নিজের মা’কে মা ডাকে না,
শাশুড়ি হইলো আম্মাজান
বাপে হইলো তালই মশাই,
শ্বশুর হইলো বাপজান…
এ বিচিত্র চারটি বাক্যকে একটির পর একটি আলফাজ জুড়ে দিয়ে যিনি পূর্নাঙ্গ রুপ দিয়েছেন তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির তারিফ করা লাগে। ঠাট্টাচ্ছেলে বলা কথাগুলোর ওজন এবং তাৎপর্য সীমাহীন।
কায়ানাতের দুই প্রান্তে ক্রিকেটিয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে রত এক সময়কার প্রবল প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অপর প্রান্তে ভারত। উইন্ডিজ যেখানে বাংলাদেশের সাথে ইজ্জত রক্ষায় ব্যস্ত তখন কোহলি গং চোখ রাঙাচ্ছেন অজিদের। অবস্থানটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বহু চাপান উতর রয়েছে এর মধ্যে। তবে, এই যে নয়া নওবাত; এর পেছনের শুধু একটি দিক নিয়ে কথা বলব আমি।
লয়েড-রিচার্ডসদের ক্যারিবিয়ান ক্যালাপসিপোর তাল কেটে গিয়েছিল অনেক আগেই। শুধু ক্রিকেটই না যেকোনো খেলাতেই একটি পরাক্রমশালী প্রজন্ম যখন বিদায় নেয় তখন যে শূণ্যতার সৃষ্টি হয় তা কাটতে সময় লাগে অনেকটা। তাই, সোনালি সে প্রজন্মের বিদায়ের পর উইন্ডিজের শ্রী হরণ হলেও ইজ্জতটা টিকে ছিল। স্বদেশকে মায়ের সাথে প্রায়শ তুলনা করি আমরা। তো, মায়ের জায়গায় ‘আম্মাজান’ শাশুড়ি রুপে পয়লা হাজির হলো ভারত। শ্বশুর রুপে বিসিসিআই। আর তাদের লাস্যময়ী কন্যা আইপিএল। এই ত্রয়ীর তৎপরতায় শ্রী এর সাথে হ্রীও হারিয়ে উইন্ডিজ এখন পরিণত হয়েছে হতশ্রী এক দলে। এটুকু যদি লেখকের খেয়ালি মনের খেয়াল ঠেকে অপেক্ষার অনুরোধ করবো। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হবে সবই।
পয়সা নামক পরমারাধ্য নিয়ে উইন্ডিজ খেলোয়াড়দের সাথে বোর্ডের বসচা পয়লা প্রকাশ্যে দেখা যায় ‘০৯ সালে বাংলাদেশ সিরিজের আগে। স্বদেশের বোর্ড অর্থাৎ বাজানের তাৎক্ষণিক তৎপরতায় সাময়িকভাবে সে অবস্থা সামাল দেয়া গেলেও পরে আর সেটি সম্ভব হয়নি। কারণ, ততদিনে বিসিবি, সিএ, পিসিবিসহ আরো অন্যান্য বোর্ডও তাদের লাস্যময়ীদের প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এক প্রেয়সীর সাথে পরিণয়েই যখন এত লাভ তখন বাকিদেরই বা উপেক্ষা কেন? মাঝে মধ্যে ভদ্রস্থ শব্দ ব্যবহারে মনের সঠিকভাবটা প্রকাশ পায় না। তাই একটু গায়ের শব্দের ঝুকতে চাই। কোনো লাস্যময়ীর আবেদনই উপেক্ষা না করে ক্যারাবিয়ানরা ‘হাঙ্গা’ করে বসলেন বাকিসব লাস্যময়ীদের সাথে। তাতে মা তথা স্বদেশ আর বাজান বোর্ডের হালত কি হল তা যেন ভাবতেই বয়ে গেল খেলোয়াড়দের।
ফলশ্রুত হিসাবে আমরা কি দেখছি? ক্যারাবিয়ানরা যখন বাংলাদেশের মাটিতে খাবি খাচ্ছে তখন দলের মূল তারকারা; যাদের বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করার দায়িত্ব নিয়েছিল দেশ এবং বোর্ড তারা স্বদেশের জার্সির বদলে সমানে খেলে বেড়াচ্ছেন টি-টেন, টি টোয়েন্টির এর মতন লিগ! গেইল, রাসেল, নারিন, পোলার্ডকে নেই সেখানে? হ্যাঁ, এটা সত্য যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ একটি দেশ নয়, বরং বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপরাস্ট্র এই নামে একত্রিত হয়ে ক্রিকেট খেলে থাকে। কিন্তু, এই রেওয়াজ তো নয়া কিছু না। সুতরাং, বিচ্ছিন্নতার বিরুপ প্রভাবে এ হালত এটি বলারও জো নেই।
