কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, তুমি আমার সামনে দাড়ালেই আমি
তোমার ভিতরে একটা বুনো ঝোপ দেখতে পাই।
ওই ঝোপে একটা মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া আছে।
অনেকদিন ধ’রে আছে। কিন্তু আশ্চর্য যে
এই মৃতদেহ জল, বাতাস, রৌদ্র ও সকলপ্রকার
কীট-বীজাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে। এর পচন নেই।
– জয় গোস্বামী
যারা এর আগেও আমার লেখা পড়েছেন তারা খেলার সাথে কবিতার সঙ্গম ঘটানোর প্রচেষ্টার সাথে পরিচিত। তা, জয় গোস্বামীর এই কবিতা কেন প্রারম্ভে টেনে আনলাম সে কথায় যাবার আগে জেনে যাওয়া একটি তথ্য পুনরায় জানাই। বরখাস্ত হবার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে মোরিনহো-ম্যাঞ্চেচেস্টারের আড়াই বছরের সম্পর্কের। মৌসুমের শুরুতেই এমন কিছুর আশঙ্কা নিয়ে দুটো লেখা লিখেছিলাম। এটি তার ধারাবাহিকতা না, এ লেখায় আমি খুজব সর্বকালের সেরার পথে হাটতে থাকা এক পথিক আচমকাই পথ হারিয়ে পরিহাসের পাত্রে কি করে পরিণত হলেন সে বিষয়ে।
জয় গোস্বামীর কবিতার প্রথম তিনটি লাইন বর্তমান মোরিনহোকে ব্যাখ্যার জন্য উপযুক্ত বলে আমার মনে হয়েছে। এক সময়ের প্রবল প্রতাপশালী এই পর্তুগিজ অনেকদিন ধরেই যেন মৃতদেহর মতই অসাড়। কেবলই অতীত। আবার অতীতের অর্জন বিবেচনায় এইটাও সত্য যে, এই মৃতদেহের পচন নেই। আজ তিনি ইউনাইটেডে অতীত হয়ে গেলেও গণমাধ্যম থেকেও যে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবেন; মোরিনহোকে চিনে থাকলে এমনটি ভাববার সুযোগ নেই।
মোরিনহোর বরখাস্ত হবার যে নব্য রাওয়াইয়্যাত এর সূচনা রিয়াল’র থেকে। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে একটু ব্যক্তি মোরিনহোর দিকে নজর দিতে চাই। অমানিশা থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে তিনি পয়লাবার আলোচনায় আসেন পোর্তোর কোচ হিসাবে। যে দলটিকে তিনি ইউরোপা এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। পোর্তোর মতন দলকে যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতন মাশহুর আসরে শিরোপা এনে দিতে পারেন তিনি আর যাই হোক ফেলনা কেউ হতে পারেন না। সে সাফল্য তাকে নিয়ে আসলো লন্ডনে, তথা চেলসিতে। ব্লুজদের হয়ে বেদনায় নীল হবার বদলে বেশ রঙিন একটি সময়ই পার করেছেন তিনি। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে ইন্টারে। চেলসি থেকে তার বিদায়টা কিন্তু বর্তমানের মত বদখত পরিস্থিতে হয়নি। ইন্টারে গিয়ে তো গড়েছেন ইতিহাসই। গড়বড়টা লাগল মাদ্রিদে।
ব্লাঙ্কোসদের সাথে বন্ধনে জড়াবার আগের ক্লাবগুলোর দিকে একটু লক্ষ্য করুন। পোর্তো, চেলসি এবং ইন্টার। মোরিনহোকে চরম পেশাদার বলা হয়ে থাকে। আরো একটি জিনিস ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তিনি সব সময় সব কিছুর কেন্দ্রে থাকতে ভালোবাসেন। উপরে উল্লেখিত তিনটি ক্লাবে সেটি সম্ভব হয়েছিল আলাদা আলাদা কারণে। যেমন পোর্তোকে তিনি যে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন সেটি ছিল প্রত্যাশাতীত। সুতরাং, সর্বসের্বা হয়ে দল পরিচলনা করাটা মৌ’র জন্য কঠিন কিছু ছিল না। চেলসির দায়িত্বও যখন তিনি নেন, তখন চেলসি সবে ইউরোপের কুলিন সম্প্রদায়ের সদস্য হবার পথে। তাই সেখানেই কোনো সমস্যা হয়নি। আর ইন্টারে যখন তিনি যান, তখন এক সময়কার ইউরোপ কাঁপানো দলটি ধূসর এবং বিবর্ণ প্রায়। সে সময় মোরিনহোকে পাওয়া তাদের জন্য ছিল একরকম চাঁদকে হাতে পাবার মতন।
