নির্বাচন নিয়ে কথা উঠলেই একটি ফিরিঙ্গি শব্দ সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখে ফেরে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’! এটি তো আবার নির্বাচনের মাস, তো হরহামেশাই এই শব্দটি শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনের উত্তাপের ডামাডোলে বাংলাদেশ-উইন্ডিজ সিরিজ চলছে। এতে এ শব্দটি প্রকাশ্যে ব্যবহৃত না হলেও পরোক্ষে বেশ ভূমিকা রেখেছে। পয়লা ওয়ান ডে শেষে যা হালত দেখলাম; তাতে রাজনীতির ময়দানে কি চলছে তা তো জানি না কিন্তু যে ফিল্ডেই খেলা হোক উইন্ডিজের যে কম্ম নয় এই বাংলাদেশকে হারানো এটা এখন নিশ্চিত।
টেস্টে ক্যারাবিয়ানদের স্পিনে অসামান্য স্কিল বিবেচনায় বাংলাদেশ বোলিং আক্রমণ সাজিয়েছিল স্পিনারদের দিয়ে। প্রথম ম্যাচে আলঙ্কারিক রুপে মোস্তাফিজ থাকলেও পরের ম্যাচে ন্যূনতম মায়া না দেখিয়ে উইন্ডিজকে চার স্পিনারে চোখে সর্ষে ফুল দেখিয়ে ছেড়েছিল বাংলাদেশ। ফলস্বরুপ রেকর্ড জয় আসলেও সমালোচনাও সইতে হয়েছে দলকে।
নিজ ঘরের সুবিধা নিয়ে লেভেল প্লেয়িং’র বদলে আনপ্লেয়বল পিচে ক্যারিবিয়ানদের পরীক্ষা নেয়াটা যেহেতু ভদ্রস্ত ঠেকেনি তাই ওয়ান ডেতে সমালোচনার কোনো সুযোগ রাখেনি বাংলাদেশ দল। কথিত বাক্য মেনে উইন্ডিজের শক্তির জায়গা, পেসকে কাজে লাগানো সম্ভব এমন পিচ বানিয়েই মিরপুরে তিন পেসার সমেত মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ দল। তাতেও যে দশা দেখা গেল; এখন উইন্ডিজই বলুক তাদের শক্তির জায়গা আসলে কোনটা? স্পিনে নৃত্য দেখানোর পর পেসেও খাবি খাওয়ায় আন্ডার আর্ম ব্যতিত বিকল্প কোনো পথ তো দেখছি না!
যাই হোক, হালত দেখে ক্যারিবিয়ানদের নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ পাচ্ছি না। ব্যবচ্ছেদ করা যাক বাংলাদেশ দলের নৈপুণ্যের। বোলাররা যে লেটার মার্কসসহ উৎরে গিয়েছেন তা তো বলাই বাহুল্য। গলার কাটা হয়ে থাকবে রুবেলের বোলিং। আরো স্পষ্ট করে বললে স্লগ ওভারে তার বোলিং। এ জায়গায় রুবেলেকে নিয়ে পেরেশানি নয়া কিছু না। শঙ্কার হচ্ছে, ম্যাচের পর ম্যাচ পার হয়ে গেলেও হয় তিনি তার সমস্যা এহসাস করতে পারছেন না, নতুবা স্লগে ভালো করার যোগ্যতা তার নেই। এটিকে এখন আর ইত্তেফাক বলার সুযোগ নেই। কেননা, স্লগে রুবেলকে রোলার দিয়ে পিষে মারার দৃশ্যটা এখন নিয়মিতই হয়ে গিয়েছে বলা যায়। তাই, বাংলাদেশ দলের বাকি চার বোলারের কারো ইকোনোমিই যেখানে চারেও পৌছায়নি সেখানে রুবেলের সেটি ছয়ের বেশি। এবং এর পিছনে মুখ্য অবদান যে স্লগ ওভারের তা বলাই বাহুল্য।
ফিল্ডিংয়ে ক্যাচ মিসটিও এখন গা সওয়া। হাতের ক্যাচ, কাছের ক্যাচ পরাটা স্বাভাবিকই ঠেকে এখন। তাই, এটি নিয়ে মুশফিক-রুবেলের বিচলিত হবার মতন কিছু দেখছি না! এর মধ্যেও তামিম এবং মিরাজ যে দুটি ক্যাচ নিয়েছেন তা লা জওয়াব। বিশেষ করে বেশ কিছুদিন পর মাঠে ফিরে যেভাবে অনেকটা দৌড়ে এসে শরীরকে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে তামিম ক্যাচটি নিয়েছেন তা চোখকে শান্তি দেয়ার মত। এখানে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কেন তামিম-সাকিবরা সবার চেয়ে আলাদা। তারা যে হালতে যতক্ষণই মাঠে থাকুন নিজের সর্বোচ্চটুকুই যে দিবেন এটা নিশ্চিত।
