আমার যা মনে হয়; মনটার ওপর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। হ্যাঁ, তাতে প্রত্যেক ম্যাচেই লিটন-সৌম্য ঝড় তুলতে পারবেন না। সাকিব পাঁচ উইকেট পাবেন না; কিন্তু জয়ের ধারাবাহিকতাটা বাড়বে। জোয়ার শব্দটা নিয়ে রাজনীতিবিদদের যখন এত আগ্রহ থাকুক না তারা সেটি নিয়ে, ক্রিকেটাররা বরং নয়া কোনো শব্দের জনম দিক। যা হবে শুধুই তাদের।