আপনি যদি সাদা চোখে দেখেন; তাহলে আমার প্রতি ক্ষুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। যে আসরটি সকল খেলোয়াড়ের আরাধ্য; নিশ্চিত করছে ভালো রুজির তার বিপক্ষে অবস্থান নেয়াটা কঠিনই। কিন্তু, আপনি যদি নির্মোহ নজরে দেখেন তাহলে দেখবেন এই আইপিএল এর আগমনের পরে মায়ের বদলে শাশুড়ি হয়ে গিয়েছে ‘আম্মাজান’। নতুবা দেশের হয়ে খেলার চেয়ে শিশুতোষ টি-টেন আরাধ্য হয়? মজার বিষয় হচ্ছে শাশুড়ি কিন্তু নিজের মেয়ের খেয়াল ঠিকই রাখছে। এক আইপিএল ভিন্ন অন্য কোনো দেশের ঘরোয়া লিগে দেখা যায় না ভারতের কোনো খেলোয়াড়কে।
রুপক থেকে বের হয়ে একটু বাস্তবতার জমিনে ফিরি। আমার শ্রদ্ধেয় গুরু জলিসুর রহীম স্যারের সাথে একদিন কথা হচ্ছিল। কথাচ্ছলে স্যার বললেন, কাউকে শেষ করার সব চেয়ে সহজরুপ কোনটা বল? আমি বলেছিলাম জানে মারা। তখন, স্যার সহাস্যে বলেছিলেন তাতে মজা কই? কাউকে যদি চিরতরে শেষ করতে হয় তার আরামের এমন বন্দোবস্ত কর যেন সে অকেজো হয়ে পড়ে।
ব্যাখ্যাটা স্যার নিজেই করেছিলেন। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে এখন ঠিকমতন হাটাচলা করতে পারেন না। শরীরে নানাবিধ অসুখের বাস। বললেন, এই আমিই এক সময় মাঠ দাবড়ায়ে বেড়াইছি। তো, পোলাপান বলল, আপনি গুরু মানুষ; আপনি দৌড়াদৌড়ি করলে কেমন দেখায়? আমরা আপনার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা কইরা দিচ্ছি। আপনি শুধু বসে বসে আদেশ দিবেন। ঐ যে বসলাম, এখন আর দাড়াইতে পারি না। এখানে ক্রিকেটের সম্পর্কটা কোথায়?
স্যার মাঠেই কাটিয়ে দিয়েছেন কয়েক দশক। ছাত্রাবস্থা থেকেই ক্রিকেট শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি। সুতরাং, ক্যারাবিয়ানদের সোনালি সময়, তার পতন; ভারতের আগম, সব কিছুই নিজ চোখে দেখেছেন তিনি। বললেন এই যে আইপিএল; এইখানে খেলে যে টাকাটা পাওয়া যায় সেইটা যৌক্তিক? বিষয়টা কী তাইলে? ভারত নানা কায়দায় চেষ্টা করেও যখন ক্রিকেটের সমীহ জাগানিয়া কোনো শক্তিতে পরিণত হইতে পারল না, তখন এই আইপিএলটারে কাজে লাগালো। টেস্টের মতন কঠিন খেলা খেইলা যা কামানো যায়, পাঁচ দিন টি টোয়েন্টি খেইলাই যদি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কামানো যায় তাইলে সমস্যা কি? ওরা টোপটা দিল টাকা দিয়া। আমি যেমন চেয়ারে বইসা শরীরটারে বাতিল করছি, খেলোয়াড়রা টাকার পিছে ছুইটা নিজেদের শেষ করতেছে। এখনো যারা টি টোয়েন্টি বড় নাম তারা কিন্তু আগের মতনই প্রথম শ্রেণীর পরীক্ষা পাস কইরা আসা। শুধু টি টোয়েন্টি যুগ কিন্তু এখনো বড় কোনো তারকা দেয় নাই। খেলোয়াড়রা স্কিলের চেয়ে বেশি ঝুকলো পাওয়ার হিটিং এ। ঐদিকে বাকি বোর্ড গুলাও বইসা থাকবে কেন? সব মিলায়া টাকার মচ্ছবে খেলোয়াড়রা হুতাশে ঘুরতেছে। ভারত কিন্তু নিজ জায়গায় ঠিক। কোনো খেলোয়াড়কেই বাইরের টি টোয়েন্টি খেলতে দেয় না। এখন, ভারতের র্যাংকিং খেয়াল কর!
