লেখালেখি করতে গিয়ে অনেক ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। দেশ ও সময় ভেদে ভিন্নতা সত্ত্বেও সমস্যাগুলোর বেশির ভাগই কমন। ভারতের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা হলেও আমাদের দেশের জন্যও এই প্রবন্ধের আলোচিত বিষয়গুলো সমান জরুরী। জীবন টিকিয়ে রাখা, লেখার ভাষা, প্রকাশনা ও পাঠকদের মাঝে লেখার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা ইত্যাদি নানান দিক নিয়ে ভারতের প্রখ্যাত লেখক আর কে নারায়নের গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি বাংলায় জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ এ বাসেদ।
ভারতে সাহিত্যের সূচনা হয়েছিলো দশ হাজার বছর পুরনো মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত থেকে। এই দুটির যেকোন একটি থেকে একজন লেখক হয় একটি ঘটনা নতুবা একটি চরিত্রকে বাছাই করতেন এবং তাকে কেন্দ্র করে নতুন আরেকটি কাহিনী সৃষ্টি করতেন, অনেকটা শেক্সপীয়ার যেভাবে হলিনশেডের ক্রনিকল (Hollinshed’s Chronicle) এবং প্লুটার্কের লাইভসকে (Plutarch’s Lives) রুপান্তর করেছিলেন। কালিদাসের শকুন্তলা, যা কিনা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম, মহাভারতের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি। এই ধরনের কাজের বাইরেও অসংখ্য সুপ্রাচীন লেখকরা তাঁদের মেধা অনুসারে রামায়ণ এবং মহাভারতকে পূনর্লিখনের কাজে তাঁদের সমগ্র জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। তুলসিদাস রামায়ণ লিখেছেন হিন্দীতে, কাম্বান লিখেছেন তামিলে, কুমারভাসা লিখেছেন কান্নাডা ভাষায়। এইসব লেখকদের প্রত্যেকেই তাঁদের সমস্ত জীবনকে একটি মহান কাজের পেছনে ব্যয় করেছেন, এবং তা হলো ত্রিশ, চল্লিশ এমনকি পঞ্চাশ বছর ধরে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা স্টাইলাস (খাজ কাটার ধাতু) দ্বারা শুকনো পাতার বুকে পদাবলীগুলোকে (Stanzas) খোদাই করতে থাকা, যতক্ষণ না এসকল কাজ একটি বইয়ে রুপান্তরিত হয়। একটি সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি শেষে সামাজিক উৎসব এবং উদযাপনের মধ্য দিয়ে সেটিকে বরণ করে নেয়া হতো। ঐসময়ে একজন লেখকের জীবনে অর্থনৈতিক কিংবা ব্যবসায়িক বিবেচনার কোনো স্থান ছিলো না। স্বল্প পরিমাণে যাই জুটতো লেখকদের কপালে, সেটুকু আসতো রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং ইচ্ছাকৃত উপঢৌকন হিসেবে। একজন লেখকের কাজকে মন্দিরের সামনের খোলা জায়গায় কিংবা গাছের ছায়ায় জড়ো হওয়া মানুষদের উদ্দেশ্যে পড়ে শোনানো হতো। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সকলেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক ঘন্টা করে এই সাহিত্য পাঠকে মনোযোগ দিয়ে শুনতো। তখনকার সময়ে একটি সাহিত্যকর্ম পৃথিবীজুড়ে কোথায় কত কপি বই ছড়িয়ে পড়লো তার মাধ্যমে নয়, বরঞ্চ শ্রোতাদের স্মৃতিতে বেচে থাকতো এবং তাঁদের মুখঃনিসৃত শব্দের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হতো।
এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থায় বেশ কিছু ঐতিহাসিক পালাবদলের ফলে পরিবর্তন আসে। আসুন আমরা মাঝের কিছু ইতিহাসকে এড়িয়ে সরাসরি ব্রিটিশ সময়ে চলে আসি। ইংরেজি ভাষা ভারতবর্ষে কেবল ইংরেজি সাহিত্যই আমদানি করেনি, সারা পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের ইংরেজি অনুবাদের সাথেও ভারতবাসীদের পরিচয় ঘটায়। উপন্যাস এবং ছোটোগল্পের মতো নতুন সাহিত্যপন্থা লেখকদের নজরে আসে, যা তাঁদের কাছে কেবলমাত্র নতুন শৈল্পিক সম্ভাবনার দ্বারই উন্মোচন করেনি, পাশাপাশি নব্য এক সামাজিক সচেতনতারও উন্মেষ ঘটায়। আমাদের সাহিত্যের শুরুর দিকের গল্পগুলো একদিকে যেমন অসম্ভব প্রেম, মিলনাত্মক নাটক এবং রোমাঞ্চনির্ভর ছিলো, তেমনি আরেকদিকে বাল্যবিবাহ, যৌতুক ব্যবস্থা, সতীদাহ এবং গোত্রভিত্তিক বঞ্চনার মতো সুনির্দিষ্ট কিছু আচারব্যবস্থার দানবীয় দিকগুলোকেও তুলে ধরতো। সেসময়কার অনেক বাস্তববাদী উপন্যাস হচ্ছে এক হিসেবে ঐ আমলের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের উপরে আঘাত। যদিও এসকল সাহিত্য ‘নীতিশিক্ষামূলক’ বিশেষণ দ্বারা আক্রান্ত ছিল, তার পরেও তাঁদের মাঝে একধরনের শৈল্পিক ছোঁয়া ছিল যার ফলে ভিক্টোরিয়ান আমলের অসংখ্য বইপুস্তক আজও উপন্যাস এবং ছোটগল্প হিসেবে টিকে আছে (যদিও এসকল লেখায় যেসব সামাজিক সমালোচনা করা হয়েছে তা আজ মেয়াদোত্তীর্ণ)। ঐসময় এবং বর্তমান সময়ের মাঝের একটা পর্যায়কে আমরা মধ্যবর্তী সময় বলে সংজ্ঞায়িত করতে পারি যখন একজন লেখক কেবল একটা বিষয়ই খুজে পেতো লেখার উপাদান হিসেবে, এবং তা হলো রাজনীতি। একটা সময় এসেছিলো যখন সারা দেশের সমস্ত শক্তি দেশকে বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্ত করার কাজে নিয়োজিত হয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের প্রতি এই চাপ এবং তন্ময়তার ফলে হাস্যরসের মেজাজ, পারিপার্শ্বিকতার প্রতি সংবেদনশীলতা, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াবলীর রহস্যভেদ করা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সত্তার টানাপোড়েন এবং এ থেকে সৃষ্ট সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি বিচ্ছিন্ন দৃষ্টিপাত, যেসব কিনা ক্রমবর্ধমান সাহিত্যের বিষয়বস্তু নির্মাণ করে, পর্দার আড়ালে চলে যায়। এই সময়টাকে গল্প বলার সময়ের তুলনায় তর্কবিদ্যা এবং নীতিশাস্ত্রের সময়কাল হিসেবেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে এই তন্ময়তার সমাপ্তি ঘটেছে, এবং এই মুহূর্তে একজন লেখক তার চোখের সামনে যা ঘটছে তা থেকেই তার লেখার বিষয়বস্তু গ্রহণ করতে পারছে। বর্তমানে প্রতিটি লেখক তারা যেসকল শ্রেণির মানুষ এবং জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে সবচাইতে ভালো ধারনা রাখে তাঁদের জীবনকাহিনীকে নিজ নিজ উপন্যাস এবং গল্পের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলছে এবং পাশাপাশি এটাও আশা