মোরিনহোর বিপক্ষে যে অভিযোগটি সবচেয়ে প্রচলিত, এবং সাবেক রিয়াল তারকা ইকার ক্যাসিয়াস যেটি বলেছেন মৌ দলের অন্দরে বিভাজন জিইয়ে রাখতে ভালোবাসেন; সেটি ইয়াকিন করা কিছুটা কঠিন। হ্যাঁ, আপনি যদি ক্যাসিয়াসের পরের সময়টুকু আমলে নেন তাহলে এটিকে আপ্ত বাক্য বলে ধরে নিতে বাধা নেই। কিন্তু তার আগের সময়গুলো একটু দেখা দরকার। এ মোরিনহোর অধীনেই কিন্তু নিজেদের বিশ্বসেরাদের কাতারে নিজেদের নিয়ে গিয়েছিলেন টেরি, ল্যাম্পার্ড, দ্রগবারা। দ্রগবা তো একাধিকবার তার ক্যারিয়ারে মৌ এর অবদান অকপটে স্বীকার করেছেন। আবার ইন্টারের সময়টাই খেয়াল করেন; পুরো দলটিই যেন এক সুতোয় বাধা ছিল। যার ফলাফল ঐতিহাসিক ট্রেবল। সুতরাং, কোন্দল জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটার বিষয়টি বিশ্বাস করা কঠিন।
সমস্যার জনম নিল কোথায় তাহলে? মেন্ডেসের তৎপরতায় বিশাল অংকের পারিশ্রমিকে ইন্টারে সোনালি সময়েই রিয়ালে আগমন তার। এখান থেকেই সমস্যাটার শুরু। যেটি তিনি এখনো এহসাস করতে পেরেছেন বলে ইয়াকিন করা কঠিন। আগের তিন ক্লাবের সাথে ইতিহাস ঐতিহ্যে রিয়ালের ব্যবধান আকাশ পাতাল। রিয়ালের যে ইতিহাস তাতে বর্তমানে কোনো ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নেয়া অসম্ভব। মৌ পয়লাবারে মতন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর রিয়ালে যেটা হয়েছিল; সেখানে তিনিই সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন না; স্কোয়াডটি ছিল তারকায় ভরা। এর আগেও মোরিনহো নিজের খেয়াল মত খেলোয়াড় খেলিয়েছেন কিন্তু সেগুলো খুব বেশি আলোচনা-সমালোনার জনম দেয়নি কারণ পুরো দ্যুতিটাই ছিল মোরিনহোময়। কিন্তু ক্যাসিয়াস, কাকাদের বসিয়ে দিয়ে সম্পুর্ণ একটি ভিন্ন পরিস্থিতিই দেখলেন তিনি। কাকার জনপ্রিয়তা তখন বিশ্বজোড়া, ইকার তো রিয়ালেরই প্রোডাক্ট। এই অবস্থায় নিজের অনভিজ্ঞতায় মৌ পরিস্থিতিকে করে তুললেন আরো জটিল। কাকা এবং ইকার’র পরিস্থিতি যে নাজাকাতের সাথে সামাল দেয়ার কথা ছিল, সেটি মাথা ঠাণ্ডা রেখে সামাল দেয়ার বদলে তিনি জড়ালেন বিবাদে। এখানে দুটো বিষয় মোরিনহোর বিপক্ষে গিয়েছে; পয়লাবার তিনি এমন একটি ক্লাবের দায়িত্বে ছিলেন যাদের ইতিহাসের সামনে তিনি শুধুই একটি নাম ছিলেন; আর দ্বিতীয়ত, খেলোয়াড় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নিজের খেয়ালের বদলে সমর্থকদের তরফ থেকে আসা চাপ সামলানোর অভিজ্ঞতাও তার হয়েছিল পয়লাবার। নিজে যেমন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারেননি, সেটির প্রভাব আচরনে পরায় স্থির থাকার বদলে বোর্ড-খেলোয়াড়-মিডিয়ার সাথে বসচায় জড়িয়ে মুদ্রার একদমই উল্টো পিঠ দেখলেন পয়লাবার।
ব্লাঙ্কোস থেকে বরখাস্ত হয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলেন। তিনি পয়লাবার যখন চেলসি থেকে বিদায় নেন, শুরুতে যেমনটা উল্লেখ করেছিলাম; চেলসি তখন সবে কুলিন সম্প্রদায়ের সদস্য হবার প্রচেষ্টারত। কিন্তু এরপর যখন ফিরে গেলেন; ততদিনে চেলসি ইউরোপ সেরার স্বাদ পেয়ে গিয়েছে। দল থেকে তারকা জন্ম দেবার বদলে তারকায় ভরা দল। ফলাফল? চেলসিতেও যেন নয়া নওবাত দেখলেন তিনি। বদলে যাওয়া চেলসির সমর্থকরা রক্ষণাত্মক ভঙিমায় সফল হবার বদলে বুক চিতিয়ে লড়াইরত যোদ্ধাদের দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। যার ফলে চেলসিতে পয়লা সমালোচনার মুখে পরলো তার খেলার ধরণ। যতবারই সমালোচনার বীজ চাড়ায় পরিণত হয়েছে; তখনই মোরিনহো হারিয়েছেন পেশাদার কোচের কারিনা। মর্জির ওপর নির্ভর করে চলা এই আদমি মনের অজান্তেই যেন শত্রুতে পরিণত করা শুরু করলেন খেলোয়াড়-বোর্ড-সাংবাদিকদের। ফলাফল? আবারো বরখাস্ত!
পরপর দুটো ঘটনার রেশ ধরে অনেকেই ভেবেছিলেন ইউনাইটেডে গিয়ে বোধহয় বদলাবেন তিনি। তা যে হয়নি তা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। মৌ আসার পরেই ইউনাইটেড মোটা অংকে দলে ভিড়িয়েছিল পগবাকে। ঝামেলায় জড়ানোর জন্য মোর মনে ধরল পগবাকেই। এর পর শুধু নয়া নয়া নামই যুক্ত হয়েছে; যার শেষটা হয়েছে বোর্ডের এক উর্ধতন কর্তার সাথে বিবাদে জড়িয়ে। স্যার অ্যালেক্স পরবর্তী যুগে বিস্ময়কর হলেও সবচেয়ে সফল কিন্তু মোরিনহোই। কিন্তু তাহলে এই তিক্ততা কেন? ইউনাইটেড ব্রিটিশ রাজের অন্যতম সফল ক্লাব। আর তাদের ইতিহাস ঐতিহ্যও বেশ সমৃদ্ধ। এসব ক্লাবে যা হয়; শুধু শিরোপাই সমর্থকদের সন্তষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়। এখানে তারকাদেরও খেলাতে জানতে হয়, খেলা দিয়ে জয় করে নিতে হয় সমর্থকদের মন।
মোরিনহো যা এখন এক মৃতদেহই বলা যায়, তা জল, বাতাস, রৌদ্র ও সকলপ্রকার কীট-বীজাণুকে যে প্রতিরোধ করতে পারত তার সাক্ষ্য ইতিহাসই দেয়। কিন্তু পচন এবার ধরল বোধয়। এর পিছনে সবচেয়ে বেশি যেটি কাজ করেছে সেটি তার এহসাসে সমস্যা। তিনি যেমন পোর্তো আর অতীতের চেলসির সাথে ইউনাইটেড এবং মাদ্রিদের মুখতালিফটা অনুধাবন করতে পারেননি। আর যদি পেরে থাকেন, তাহলে বলতে হয় সেটি আমলে নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। যার ফলে এক সময়কার প্রতিদ্বন্দি পেপ গার্দিওলা যেখানে প্রবল প্রতাপের সাথে এগিয়ে চলেছেন তখন মো পরিণত হচ্ছেন পচনে ধরা এক দেহে।
তবে, আমার কেন যেন মনে হয় এখানেই তার যতিচিহ্ন একে দেয়াটা হবে বোকামি। কেননা, এই আদমি যেমন গোয়ার্তুমিতে ডুবতে পারেন, তেমন ডুবন্ত অবস্থা থেকে আশ্চর্য আজমাতের সাথে পুরো পরিস্থিতিই বদলে দিতে পারেন। এই বরখাস্তটা বরং তার সামনে সুযোগ করে দিয়েছে পুরো পথ পরিক্রমাটা পরখ করে নয়া তাবদির খোজার। সেটা যদি করতে পারেন, আর তার সাথে যদি যোগ করতে পারেন এত বছরের প্রজ্ঞা; পুনরায় যে মোরিনহো বন্দনা হবে না, তা কে বলতে পারে? এটুকু বলেই থমকে যেতে হচ্ছে, মোরিনহোর ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার চরম অনীহার কারণে।
তবে, আপাতত এটাই সত্য যে; যে দেহটির মরণ রিয়ালে ঘটার পরেও অক্ষত ছিল; তাতে এখন পচন ধরতে শুরু করেছে। এখন পূর্ণজন্ম নিবেন, নাকি নিজের খেয়ালে ইতিহাসের পাতায়ই রয়ে যাবেন সেটির ফয়সালা এখন তার হাতেই। বাস্তবতা হচ্ছে; স্পেশাল ওয়ান এখন স্যাকড ওয়ান!