বিজেপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। এই জন্য তাদেরকে অনেক কাল অপেক্ষা করতে হয়েছে ক্ষমতার মূলস্রোতে সামিল হতে। সেই ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২-তে ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিজেপির শক্তিমত্তার প্রমাণ দেয় দলটি। ব্রাহ্মণ-দলিত, জাতপাত, হিন্দু-মুসলিম ইস্যুতে ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির জনপ্রিয়তার পারদ বাড়তে থাকল এরপর থেকেই। অন্যদিকে কংগ্রেসের দীর্ঘদিন ক্ষমতা থাকার পরেও তাদের ব্যাড গভর্নেন্স সাধারণ জনগণকে বিজেপি-মুখি করে তোলে।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার মূল অভিযুক্ত নরেন্দ্র দমোদার দাস মোদি টানা তিনবার গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেশ নাম কামিয়েছেন। তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পোস্টারবয় তথা প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করা হয় নরেন্দ্র মোদিকে। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদির আবির্ভাবকে বোধহয় এই শব্দভেদীতে ব্যাখ্যা করা যায়। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবি নিয়েই তাঁর উদয় হয়েছিল ভারতের রাজনীতির ভাগ্যাকাশে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণী পেরোতে মোদির কাঁধেই চেপেছিল পুরো বিজেপি। গুজরাট মডেলকে সামনে নিয়ে সুযোগ্য মাঝির মতো বিপুল ভোটে জিতিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় ফিরিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৪-র ২৬ মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন গুজরাটের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। নতুন অধ্যায় তৈরি হয়েছিল ভারতের ইতিহাসে।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার মূল অভিযুক্ত নরেন্দ্র দমোদার দাস মোদি টানা তিনবার গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেশ নাম কামিয়েছেন। তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পোস্টারবয় তথা প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করা হয় নরেন্দ্র মোদিকে। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদির আবির্ভাবকে বোধহয় এই শব্দভেদীতে ব্যাখ্যা করা যায়।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার শুরু থেকেই নরেন্দ্র মোদির বিজয়রথ সারা দেশে ছুটে চলেছিল অপ্রতিরোধ্য গতিতে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠছিল ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের উপস্থিতি। ৫৪৩ সদস্যের লোকসভাতে কংগ্রেসের আসন ৪৪-এ বেঁধে দেওয়াতেই আটকে থাকেনি বিজেপি। ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’ গড়তে একের পর রাজ্যে উড়তে শুরু করেছিল গেরুয়া জয়ধ্বজা। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম— একের পর এক রাজ্য গিয়েছে বিধানসভা নির্বাচনে আর ততই শক্ত হয়ে ভারতের মাটিতে চেপে বসেছে বিজেপির খুঁটি। হরিয়ানা-হিমাচল-উত্তরপ্রদেশ-উত্তরখণ্ড-গোয়া এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সব রাজ্যে বিজেপি ও তার মিত্ররা ক্ষমতায় আরোহন করেছে।
গত পরশুর পাঁচ রাজ্যের ঘোষিত ফলাফলে উড়তে থাকা বিজেপির রথে অনেক বড় ধাক্কা। বিশেষত হিন্দি হার্টল্যান্ড বা হিন্দি বলয়ের ৩ রাজ্যে বিজেপির অবিশ্বাস্য পতন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের হতোদ্যম করে দিয়েছে। নির্বাচন পূর্ব জরিপ ও এক্সিট পোলে রাজস্থানে বিজেপির পরাজয় অনুমান করা গেলেও দীর্ঘ ১৫ বছর বিজেপির হাতে থাকা ‘হলিকাউ স্টেট’ মধ্যপ্রদেশ ও ছত্রিশগড় হাতছাড়া হবে তা ছিল কল্পনাতীত। মধ্যপ্রদেশের ২৩০টি আসনের মধ্যে সারারাত অনেক নাটকের পর কংগ্রেসের আসন দাঁড়ায় ১১৪ টি, বিজেপির—১০৯, ম্যাজিক ফিগার হচ্ছে- ১১৬। মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টির ২ আসন এবং কংগ্রেসের ৩ বিদ্রোহী প্রার্থীকে নিয়েই মধ্যপ্রদেশে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে কংগ্রেস।
ছত্রিশগড়ে বিজেপির লজ্জাজনক ভরাডুবি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। যেখানে বুথ ফেরত জরিপেও বিজেপির রমন সিংহ টানা চতুর্থবার মূখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন বলে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন সেখানে কংগ্রেস পেয়েছে ভূমিধ্বস বিজয়। ছত্রিশগড়ে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জিতে ১৫ বছর পর সরকার গঠন করতে যাচ্ছে কংগ্রেস।