করছে যে শুধু তার শুভানুধ্যায়ীরা নয়, বরং এর বাইরের বেশ বড় একটা পাঠকশ্রেণির কাছে তাঁদের লেখাগুলো কদর পাবে। ভারতে উপন্যাসের তুলনায় ছোটোগল্প সাহিত্য রচনার অধিক জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আমার মতে এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে দুটি- (১) এই দেশে যে পরিমাণ বিচিত্র বিষয়াবলী পাওয়া যায় সেগুলো প্রকাশের জন্য ছোটোগল্পই উপযুক্ত মাধ্যম এবং (২) ছোটগল্প লিখতে সময় কম লাগে।
ইংরেজি ভাষা ভারতবর্ষে কেবল ইংরেজি সাহিত্যই আমদানি করেনি, সারা পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের ইংরেজি অনুবাদের সাথেও ভারতবাসীদের পরিচয় ঘটায়। উপন্যাস এবং ছোটোগল্পের মতো নতুন সাহিত্যপন্থা লেখকদের নজরে আসে, যা তাঁদের কাছে কেবলমাত্র নতুন শৈল্পিক সম্ভাবনার দ্বারই উন্মোচন করেনি, পাশাপাশি নব্য এক সামাজিক সচেতনতারও উন্মেষ ঘটায়। আমাদের সাহিত্যের শুরুর দিকের গল্পগুলো একদিকে যেমন অসম্ভব প্রেম, মিলনাত্মক নাটক এবং রোমাঞ্চনির্ভর ছিল, তেমনি আরেকদিকে বাল্যবিবাহ, যৌতুক ব্যবস্থা, সতীদাহ এবং গোত্রভিত্তিক বঞ্চনার মতো সুনির্দিষ্ট কিছু আচারব্যবস্থার দানবীয় দিকগুলোকেও তুলে ধরত। সেসময়কার অনেক বাস্তববাদী উপন্যাস হচ্ছে এক হিসেবে ঐ আমলের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের উপরে আঘাত
একজন লেখক যদি উপন্যাস লিখতে চান তবে তাকে কম করে হলেও এক বছর শ্রম দিতে হয়। উপন্যাস লিখতে যে পরিমাণ পরিপূর্ণ মনোনিবেশ প্রয়োজন তার যোগান দিতে বেশিরভাগ লেখকই সমর্থ নয়। কারণ বেশিরভাগ লেখকই বেচে থাকার জন্য অন্যান্য কাজ করার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ হিসেবে লেখালেখি করে থাকেন। ফুলটাইম কাজ হিসেবে লেখালেখিকে স্বীকৃতি পেতে এখনো অনেক সময় বাকি। এর জন্য প্রাথমিকভাবে যা প্রয়োজন তা হলো একটি অটুট প্রকাশনা ব্যবস্থা। এই বিষয়টিকে বিবেচনায় নেয়ার আগে আমাদেরকে আরও একটি বিষয়কে বিশ্লেষণ করতে হবে, এবং সেটি হলো- ভাষার সমস্যা। এই সমস্যা থেকে সৃষ্ট জটিলতাগুলোকে আমরা বুঝতে পারবো যদি আমরা স্মরণ করতে পারি যে এই মুহূর্তে ভারতে পনেরটি ভাষা রয়েছে যেগুলোতে লেখকরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসে তাঁদের লেখালেখির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেক লেখককে একইসাথে তাঁদের আঞ্চলিক ভাষা, তাঁদের জাতীয় ভাষা যা কিনা হিন্দী, তাঁদের ঐতিহ্যবাহী ভাষা সংস্কৃত (যদিও এই ভাষাটিকে প্রায়শই মৃত বলা হয়ে থাকে, কিন্তু একটি পাহাড় যেমন মৃত হওয়ার পরেও তার অস্তিত্বের জানান দেয়, এই ভাষাটিরও তেমনই স্পষ্ট অস্তিত্ব আছে), এবং সবার উপরে ইংরেজি ভাষা (যা বর্তমানে একেবারেই অপরিহার্য) এই সবগুলো ভাষাকে বিবেচনায় রাখতে হয়। কিছু কিছু ভাষার প্রভাব কেবল একটি নির্দিষ্ট সীমানার ভেতরেই, যা কিনা মাত্র কয়েকশো কিংবা কয়েক হাজার পাঠকের বেশি পাঠকের যোগান দিতে পারে না। একজন লেখকের জন্য জীবিকা-নির্বাহপযোগী পাঠকশ্রেণি