স্যারের যোগ্যতার আধূলিও পেলে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতাম। তাই তিনি যতটা গভীরে গিয়ে ভাবতে পেরেছেন সেটা অধম পারিনি। পরিতাপের হলো, এ অনুধাবনটা যাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে তারা কেউই ক্রিকেটে কর্তার আসনে আসীন না। আর যারা কর্তা, তাদের অর্থ লিপ্সা তো চোখে পরার মতই। তাই, এক যুগ আগেও যা ভাবা যেত না, সেটাই ঘটছে এখন। উইন্ডিজ টেস্টে তো ধবল ধোলাই হয়েছেই; ওয়ান ডে’তেও যে প্রতিরোধ গড়তে পারবে তেমন সম্ভাবনা আমি দেখি না। ঐদিকে ভারত পয়লাবারের মতন পেয়ে বসেছে অজিদের।
এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্ম যেন না হয় সে ক্ষেত্রে আগেই পরিষ্কার করি; উইন্ডিজের যেমন অধপতন ঘটেছে, আমরাও এগিয়ে গিয়েছি। আমরা যদি না এগুতাম তাহলে শুধু উইন্ডিজের অধঃপতনের ফায়দা নিয়ে তাদের ফতুর করতে পারতাম না আমরা। আমি উইন্ডিজের যে চিত্রটা তুলে ধরতে চেয়েছি সেটি শুধু এই সিরিজের প্রেক্ষিতে না; সামগ্রিকভাবে।
কিছু তথ্য দেয়াও প্রাসঙ্গিক মনে করছি। আইপিএল বা অন্যান্য টি টোয়েন্টি লিগগুলোর পরবর্তী যুগে একদিনের ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙেছে দুইবার। এবং দুবারই তা হয়েছে উইন্ডিজের বিপক্ষে। একদিনের ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ে বাদে শুধু উইন্ডিজই একমাত্র দল যাদের বিপক্ষে একাধিক ডাবল সেঞ্চুরি হয়েছে। চলতি বছরের ৩১ শে অগাস্ট পর্যন্ত এক হিসাবে দেখা যায়, পোলার্ড, ব্রাভো, নারিন এবং আর্চাররা বিভিন্ন দেশ ঘুরে টি টোয়েন্টি খেলেছেন ৪৫ টির বেশি করে। এর মধ্যে নারিন এবং পোলার্ড একবার করে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তুললেও ব্রাভো এবং আর্চার খেলেননি একটি ম্যাচও! হ্যাঁ, আপনি উইন্ডিজ বোর্ডকেও দুষতে পারেন। কিন্তু, এটা মাথায় রাখতে হবে যে; ভারতের মত বড় বাজার না থাকায় বোর্ডের আয়ও তেমন না। সুতরাং, বিশাল অর্থের দাবি পূরণ করাটা তাদের জন্য দুঃসাধ্য।
তালইরুপি ‘বাজান’ ক্যারিবিয়ান কর্তাদের এমন দৃশ্য কতটা বুকে কতটা ক্ষরণের জনম দেয় তা জানি না। তবে, অন্যান্য দলগুলোও যদি এ পথে পা বাড়ায় মাঠের ক্রিকেট হয়ে উঠবে মূমূর্ষ। তখন, এই কৌশলী কায়দায় রাজত্ব কায়েমের স্বপন দেখা ভারতও তৃপ্তি পাবে না। আশার বিষয় হচ্ছে কিছুটা দেরিতে হলেও অনেকের মাঝেই অনুধাবনের জনম নিচ্ছে। যেমন টেস্ট খেলার বাসনায় টি টোয়েন্টির হট কেক ম্যাক্সওয়েল আইপিএল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সতর্ক হচ্ছে বোর্ডগুলোও। যেমন বিশ্বকাপকে মাথায় রেখে মোস্তাফিজকে আইপিএল খেলার এনওসি দেয়নি বিসিবি।
সন্তানের প্রতি বাজানের যে প্রেম তা কখনোই অন্য কারো থাকে না। সেটা সম্ভবও না। এই সহজ বিষয়টি অনুধাবনের অভাবে প্রতাপশালী ক্যারিবিয়ানদের এখন সম্বল শুধু পূর্বের সুখ স্মৃতি। আর চতুর শ্বশুডর এর ফায়দা লুটে চেষ্টায় রত রাজত্ব কায়েমের। বিবেচনা ছাড়াই লাস্যময়ীর প্রেমে পড়ার হালত যে কি হতে পারে তা উইন্ডিজকে দেখে শিখতে পারেন অনেকে। প্রতাপশালী শ্বশুরকে বাজান ডেকে হয়ত সাময়িক সুখ পাওয়া যায়, তবে আখেরে তা সর্বনাশই ডেকে আনে।