চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পেপের ব্যর্থতার কারণ!

চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পেপের ব্যর্থতার কারণ!

পেপ গার্দিওলার জন্ম ১৯৭১ সালে ১৮ জানুয়ারি স্পেনের স্যান্টপেদর শহরে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হয়নি পেপের। তবে ফুটবলের প্রতি অদম্য ভালোবাসা ও কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে মাত্র ১৯ বছর বয়সে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার মূল দলে খেলার সুযোগ পান তিনি। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে বার্সার ‘স্বপ্নের দল’ এ গার্দিওলা অন্তর্ভুক্ত হন। বার্সার ড্রিম টিমের হয়ে ১৯৯১-৯২ মৌসুমের লা লিগা এবং ইউরো কাপ জয় করেন। পরের দুই মৌসুমেও বার্সেলোনা লা লিগার শিরোপা জিতে নেয়। বার্সেলোনা ১৯৯৪-৯৫ এবং ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে লা লিগায় যথাক্রমে চতুর্থ ও তৃতীয় স্থানে থেকে লিগ শেষ করে। তখন বার্সার কোচ হিসেবে যোগ দেন ববি রবসন। ববি রবসন বার্সেলোনাকে কোপা দেল রে, স্প্যানিশ সুপার কাপ এবং ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ শিরোপা পাইয়ে দেন। ১৯৯৭ সালে বার্সেলোনার অধিকাংশ ক্লাব ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গার্দিওলা বার্সেলোনার অধিনায়ক হন। কিন্তু চোটের কারণে তাকে পুরো মৌসুম মাঠের বাইরে থাকতে হয়। এ সুযোগে অনেক দল তাকে কিনতে চাইলেও বার্সেলোনা সেসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। বরং বার্সা পেপ গার্দিওলার সাথে ২০০১ সাল পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়ায় কিন্তু ইনজুরি বারবার হানা দেওয়ায় ২০০১ সালে ১৭ বছর পর বার্সেলোনা ছাড়ার ঘোষণা দেন পেপ।

পেপ আবারও ফিরে আসেন বার্সায়। তার কোচিং ক্যারিয়ার শুরু হয় বার্সেলোনা ‘বি’ দল দিয়ে। ২০০৭ সালে বার্সেলোনা তাকে ‘বি’ দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১ বছর পরেই বার্সেলোনার মূল দলের কোচ হন তিনি। গার্দিওলা ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনায় কোচ থাকাকালীন সম্ভাব্য সব শিরোপা জয় করেছেন। লা লিগা, কোপা দেল রে, স্প্যানিশ সুপার কাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কোনোটাই বাদ যায়নি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে এক মৌসুমে গার্দিওলার বার্সা ৬টি শিরোপা জয় করে যার মধ্যে ছিলো লা লিগা, কোপা দেল রে, চ্যাম্পিয়নস লিগ, স্প্যানিশ সুপার কাপ, ইউরোপিয়ান সুপার কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপ। ২০১৩ সালে গার্দিওলা জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হন। বায়ার্নের কোচ থাকাকালীন গার্দিওলা বায়ার্নকে বুন্দেসলিগার হ্যাটট্রিক শিরোপা জিতিয়েছেন। বায়ার্নে ৩ মৌসুম কাটিয়ে হ্যাট্রটিক শিরোপা জেতানোর পর গার্দিওলা ম্যানচেস্টার সিটির কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৬ সালে যোগ দেওয়ার পর প্রথম মৌসুমে কোনো শিরোপা না জিতলেও দ্বিতীয় মৌসুম অর্থাৎ সর্বশেষ মৌসুমে ম্যানসিটিকে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা এনে দিয়েছেন তিনি।

বার্সেলোনায় চার মৌসুম দায়িত্ব পালনকালে গার্দিওলা দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাসহ ১৪টি ট্রফি এনে দিয়েছিলেন। এরপর বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দেয়ার পর তিন বছরে তিনি ৭টি শিরোপা এনে দেন। ম্যানচেস্টার সিটিতে প্রথম বছর সফল না হলেও ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে রেকর্ড ভেঙ্গে ১০০ পয়েন্ট অর্জন করেছেন তিনি। কিন্তু বার্সেলোনা ছাড়ার পর এখনো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জেতা থেকে বঞ্চিত বিশ্বের অন্যতম সেরা এই কোচ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে স্প্যানিশ এই কোচের সেরা সাফল্য সেমি ফাইনাল পর্যন্ত। কেন এখানেই থেমে যান পেপ?