কেবল সারা ভারতব্যাপী বই প্রকাশের মধ্য দিয়েই অর্জন করা সম্ভব। এর ফলে, একটি সাহিত্যকর্ম তা যে ভাষাতেই লেখা হোক না কেন, সেটি প্রকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে একটি সংস্থা স্থাপন, যা একধরনের সাহিত্যিক পরিস্করন ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে এবং একটি অনুবাদ-ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা একজন লেখককে সারা দেশব্যাপী পাঠক সমাজের ব্যবস্থা করে দিবে। বাস্তবতা হলো, এই দেশে কোন সাধারণ প্রকাশনা ব্যবস্থা নেই। বেশকিছু প্রকাশনা সংস্থা আছে, তারা কেবল পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনার ব্যাপারেই আগ্রহী, যা তাদেরকে অনায়াসে পাঁচ অঙ্কের পাঠক সমাজ এনে দেয়। পাশাপাশি এটাও বলতে হয়, পাঠকদের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার নয়। বই কেনার প্রতি একটি সুস্পষ্ট উদাসীনতা চারদিকে লক্ষ্য করা যায়। একজন আমেরিকান প্রকাশক একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার ব্যাচেলর অফ আর্টস বইটি (পকেটবুক সিরিজ, যার মূল্য ছিলো সর্বসাকুল্যে এক রুপি আট আনা) আমার নিজের শহরে (মাইসোর) কি পরিমাণ বিক্রি হয়েছিলো? আমার পক্ষ থেকে উত্তর ছিলো “ সম্ভবত দুইশো কপি।” সে আমাকে প্রশ্ন করেছিলো,
“তোমার শহরের জনসংখ্যা কত?”
“দুই লাখ পচাত্তর হাজার বা তার চাইতে কিছু বেশি।”
“তাঁদের মধ্যে কয়জন তোমার এই উপন্যাস পড়ার যোগ্যতা রাখে?”
“কম করে হলেও পাঁচ হাজার।”
“এদের মধ্যে কয়জন তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে এবং সাধারনত তোমার কাজ পছন্দ করে?”
“সম্ভবত তাঁদের সকলেই এবং এর বাইরে আরও অনেকেই।”
“তাঁদের মধ্যে কয়জনের পক্ষে একটি বইয়ের জন্য এক রুপি খরচ করা সম্ভব?”
“সম্ভবত তাঁদের সকলের পক্ষেই সম্ভব।”
“সেক্ষেত্রে কোন বিষয়টি তোমার শহরে তোমার বইয়ের দুইশো কপির জায়গায় পাচ হাজার কপি বিক্রি হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাড়ালো?”
আমি প্রশ্নটির কোনো উত্তর দিতে পারি নি। আমি এখনো এ নিয়ে ভেবে চলেছি। আমার মনে হয় যারা প্রকাশনা শিল্পের বিশেষজ্ঞ তাঁদের কাজ এই প্রশ্নটির উত্তর খুজে বের করা। এবং যদি তা করা হয়, ভারতের সাহিত্যিকদের পথ থেকে অনেক বড় একটি বাধা দূর হয়ে যাবে।
একটি সুস্থ, সাভাবিক সমাজে একজন লেখকের জন্য কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। এধরনের সমাজে একজন লেখকের পক্ষে ছয় মাসে একটি বই লেখা শেষ করা এবং বইটির পাঠকদের হাতে পৌছে যাওয়া সম্ভব, যা তাকে পরবর্তী কয়েক মাসের জন্য বিশ্রাম, ছুটি এবং পড়াশোনার সুযোগ করে দেবে যেন লেখকটি নতুন আরেকটি বইয়ের কাজ শুরু করতে পারে। এই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে কিভাবে একটি সমাজকে গঠন করা উচিত? একজন যুগান্তকারী সংস্কারককে কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে সমচরিত্রবিশিষ্ট শর্ত প্রতিষ্ঠার পূর্বে যার ফলে সাহিত্য রচনার উন্নয়ন ঘটতে পারে?
