হিবা জান। দেড় বছর বয়সি ফুটফুটে এক কাশ্মিরি শিশু। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলো। বাইরে তখন তুমুল গুলিবর্ষণ আর প্রলয়ঙ্কারী তোলপাড় চলছে। শোপিয়ান জেলার কাপরান নামক মহল্লাটি ঘিরে রেখেছে ভারত সরকারের ‘সাহসী’ ফৌজিবাহিনির বেশ কয়েকটি সশস্ত্র দল। এক পর্যায়ে তারা আতঙ্কিত মানুষের ঘরে প্রবেশ করে টিয়ার গ্যাস আর পেলেট গানের গুলি ছুঁড়া শুরু করলো। ঘরের ভেতরে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় হিবা জানদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল যখন, তখন তারা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। বন্দুক যেন তাক করাই ছিল, ঘর ছেড়ে বেরোনো মাত্রই পেলেট গানের গুলি এসে আঘাত করলো হিবা জানকে। তার মা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাকে গুলি থেকে বাঁচানোর জন্য, নিজেকে মেলে ধরেছিলেন বন্দুকের সামনে। কিন্তু তারও আগে হিবার চোখে আঘাত হানে কয়েকটি শক্ত প্লাস্টিকের বুলেট। একজন নিরুপায় মা, তার সন্তানকে নিজের বাহুতে রেখেও বাঁচাতে পারেননি পৃথিবীর এই অদ্ভূত পাশবিকতা থেকে। হিবা জান পৃথিবীর দিকে পূর্ণ চোখে তাকানোর আগেই তার ডান চোখটি হারিয়েছে, এবং ডাক্তারগণ বাম চোখের ব্যাপারেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
হিবার মা মুরসালা জান বলেন, যদি আমার জীবনের বিনিময়েও তারা আমার মেয়ের চোখটি রক্ষা করতো তাহলে আমি নির্দ্বিধায় নিজেকে বিলিয়ে দিতাম। কিন্তু তার চোখে নেমে আসা এই ঘোর অন্ধকার আমি কিভাবে সহ্য করবো! সে এমনকি নিজের ব্যাথার কথাটাও আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে, মুখ ফুটে বলতে পারেনা। সে জানেই মাত্র তিনটা শব্দ- বিস্কুট, মামা (মা), চোখ!
আমরা যারা বিভিন্ন মাধ্যমে পৃথিবীর নানান প্রান্তরে বসে হিবা সোনামনির রক্তাক্ত চোখ এবং তার অদ্ভূত সুন্দর মুখের উপর ছেয়ে আসা ঘন অন্ধকারকে দেখেছি, তাদের হৃদয়ে নিশ্চয় রক্তক্ষরণ হয়েছে। এটা ২৩ নভেম্বর ২০১৮-র ঘটনা। কাশ্মিরের চলমান অবস্থা এবং বিগত তিরিশ বছরের ইতিহাসকে অনায়াসেই চিত্রায়িত করা যায় হিবা জানের এই হৃদয়বিদারক কাহিনী কিংবা পুলওয়ামা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে যে সন্তানসম্ভবা নারী শ্রীনগরের হাসপাতালে যাচ্ছিলেন, তল্লাশির নামে মৃত্যু পর্যন্ত পথেই আটকে রাখা হলো যাকে, তার আলোচনার মাধ্যমে আমরা আরও একটি বিশেষ প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই— কাশ্মিরের যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের জীবনযাত্রা এবং প্রতিরোধ-সংগ্রামে তাদের ভূমিকা।
কাশ্মিরের নারীগণ তাদের স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের দ্যুতি আর অতুলনীয় দৈহিক সুষমার জন্য এতদিন যাবৎ দুনিয়াজুড়ে সমাদৃত ছিলেন এবং এখনও আছেন। মধ্যযুগের ইউরোপীয় পর্যটক মার্কো পোলো এবং মুসলিম ভুগোলবিদ ইয়াকুত আল হামাভী তাদের বইয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তবে যুগযুগ ধরে চলমান সীমাহীন জুলুমের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ-সংগ্রাম তাদেরকে আরও একটি গৌরবময় পরিচয় দান করেছে— বীরাঙ্গনা!