মরু রাজ্য রাজস্থানে বিজেপি হারছে সেটা অনুমেয় ছিলো। মূখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজৈর সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে রাজস্থানের মানুষ নাখোশ ছিলেন। বিজেপি রাজস্থানের আগের অবস্থান ধরে রাখতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের একের পর এক র্যালিতে আরএসএস ও সমর্থকদের চাঙ্গাভাব সজাগ করে তুলেন। তারপরও বিজেপির এত কোশেশ হালে পানি পায়নি। ২০০ আসনের সংসদে ৯৯ টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে কংগ্রেসই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। মায়াবতীর বিএসপির-৬ এবং ৫ জন কংগ্রেস বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থন নিয়ে ২০১৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ২১টি আসন পাওয়া কংগ্রেস এবার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
গুজরাটে হারতে হারতে বেঁচে যাওয়া বিজেপি তার পার্শ্ববর্তী তিন রাজ্যে এ ভয়াবহ ভরাডুবি সামনের নির্বাচনে কেমনে সামাল দিবে তা চিন্তার অবকাশ রাখে বৈকি। এই তিন রাজ্যে ১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ৬৫টি আসনের মধ্যে বিজেপির কবজায় চলে গিয়েছিল ৬২ আসন। টানা ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে ভারতের ২৯ রাজ্যে কংগ্রেসের সরকার ছিলো মাত্র ৫টিতে তারমধ্যে বড় রাজ্য বলতে ছিলো পাঞ্জাব ও কর্নাটক। হিন্দি বলয়ের মধ্য ভারতের উপরোক্ত তিন প্রদেশে কংগ্রেসের বিস্ময়কর বিজয়ে কংগ্রেস অনেক মজবুত হয়েছে। কংগ্রেস তার হারানো ইমেজ ধীরে হলেও পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
এই বিধানসভার পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নাম দিয়েছিলেন আসন্ন জাতীয় লোকসভা নির্বাচনের ‘সেমিফাইনাল’ হিসেবে। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী দর্শনের মূল ঘাটি ছিলো এ হিন্দি বলয়। ২০১৪ এর লোকসভা নির্বাচনে মধ্য ভারত ও উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের ২২৫ আসনের মধ্যে বিজেপির হাতে আসে ২০৩ আসন। গেরুয়া দুর্গে হিন্দুত্ববাদের পোস্টারবয় মোদির হাত ধরে বিজেপি ধরাশয়ী হবে তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে ছিলো রীতিমতো অবিশ্বাস্য। কংগ্রেসের সুবর্ণ সময়েও বিজেপি এ অঞ্চলে এতটা অজনপ্রিয় হয়নি যতটা হয়েছে বরপুত্র মোদির হাত ধরে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বোদ্ধাদের দেখতে হলো মোদিও গেরুয়া দুর্গে হারতে পারে!
অন্যদিকে পাশ্ববর্তী দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি বিজেপি সরকারের আচরণ নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বেড়েছে। নিজেও যেমন বাকপটুতা দিয়ে এক উগ্র ফ্যাসিবাদি শাসন কায়েম করেছে মোদি সরকার একই মডেল পোক্ত করতে তারা সাহায্য করছে বাংলাদেশের অনির্বাচিত হাসিনা সরকারকে
সামনের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে মধ্য ভারতের এই ৩রাজ্যে পুনরায় ক্ষমতায় আরোহন আত্মবিশ্বাস যোগাবে। বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হওয়া ও মোদির রাফায়েল নিয়ে কমিশন নেয়ার গুরুতর অভিযোগ সামনের লোকসভা নির্বাচনে প্রবল প্রভাব ফেলবে। মোদি তার প্রতিশ্রুত ২ কোটি নতুন চাকরি দেয়া, কৃষিঋণ মওকুফ ও কালো টাকা ফেরত নিয়ে আসা কোনটাই করতে পারেননি। উপরন্তু গত পাঁচ বছরে ভারতে প্রায় দুই লাখ তিরিশ হাজারের মতো কৃষক আত্মহত্যা করেছে। বেকারত্বের হার বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি প্রতিশ্রুত অংকের চেয়ে ক্রমাগত নিম্নমুখী হয়েছে। ভারতের উন্নতি কেবল ছিল বুলিতে। চৌকশ বয়ানে জনগণকে কাবু করার এই খেলা এখন শেষ হতে চলেছে বলেই মনে হয়। অন্যদিকে পাশ্ববর্তী দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি বিজেপি সরকারের আচরণ নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বেড়েছে। নিজেও যেমন বাকপটুতা দিয়ে এক উগ্র ফ্যাসিবাদি শাসন কায়েম করেছে মোদি সরকার একই মডেল পোক্ত করতে তারা সাহায্য করছে বাংলাদেশের অনির্বাচিত হাসিনা সরকারকে।
তবে আশার কথা হল, গত নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হওয়া কংগ্রেস আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাও গেরুয়া দুর্গ খ্যাত মধ্য ভারত থেকে। ঐক্যজোট তৈরি করা ও রাহুলের প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার ঘোষণা কতটা সুফল বয়ে আনবে তা দেখতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে ক্রমশঃ ফ্যাকাশে হতে যাওয়া মোদি ম্যাজিক আসন্ন লোকসভাতে কাজ করবে বলে রাজনৈতিক বোদ্ধা মহল মনে করেন না। এমতাবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানো কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সর্ব ভারতীয় বিরোধী ঐক্যজোট একতাবদ্ধ হয়ে লোকসভার ‘চুনাও’ লড়ে তবে মহা প্রতাপশালী মোদির জন্য দিল্লির দরজা অব্দি পৌঁছানো অনেক দুষ্কর হয়ে পড়বে। তবে অসম্ভব মনে হচ্ছে না।