একজন ঔপন্যাসিক বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত থাকে। একটি বিষয় হচ্ছে উপন্যাস আমাদের দেশে সাহিত্য রচনার একটি সাম্প্রতিক রুপ এবং যদিও পাঠকেরা সময় কাটানোর জন্য উপন্যাস পাঠ করে, তারা কখনো জিজ্ঞেস করে না যে উপন্যাসটি আসলে কার লেখা? এই কথাটি কারও মাথাতেই আসে না যে উপন্যাসের লেখক যদি লেখালেখি করার মতো অবস্থাতে না থাকে তাহলে বিনোদন কিংবা নির্দেশনা পাওয়ার জন্য কোনো উপন্যাসই আর পাওয়া যাবে না। এই লেখকটিকে কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য কি কি করা প্রয়োজন? সব ধরনের শ্রমিকদের সকল প্রকার সমস্যা দূর করার জন্য সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সুবিধা নিয়ে চিন্তা করা হয়েছে। এমনকি সাংবাদিকরা, যারা শ্রমজীবিদের মধ্যে সবচাইতে অবহেলিত, তাঁদের লক্ষ্য সম্পর্কে জানান দিয়েছে এবং তাঁদের কল্যানের জন্য শর্ত দিয়েছে। কিন্তু একজন উপন্যাসিকের কোনোপ্রকার সামাজিক অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত গড়ে উঠে নি। সমস্যা হচ্ছে, ঔপন্যাসিকরা সমাজে এখনো তাঁদের আওয়াজ খুজে পায়নি।
ঔপন্যাসিকদের প্রথম সমস্যা হচ্ছে তাকে সব ধরনের মনোযোগ নষ্টকারী উপাদান এবং অসম্মানকর ঘটনা থেকে দূরে থাকতে হয়। তাকে তার ভেতরের এবং বাহিরের জীবনের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। একজন লেখকের জীবন হচ্ছে একটি বৈষয়িক বিষয়, দায়িত্বকে অস্বীকার করা সবসময় তার জন্য সম্ভব হয় না। সে হচ্ছে অস্তিত্বের সমুদ্রে পরিবার নামক জাহাজের একমাত্র নাবিক। সে সাহিত্য রচনায় অপারদর্শী হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা-জীবনের কঠোর বাস্তবতা মোকাবিলা করা কখনো কখনো তার সাধ্যের বাইরে চলে যায়।
একজন লেখকের কাজকে মন্দিরের সামনের খোলা জায়গায় কিংবা গাছের ছায়ায় জড়ো হওয়া মানুষদের উদ্দেশ্যে পড়ে শোনানো হতো। নারী–পুরুষ–শিশু নির্বিশেষে সকলেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক ঘন্টা করে এই সাহিত্য পাঠকে মনোযোগ দিয়ে শুনতো। তখনকার সময়ে একটি সাহিত্যকর্ম পৃথিবীজুড়ে কোথায় কত কপি বই ছড়িয়ে পড়লো তার মাধ্যমে নয়, বরঞ্চ শ্রোতাদের স্মৃতিতে বেচে থাকতো এবং তাঁদের মুখঃনিসৃত শব্দের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হতো।
আমি কঠোর এবং কঠিন বাস্তবতা বলতে বুঝাচ্ছি বাজেট নিয়ন্ত্রণ করা, নির্ভরশীলদের দেখাশোনা করা, বিভিন্ন বিষয়ে হিসাব-নিকাশ করা সহ আরও অনেক কিছু। সংখ্যা নিয়ে কাজ করার সময় হিসেব-নিকেশে সে অনেক বড় ভুল করে ফেলবে, যোগ-ভাগ না জানার ফলে নয় (সাহিত্যের জগতে তার সমস্ত চিন্তা নিমজ্জিত), বরং তার হাতে থাকা নগদের পরিমাণ মূল্যের দিক দিয়ে তার কাছে অতিরঞ্জিত বলে মনে হবে বলে। যে সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দশ হাজার টাকা প্রয়োজন, সে পরিমাণ সন্তুষ্টি সে মাত্র পঞ্চাশ রুপি দিয়েই অর্জন করে ফেলবে। এটি যদিও সংখ্যা নিয়ে কাজ করার একটি অসামঞ্জস্যকর পন্থা, কিন্তু লেখক মাত্রেই এরকম, এ বিষয়ে কারোরই কিছু করার নেই। বেচে থাকার এবং জীবনের সমস্যাগুলোর সাথে লড়াই করার এটি কোনো বাস্তব উপায় নয়, কিন্তু কিছুই করার নেই। মানুষটা বেড়েই উঠেছে এভাবে, এটাই হচ্ছে একমাত্র উপায় যার মধ্য দিয়ে সে বেচে থাকতে পারে, কাজ করে যেতে পারে। এটি এই লেখকের সাথে যারা বাস করে তাঁদের জন্য বিচিত্ররকম সমস্যার সৃষ্টি করে। একজন যতোই বাস্তববাদী লেখক হোক না কেনো, সে পৃথিবীর অন্যতম স্বপ্নবাজ মানুষ হিসেবেই পরিগনিত হবে, এবং জীবনের চাহিদাগুলো তাকে যন্ত্রণা না দিলেও, অবাক করবে। এবং এর বিপরীতে সর্বদাই এই লেখকটির তার নিজের এবং জীবনের এই বাস্তবতাগুলোর মাঝখানে একটি কুশনের প্রয়োজন পড়ে।
এই যুক্তিগুলোকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে একজনকে একজন লেখকের কর্মপন্থাকে পরিপূর্ণরুপে বুঝতে হবে। একজন উপন্যাসিককে জীবনের কাছাকাছি থাকতে হয় এবং জীবন থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরনাসমূহের জন্য নিজেকে সর্বদা উন্মুক্ত রাখতে হয়। যদি সে নিজেকে আদতেই একজন লেখক হিসেবে প্রমান করতে চায় তবে তার মস্তিষ্ককে জীবন থেকেই লেখার উপাদান সংগ্রহ করতে হবে, আকার দিতে হবে, ব্যবহার করতে হবে। তাকে সর্বদাই পরবর্তী অধ্যায় সংযোজনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, হোক সে এমন একজন লেখক যে কিনা প্রত্যহ একটি নির্দিষ্ট সময়ে টেবিলে বসে একটি নির্দিষ্ট পরিমান কাজ সম্পাদনা করে কিংবা আচমকা একটানা কাজ করতে শুরু করে। টেবিলে বসে থাকা সময়ের পরিমাণের সাথে কাজ সম্পাদিত হওয়ার পরিমাণের কোনো সম্পর্ক নেই, এবার টেবিলে যতটুকু সময়ই দেয়া হোক না কেন। সে সবসময়ই ব্যস্ত। আজকের দিনের মতো কাজ শেষ করে একটি ভারমুক্ত মস্তিষ্ক নিয়ে আসন ছেড়ে উঠা বলতে কোনোকিছু নেই। উপন্যাসটি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার কাজের কোনো শেষ নেই, আমরা যদি স্মরণ করি যে একটা উপন্যাস লিখতে কমপক্ষে ৮০,০০০ শব্দের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা অনুধাবন করতে পারবো উপন্যাসটির পেছনে লেখকটির ব্যয় করা শ্রমের পরিমাণ।
অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করে একটা উপন্যাস শুরু করার আগে থেকেই কি সেটি সম্পর্কে আমার কাছে পরিপূর্ণ ধারণা থাকে? আমি কি একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ধরে কাজ করি কিনা কিংবা আসলে কিভাবে আমি একটি উপন্যাসের সৃষ্টি করি? আমি মাঝেমাঝে কল্পনা করি, যদি আমি এই প্রশ্নগুলোর কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারতাম? আমি কেবল একটা