যেকোন যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন প্রথমত নারী ও শিশুগণ। তাদের এই সঙ্কট বহুমুখী এবং গভীর। বিশেষত কাশ্মিরের মতো ভূমিতে, যেখানে যুদ্ধটা মূলত একপেশে ও অনেকাংশেই কৌশলগত এবং যেখানে মোট জনসংখ্যার সমান সংখ্যক সশস্ত্র ফৌজি মোতায়েন করা হয়েছে, যেন মানুষের মগজ পর্যন্ত দখল করে ফেলা যায়!
যেকোন যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন প্রথমত নারী ও শিশুগণ। তাদের এই সঙ্কট বহুমুখী এবং গভীর। বিশেষত কাশ্মিরের মতো ভূমিতে, যেখানে যুদ্ধটা মূলত একপেশে ও অনেকাংশেই কৌশলগত এবং যেখানে মোট জনসংখ্যার সমান সংখ্যক সশস্ত্র ফৌজি মোতায়েন করা হয়েছে, যেন মানুষের মগজ পর্যন্ত দখল করে ফেলা যায়! যেন কেউ ভিন্ন কিছু এমনকি চিন্তাও না করতে পারে!
কাশ্মিরে শক্তিশালী এবং কার্যকরী সশস্ত্র প্রতিরোধ একপ্রকার অসম্ভবই বলা চলে। প্রথমত, কাশ্মির চারদিকে শত্রুবেষ্টিত সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ একটি ভূমি, এবং বাকি পৃথিবী তাদের এই মরণাপন্ন সঙ্কটের ব্যাপারে নিতান্তই উদাসীন! ফলে বাইরে থেকে যথাযথ সাহায্য পাবার সামান্য আশাটুকুও নাই। দ্বিতীয়ত, সাত লক্ষ সশস্ত্র ফৌজিবাহিনীর সাথে কোনরকম লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সামান্য ক্ষমতাও মজুদ নেই তাদের কাছে। যা আছে তা হলো, বুকভরা সাহস, দূর্বার স্বপ্ন, শত্রুমুক্ত স্বাধীন একটি মাতৃভূমির জন্য সুতীব্র আকাঙ্খা এবং অসুরিয় জুলুমের নাগপাশ ছিন্ন করে অসীম নিলীমায় ডানা মেলে উড়বার অবাধ ‘আযাদি’!
ফলে সংগ্রাম থেমে নেই! সর্বাত্মক প্রতিরোধ সদা জাগ্রত! জীবনের মধুরতম বসন্তে এসে এই ভূস্বর্গের উপত্যকা আর উদ্যানসমূহে হেসে খেলে বেড়ানোর কথা ছিল যে সম্ভাবনাময় তরুণের, আযাদির তুমুল আহ্বানে সেই নির্ভয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং এক অসম যুদ্ধের ময়দানে নেমে গিয়ে শাহাদাতকে বরণ করে নিচ্ছে হাসিমুখে! এই ডিসেম্বর মাসেই আমরা দেখেছি দুই কিশোর শহীদকে— শাকিব এবং মুদ্দাসির। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তারা হাতে অস্ত্র নিয়েছে এবং শাহাদাত বরণ করেছে। এই মৃত্যুতে কোন আক্ষেপ নেই কারও, কেননা মৃত্যুও বিজয়! শাকিবের মা বলেছেন, ছেলের মৃত্যুতে আমার কোন আফসোস নেই; তবে তারা ওর মাথাটা এভাবে থেতলে না দিলেও পারতো!