২০১১-১২ মৌসুমে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলেন পেপ, দল বিদায় নেয় সেমি ফাইনাল থেকে, চেলসির কাছে ৩-২ ব্যবধানে হেরে। বার্সেলোনা ছাড়ার পর ২০১২-১৩ মৌসুমে নিজেকে বিশ্রামে রেখেছিলেন এই কোচ। ২০১৩-১৪ মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি ফাইনালে বেশ ভরাডুবি হয় গার্দিওলার। দল রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ৫-০ গোলের ব্যবধানে হেরে লিগ শেষ করে। ২০১৪-১৫ মৌসুমে গার্দিওলা হেরে যান তার পুরনো শিষ্যদের কাছে। এবারও সেমিফাইনাল থেকে তার দল বিদায় নেয় বার্সেলোনার কাছে ৫-৩ গোলের ব্যবধানে হেরে। ২০১৫-১৬ মৌসুমে ফাইনালের কাছাকাছি পৌঁছেও অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে অ্যাথলেটিকো বিলবাওর কাছে ২-২ ব্যবধানে হেরে বিদায় নেয় বায়ার্ন। ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৬-১৭ মৌসুমে রাউন্ড ১৬ থেকেই বিদায় নিতে হয় পেপকে। ২০১৭-১৮ মৌসুমে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে লিভারপুলের কাছে ৫-১ গোলের ব্যবধানে হেরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের যাত্রা শেষ হয় পেপের ম্যানচেস্টার সিটির।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট ম্যাচগুলোয় গার্দিওলার রেকর্ড তার ক্যারিয়ারের শক্তির জায়গা নয়। গার্দিওলা মানেই সাফল্যের গ্যারান্টি নয়। তবে সাত মৌসুম কাজ করে পাঁচ মৌসুমেই ঘরোয়া লিগ জেতানো এই কোচের শক্তির জায়গা হচ্ছে একটা দলের কৌশলগত উদ্ভাবনের জায়গা নিয়ে কাজ করা, এ কারণেই খেলোয়াড়দের কাছে তার আসনটা শ্রদ্ধার। তার অন্তর্দৃষ্টি, শেখানোর ক্ষমতা— সব কিছু নিয়েই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বের অন্যতম চাহিদাসম্পন্ন কোচ হিসেবে। বায়ার্নে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করার পরপরই বেশ হাইপ তৈরি হয় গার্দিওলাকে নিয়ে। সবকিছুই ঠিক-ঠাক ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত সেমি ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখ রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হয়নি। স্প্যানিশ ক্লাবটির কাছে হেরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বিদায় নিতে হয় পেপের বায়ার্নকে। পেপ বর্তমানে অন্যতম সেরা একজন কোচ, সন্দেহ নেই। তিনি বিশ্বের সেরা কোচ কি না, এটা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। তবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় না করার অন্যতম কারণ তিনি প্রতিপক্ষ হিসেবে যাদের পেয়েছেন তারা সামর্থ্যে পেপের কাছাকাছি কিংবা তার দলের চেয়েও অপেক্ষাকৃত ভালো। এমন একটা টুর্নামেন্টে কেবলমাত্র একটা লেগের ব্যর্থতা দলকে পুরো টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দিতে পারে। বার্সেলোনা ছাড়ার পর বায়ার্ন ও ম্যানসিটিকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পেপ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন বেশিরভাগ সময়। তার দলকে দুই লেগের মারপ্যাঁচে পড়ে টুর্নামেন্ট থেকে হতাশাজনকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। তাছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এমন একটা প্রতিযোগিতা যেখানে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছানো যে কোনো দলই শিরোপা জেতার মতো সামর্থ্য রাখে। সেক্ষেত্রে কোচের তেমন কিছুই করার থাকে না। সামর্থ্য ও কৌশলে প্রত্যেকটি দলই একজন আরেকজনকে টপকে যাওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সবচেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতা। প্রত্যেকটি দল এই ট্রফি জেতার জন্য মুখিয়ে থাকে। নিজেদের সেরা কেবল কোচকে নয়, দলের প্রত্যেকটা সদস্যকে দিতে হয়। গোলকিপারকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়, দলের ডিফেন্সকে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার মতো শক্তিশালী হতে হয়। সবকিছুই নিজেদের অনুকূলে থাকতে হয়। ভুল ট্যাকেল, ডিফেন্সের সামান্য ভুল দলকে ছিটকে দিতে পারে এমন বড় আসর থেকে। পেপ নিজের দলকে সঠিকভাবেই পরিচালনা করেছেন। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল না। পেপ কঠোর পরিশ্রমী ও কৌশলী। কিন্তু পেপ প্রায়ঃশই তার খেলার ফর্মেশন পরিবর্তন করেন। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে ফর্মেশন পরিবর্তনের ফলে খেলোয়াড়রা খাপ খাওয়াতে পারেন না। কারণ তারা ওই ফর্মেশনে খেলতে অভ্যস্ত নয়। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অ্যাওয়ে ম্যাচগুলো খেলার জন্য দলকে সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে প্রতিপক্ষকে লড়তে হয়। একে তো প্রতিকূল আবহাওয়া, অন্যদিকে ফর্মেশন পরিবর্তনের কারণে খেলোয়াড়রা স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারে না। অনেকেই লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যানচেস্টার সিটির চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে হেরে বিদায় নেওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে পেপের এই সিদ্ধান্তকে দায়ী করে।

পেপ গার্দিওলা বেশ কৌশলী একজন কোচ। বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন কোচ হওয়ায় তার প্রতি প্রত্যাশার পারতও আকাশচুম্বী। বার্সেলোনা ছাড়ার পর পেপের আক্ষেপের নাম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এই অধরা শিরোপাকেও খুব শীঘ্রই মুঠোবন্ধি করবেন পেপ, নিঃসন্দেহে।