জিনিসই জানি, এবং তা হলো যখন আমি লিখতে বসি, আমার কাছে কেবল দিনশেষে আমার কাজের কি ফলাফল আসবে, সে সম্পর্কে একটি অস্পষ্ট ধারণা থাকে মাত্র, এর বেশি কিছু না। এটা বলা বাহুল্য হবে না যে টাইপরাইটারের উপরে কাজ করতে থাকা আমার আঙ্গুলগুলো আমার মস্তিষ্কের চাইতে অনেক বেশি জানে সামনে কি ঘটতে যাচ্ছে। এটা আমার নিজের প্রতি নিজের কোনো বিবেচনা নয়, কিন্তু আমি চাই না এমনটা হোক।
আমি প্রতিদিন যা লিখি তা আমি যখন লেখার কাজে ব্যস্ত থাকি তখন নিজেরা নিজে থেকেই গঠিত হয়ে যায়। এর মানে হচ্ছে একজন লেখকের অবচেতন মনের প্রচুর পরিমাণে স্বাধীনতা থাকতে হবে। উপন্যাস লেখা একইসাথে একটি সচেতন এবং অচেতন কাজ। এটি একইসাথে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং বুদ্ধিবৃত্তির চাইতেও বড় একটি বিষয়। এর অর্থ হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তে নিজের কাজকে পরিচর্যা করার জন্য মস্তিষ্ককে পুরোপুরি স্বাধীন থাকতে হবে। উপন্যাসের বুদ্ধিবৃত্তিক অংশ এর নির্মাণপদ্ধতি এবং প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে জড়িত, উপন্যাসের অবধারিত রুপের সাথে নয়, যদিও একটি সম্ভাবনা থেকে যায় যে লেখক আসলে জানেন তিনি কি জিনিসের জন্ম দিতে চলেছেন। এই এতটকু পর্যন্তই তার মস্তিষ্ক ভারগ্রস্থ থাকে।
একটি নির্দিষ্ট দিনে যখন একজন লেখক একটি নতুন উপন্যাস লিখতে বসেন, এটি বুঝে নিতে হবে যে তিনি এমন একটি কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন যেটি তাকে মাসের পর মাস বন্দী করে রাখবে। যদি সে একজন দ্রুত লেখকও হয়, আসল লেখার বাইরেও পুরো প্রক্রিয়াটি তাকে কম করে হলেও দুই বছরের জন্য বেধে রাখবে। এরপর আবার তাকে পান্ডুলিপি পুনরায় পাঠ করতে হবে, কারণ একটি লেখার পান্ডুলিপিকে সর্বদাই অসমাপ্ত এবং অসন্তোষজনক বলে মনে হয়। এখানে পুনঃপাঠ বলতে বোঝায় ৮০,০০০ শব্দকে তাঁদের যতিচিহ্ন সহকারে চোখ বুলানো, পাশাপাশি এই শব্দগুলোর যৌক্তিকতা এবং ভারকে যাচাই করা। সন্দেহ আশঙ্কা, যা কিনা একজন লেখককে তার লেখা সম্পর্কে আচমকা গ্রাস করতে পারে, সে সম্পর্কে না হয় কিছু নাই বলা হল। এটার অস্তিত্ব সবসময়েই থাকে এবং কয়েক মাসের কষ্টের ফলে সৃষ্ট কাজকে ছুড়ে ফেলাতেও রুপ নিতে পারে। ধরে নেই যে লেখকটি তার কাজের সমস্ত যান্ত্রিক অংশগুলোকে সঠিকভাবে সমাপ্ত করেছে এবং তার পান্ডুলিপিকে তার প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই দিনটি হচ্ছে সবচেয়ে সুখের দিন। সে এইদিন নিজেকে একজন স্কুলছাত্র হিসেবে দেখতে পায় যে কিনা তার সর্বশেষ পরীক্ষাটি দিয়ে ফেলেছে, যে কিনা তার অতীতের কষ্টের দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে শিহরিত হয় এবং সামনের গ্রীষ্মকালীন ছুটির দিকে তাকিয়ে আনন্দিত হয়। এখন, দুই বছর ধরে কাজ করে আসার পর, এই লেখকটি