এই সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রাম সর্বব্যাপী! নিজনিজ অবস্থানে থেকে স্বাধীনতাকামী প্রতিটি কাশ্মিরিই এর অংশীদার। সেক্ষেত্রে নানান বিবেচনায় নারীদের অবস্থানকে আলাদাভাবে সামনে তুলে আনাটা জরুরি।
নব্বইয়ের মিলিটারি ইনসারজেন্সি শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে এটা কেবলই একটা সংখ্যাগত তথ্য, প্রকৃত সঙ্কট বুঝতে হলে আরও গভীরে যেতে হবে। কাশ্মিরে ধর্ষণকে সুপরিকল্পিতভাবে একটি কৌশলগত যুদ্ধাস্ত্র হিসেবেই ব্যাবহার করা হয়। ফলে ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতার সংখ্যা যেমন অধিক তেমনই এর প্রভাবও সুদূর প্রসারী
একজন নারীর সংগ্রাম বহুমাত্রিক এবং সুগভীর। কাশ্মিরি নারীদের আমরা দেখি, প্রথমত তাদের বিশাল একটি সংখ্যা সরাসরি রাষ্ট্রীয় যৌন সহিংসতার শিকার। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্য মতে, নব্বইয়ের মিলিটারি ইনসারজেন্সি শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে এটা কেবলই একটা সংখ্যাগত তথ্য, প্রকৃত সঙ্কট বুঝতে হলে আরও গভীরে যেতে হবে। কাশ্মিরে ধর্ষণকে সুপরিকল্পিতভাবে একটি কৌশলগত যুদ্ধাস্ত্র হিসেবেই ব্যাবহার করা হয়। ফলে ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতার সংখ্যা যেমন অধিক তেমনই এর প্রভাবও সুদূর প্রসারী। কেননা এর মাধ্যমে তারা মানুষের সম্মান ও মর্যাদার দূর্বলতম জায়গাটিতে আঘাত হানতে চায়, এবং প্রতিরোধের ময়দানে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন ও দূর্বল করে ফেলতে চায়। আমাদের উপমহাদেশীয় সভ্যতা ও সমাজে একজন ধর্ষিতা নারীর জীবন কতটা সঙ্কটময় উঠে সেটা খুব সহজেই অনুমেয়। সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে তার উপর নানান দূর্যোগ নেমে আসে। তিনি ক্রমশ অচ্ছুত হয়ে যেতে থাকেন সকলের কাছে। সুখের সংসার ভেঙে তছনছ হয়। এখান থেকেই শুরু হয় জীবনের অপর এক দূর্লঙ্ঘনীয় যাত্রা, অনেক সময়ই তিনি সে যাত্রায় একা, নিঃসঙ্গ! ব্যাতিক্রম উদাহরণও আছে প্রচুর,যারা এই সামাজিক সঙ্কটকে সম্মিলিত ভাবে মোকাবেলা করেছেন। উদাহরণ হিসাবে আমাদের সামনে আছে, কুনান-পুশপোরা নামক দুইটি গ্রামের সেই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। ১৯৯১ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতের অন্ধকারে অন্তত শ’দেড়েক নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। সেসব ধর্ষিতা নারীরা সংগ্রাম থেকে ছিটকে না পড়ে ন্যায়ের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বছরের পর বছর এই পাশবিকতার বিচার চেয়ে গেছেন। তাদের এই ন্যায় বিচারের জন্য সংগ্রামের প্রতি সম্মান জানিয়ে এখন ২৩ ফেব্রুয়ারিকে কাশ্মিরে নারী প্রতিরোধ দিবস (women resistance day) হিসাবে পালন করা হয়। এর মাধ্যমে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও বড় একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে!
একজন নারী কখনো মা হিসেবে, কখনো স্ত্রী হিসেবে কখনো বোন হিসেবে একটি নিষ্ঠুর যুদ্ধের নির্মম যাতনা ভোগ করেন। কখনো তাদের সন্তান, স্বামী বা ভাইকে চিরতরে হারিয়ে ডুবে যেতে থাকেন এক চিরস্থায়ী শোকের ঘূর্ণনে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষটিকে হারিয়ে শুরু হয় তাদের নতুন সংগ্রাম।
কিংবা সেই নারীর কথা ভাবা যাক, যিনি তার ‘কৌশলগত নিখোঁজ’ (systemically disappeared) সন্তান বা স্বামীর আগমনের পথ চেয়ে অন্তহীন অপেক্ষায় জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। এরকম ‘কৌশলগত নিখোঁজ’ মানুষের সংখ্যা দশ হাজারেরও অধিক। অনিশ্চিত অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকা সেইসব নারীদেরকে বলা হয় হাফ-মাদার এবং হাফ-উইডু। পারভিনা আহাঙ্গার নামক একজন নারী তাদেরকে নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তার নিজের এক সন্তান আঠারো বছর আগে ক্রিকেট খেলার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আর কোনদিন ফিরে আসেনি। সেই থেকে তিনি এই আন্দোলনের শুরু করেন। বর্তমানে তার সংগঠন APDP ( Association of Parents of Disappeared Persons in Jammu and Kashmir. ) এর কাজ হলো সেসব নিখোঁজ ব্যাক্তির তথ্যাবলি সংগ্রহ করা এবং তাদের অনুসন্ধান করা। পারভিনা ইতিমধ্যেই পৃথিবীর মানবাধিকারে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের আন্তরিক সমর্থন ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মাননায়ও ভূষিত হয়েছেন।
২০১০ এর ‘রক্তাক্ত বসন্ত’র পর অনেকেই সরাসরি রাস্তার আন্দোলনে নেমে আসেন, যা পরবর্তীতে ব্যাপকতা লাভ করে ২০১৬তে তরুণ কমান্ডার বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের পর, যখন সমগ্র কাশ্মিরজুড়েই পাঁচ মাসব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। বর্তমান সময়ে এসে উদ্ধত রাইফেলের সামনে পাথর হাতে দাঁড়ানো যুবকের পাশে তার মা বা বোনকেও দেখা যায়, নিয়মিতই!
খুব বেশিদিন আগেও কাশ্মিরের নারীরা প্রতিরোধের আন্দোলনে রাস্তায় নেমে আসেননি। মূলত ঘরের ভেতরে থেকেই সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। মুক্তিকামী সশস্ত্র যুবকদেরকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেয়া, খাবার ব্যাবস্থা করা, এবং সংবাদ আদান প্রদানের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন। যোদ্ধাদের উৎসাহ প্রদানে উদ্দীপনামূলক সঙ্গীত গাওয়াও ছিল তাদের অন্যতম কাজ। ২০১০ এর ‘রক্তাক্ত বসন্ত’র পর অনেকেই সরাসরি রাস্তার আন্দোলনে নেমে আসেন, যা পরবর্তীতে ব্যাপকতা লাভ করে ২০১৬তে তরুণ কমান্ডার বুরহান ওয়ানির শাহাদাতের পর, যখন সমগ্র কাশ্মিরজুড়েই পাঁচ মাসব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। বর্তমান সময়ে এসে উদ্ধত রাইফেলের সামনে পাথর হাতে দাঁড়ানো যুবকের পাশে তার মা বা বোনকেও দেখা যায়, নিয়মিতই! হাজারো নারী রাস্তায় নেমে এসেছেন। কখনো নিজে পাথর ছুঁড়ছেন, নতুবা সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন অক্ষম ঘৃণার একমাত্র অবলম্বনটুকু। স্কুল কলেজ ফেরত কোমলমতি কিশোরী ও তরুণীরা হাতে পাথর তুলে নিচ্ছে নির্ভয়ে। নারী প্রতিরোধের এই বিবর্তন বিস্ময়কর ও উদ্দীপনামূলক নিশ্চয়।
জুলুমের নাগপাশ যখন চারদিক থেকেই চেপে বসে,তখন নিরুপায় মানুষ জুলুম থেকে মুক্তির জন্য তার সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও পিছপা হয়না। স্বাধীনতা এমনই এক আকাঙ্খা, যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে। এর উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের কাশ্মিরি মা-বোনেরা। একজন মায়ের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ হলো তার সন্তানকে নিজ দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গিত করে দেয়া। কাশ্মিরি মায়ের তাদের ছেলেদেরকে সম্বোধন করেন, জানাঁ বলে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জানাঁ মানে কী? তিনি জানালেন, জানাঁ মানে কলিজার টুকরো।
নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় এই কলিজার টুকরো সন্তানকে তারা অনায়াসেই উৎসর্গিত করে দিচ্ছেন, আল্লাহর রাস্তায়। একজন শহীদের মা হিসেবে গর্ববোধ করার মতো মানসিক সামর্থ্য তারা অর্জন করেছেন বিস্ময়করভাবে! প্রতিনিয়তই এর অসংখ্য উদাহরণ আসছে আমাদের সামনে। সেই অনেকগুলো উদাহরণ থেকে দুইটা ভিডিওচিত্রের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
উত্তাল মঞ্চে দৃপ্তপদে উঠে আসছেন একজন মধ্যবয়স্কা নারী। উর্ধ্বে হাত ছুঁড়ে শ্লোগান দিচ্ছেন, আযাদি আযাদি। প্রথমে লাশের কপালে দীর্ঘ চুম্বন করলেন। তারপর একজন যোদ্ধার হাত থেকে রাইফেল নিয়ে শুন্যে ফায়ার করে গান স্যালুট জানালেন শহীদের প্রতি।
১. এবছরের মাঝামাঝিতে হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার সাদ্দাম পোদ্দার শাহাদাত বরণ করেছেন সাউথ কাশ্মিরের একটি এনকাউন্টারে। জানাজার জন্য প্রস্তুত তার লাশ রাখা হলো একটি উঁচু মঞ্চে। হাজারো মানুষের আযাদির শ্লোগানে মুখরিত পুরো এলাকা। সাদ্দামের সহযোদ্ধারা শূন্যে ফায়ার করে গান স্যালুট জানালেন তার প্রতি। তখন আমরা দেখি উত্তাল মঞ্চে দৃপ্তপদে উঠে আসছেন একজন মধ্যবয়স্কা নারী। উর্ধ্বে হাত ছুঁড়ে শ্লোগান দিচ্ছেন, আযাদি আযাদি। প্রথমে লাশের কপালে দীর্ঘ চুম্বন করলেন। তারপর একজন যোদ্ধার হাত থেকে রাইফেল নিয়ে শুন্যে ফায়ার করে গান স্যালুট জানালেন শহীদের প্রতি।
তিনি সদ্য শহীদ হওয়া সাদ্দামের মা। শোকে দুঃখে মূর্ছা যাননি। সব কষ্ট বুকে চেপে তিনি এসেছেন সন্তানের শাহাদাতকে উদযাপান করতে। মাইক হাতে নিয়ে সমবেত মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ কুরবানি পেশ করেছি, এবার তোমরাও করো!