কতদিনের জন্য কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে? যদি তাকে পৃথিবীকে তার শ্রেষ্ঠটুকু দেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হয়, তবে তাকে বিশ্রাম নিতে হবে, এবং নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, যাতে করে তার প্রেরণার নহর আবারও ফুলে ফেপে উঠতে পারে। তাকে বিশ্বাসযোগ্য হতে হলে, তার কাজকে পাঠকের কাছে পৌছাতে হবে এবং পাঠক কর্তৃক গৃহীত হতে হবে। সবকিছু বলা এবং করে ফেলার পর, পাঠকের সমর্থনই পারে কেবল একজন লেখককে টিকিয়ে রাখতে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যেনো তার লেখা বইয়ের দোকানে শোভা পায় এবং পাঠকরা তার লেখার প্রতি আগ্রহ দেখায়। কেবল এটাই পারে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কাজের মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে। কেবল এটাই পারবে তাকে বিশ্রাম নেয়ার স্থলে বাজারী কাজে লিপ্ত হওয়া এবং তৃতীয় শ্রেণির জিনিস প্রস্তুত করা থেকে বিরত রাখতে, যা তাকে খুব দ্রুতই শুষে নেয়। একজন লেখককে এই ধরনের স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে কি দিতে পারে? সমাজের এমন অবস্থা কিভাবে গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে প্রকাশনা কার্যক্রম এতটাই সাজানো-গোছানো হবে যে একটি ভালো বই কোনোরকম বিলম্ব ছাড়াই পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে? এইদিক দিয়ে আমাদের দেশে ঔপন্যাসিকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পূর্বে যেমনটা বলেছিলাম, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে একটি সাধারণ প্রকাশনা ব্যবসা গড়ে উঠেনি। নতুন লেখকদের কাজ প্রকাশ, বিজ্ঞাপন এবং গ্রহণ করার জন্য গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লেখক এবং প্রকাশনা সংস্থার মাঝে যা প্রয়োজন তা হলো- পত্রিকাগুলোকে তাঁদের সাহিত্য পাতার মাধ্যমে নতুন বইয়ের খবর প্রচার করতে হবে, বইবিক্রেতাদেরকে নতুন বই স্টকে রাখতে হবে, এবং সবকিছুর উপরে একটি প্রতিবেদনশীল এবং সুবিবেচক পাঠকশ্রেনী গড়ে উঠতে হবে যারা বইটি কিনবে। আমি ‘বিক্রি’ শব্দটি ‘পড়া’র চাইতে অনেক বেশী পরিমানে ব্যবহার করি। এটি ‘পড়া’র চাইতে সম্পূর্ন ভিন্ন একটি ব্যাপার, যেহেতু ধার করে আনা বই দিয়েও পড়াশুনা চালানো যায়। ধার করে আনা বইয়ের মাধ্যমে পড়াশুনা একজন লেখককে বিশাল একটি পাঠকশ্রেনী হয়তো দেবে, কিন্তু কোনো কার্যকরী ফলাফল দেবে না। জাতীয় পরিসরে অতি দ্রুত একটি বই কেনা কর্মসূচী চালু করতে হবে। বই কেনা এবং নিজস্ব লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বে পরিনত হতে হবে, যা কিনা একইসাথে একজন লেখকের পরিশ্রমের মূল্য দিবে এবং প্রত্যেক ঘরে ঘরে একটি সাধারণ সংস্কৃতিবান আবহাওয়ার সৃষ্টি করবে।