২. এই ভিডিও চিত্রটিতে আমরা দেখি, কয়েকজন সেনাসদস্য একটি পরিবারের কাছে গিয়েছেন। এ পরিবারের এক যুবক সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সেনা সদস্যদের দাবি হলো, আপনারা আপনাদের সন্তানকে ঘরে ফিরে আসতে বলুন, নতুবা সে আমাদের হাতে মারা পড়বে। সে হয়তো না বুঝে ভুল পথে পা বাড়িয়েছে, তাই সময় থাকতে ফিরে আসতে অনুরোধ করুন।
এ কথার পর নেক্বাবে ঢাকা একজন জননীর মুখ থেকে যে জবাব আসে তা হলো – আমরা কখনোই তাকে ফেরত আসতে বলবোনা। যে পথে সে বেরিয়েছে সে পথই সঠিক, বরং তোমাদের লজ্জিত হওয়া উচিৎ নিরীহ মানুষের উপর অস্ত্র চালানোর জন্য। আমার সন্তান যদি যুদ্ধ থেকে শহীদ না হয়ে পালিয়ে ঘরে ফিরে আসে তাহলে আমি নিজে তার গলা কেটে শহীদ করে দেবো।
হতভম্ব সেনাদের মুখে আর কোন কথা জোগায়নি। মাথা নিচু করে প্রস্থান করেছে তারা।
এই দুইটি ঘটনা পুরো দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তরে চলমান দখলদারিত্ব, শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইরত মানুষের সংগ্রাম ও মুক্তির আকাঙ্খাকে নতুন করে সজ্ঞায়িত করছে যেন। কাশ্মিরের নারীগণ সংগ্রামী মনোভাব আর মানবিক দৃঢ়তার এই উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেছেন। আমেরিকান মজলুম কালোদের নেতা মরহুম ম্যালকম এক্স বলেন, তুমি যদি স্বাধীনতার জন্য মরতে প্রস্তুত না থাকো তাহলে এই শব্দটা তোমার জন্য না।
একটি মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাশ্মিরের জনমানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বছরের পর বছর ধরে এক সুদীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এর জন্য তারা সর্বোচ্চ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। সুতরাং এই সংগ্রামে তাদের পিছিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই, কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হওয়া পর্যন্ত। সুযোগ নেই হতোদ্যম হয়ে বসে পড়ার। অবিরাম লড়াই এবং লড়াই’র একমাত্র পথ। বহু প্রাণের বিনিময়ে এই কঠোর সত্য কাশ্মিরিরা অনুধাবন করতে পেরেছেন আরও বহু আগেই। চূড়ান্ত আযাদির এই মহান সংগ্রামে কাশ্মিরের নারী-পুরুষ সকলেই সমানভাবে শামিল। সকলের আত্মত্যাগ আর মিলিত সংগ্রামের পথ ধরেই একদিন ভূ-স্বর্গে উড়বে আযাদ কাশ্মিরের সার্বভৌম পতাকা। আর এইসব বীরাঙ্গনা মা-বোনদের ইতিহাসও পৃথিবীর প্রতিটি মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষ পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে যুগযুগ!