ব্যাটিং নিয়ে আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। গেল কয়েকদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল ওপেনিং নিয়ে নির্বাচকরা মধুর সমস্যায় পড়েছেন। চার ওপেনারই ফর্মে! থাকায় কাকে রেখে কাকে খেলাবেন সে সমস্যা। তা, সেটার যে সমাধান তারা বার করলেন তা কিছুটা তেতোই ঠেকেছে। একই সাথে নামিয়ে দিয়েছেন চারজনকে! পয়লা একটা বিষয় পরিষ্কার করি; যে মধুর সমস্যাটার কথা বলা হচ্ছিল তা নেহায়েত মিডিয়ার হাইপ। নতুবা, উইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে ইমরুল আর সৌম্য যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তাতে তাদের আত্মবিশ্বাস থাকার কথা তলানীতে। মানছি, যে ফরম্যাট আলাদা; কিন্তু মানুষ দুজন তো একই।
ইমরুল ব্যাট প্যাডের মধ্যে যতখানি ফাঁক রেখে বোল্ড হলেন তার মাঝ দিয়ে অনায়াসে একটি পকেট সাইজের হাতি রাস্তা পার হতে পারবে। এতেই তো পরিষ্কার তা আত্মবিশ্বাসটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। কায়ানাতে টেস্ট, ওয়ান ডে, টি টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞের পর এক নয়া বিশেষজ্ঞের দেখা মিলেছে। প্রস্তুতি ম্যাচ বিশেষজ্ঞ। তিনি যে কে সেটি নাম না নিলেও কারো বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না। নামলেন, দু চারটা শট খেলে নিজেকে দায়মুক্ত ভেবে বোলারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সুন্দর মতন ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন! এদের রাখা না রাখা নিয়ে যদি সমস্যা দেখা দেয় তাহলে বলতেই হবে বড় সমস্যায়ই আছি আমরা। তবে, সেটি মধূর না বোধের সমস্যা! লিটন চরম ভাগ্য পাবার পরেও যে কায়দায় বোল্ড হয়ে ফিরেছেন তাতে তার বোধশক্তি নিয়েও সাওয়াল জাগে।
যথারীতি ভরসার জায়গা সেই মুশফিকই। তামিম যেহেতু সদ্যই আঘাত কাটিয়ে দলে ফিরেছেন এ সিরিজে তাকে আতশ কাচের নিচে নেয়াটা অন্যায় হবে। আমি একটা বিষয়ে বেশ অবাক হয়েছি। বিশ্বকাপের আর বেশিদিন বাকি নেই। এমনাবস্থায় যখন ব্যাটিং অর্ডারটা একটি স্পষ্ট রুপ ধারণ করার কথা, সেখানে এখন আশ্চর্য এক ধোয়াশা। বিগত কয়েকটি সিরিজ বিবেচনায় দু ওপেনারের পর সাকিব, মুশফিক এবং মাহমুদুল্লাহ; এ ক্রমটি ছিল কার্যকর এবং চমৎকার। ছয়ে একজন ব্যাটসম্যান এবং সাতে একজন কার্যকর স্লগার হলেই ব্যাটিং অর্ডারটি পূর্ণতা পেত। সেটি না করে চার ওপেনারকে নামিয়ে মাহমুদুল্লাহকে সাতে পাঠানোর ব্যাখ্যা কে দেবে খোদা মালুম। সৌম্যকে যখন খেলাতেই হবে; অন্তত নির্বাচকদের ভাবসাবে যেটি মনে হয়, তাকেই সাতে খেলানো হোক। বিশ বলের বেশি টিকবেন এমন ভরসা তো বোধকরি তিনি নিজেও করেন না, সেই বিশ বলেই যদি কোনো ক্যামিও খেলতে পারেন দলের যেমন লাভ তেমনি তারও নিয়ত সমালোচনা সহ্য করার পথটা বন্ধ হয়। যদিও সমালোচনা তিনি ঠিক বোঝেন কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।
এ ম্যাচের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি ছিল মাশরাফি। মাঠে নয়াভাবে নিজেকে তার চেনানোর কিছু নেই। কিন্তু, নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক কিছুটা হলেও তার মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলার কথা। কিন্তু, মাঠের নৈপুণ্যেই জানিয়ে দিলেন মাঠের মাশরাফি সেই একই রকমই আছে। উপলক্ষটাও বেশ বড় ছিল। পয়লা বাংলাদেশি হিসাবে একদিনের খেলায় দুশতম ম্যাচ। সেটিকেও রাঙালেন ম্যাচ সেরা হয়েই, যেমনটি করেছিলেন শততম ম্যাচেও। আফসোস এক জায়গায়, কদিন আগে গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে মাশরাফি বলেছিলেন তিনি শচীন বা ম্যাকগ্রা নন যে তাকে সবাই মনে রাখবে; কালকের ম্যাচের পর তিনিই বলুন ক্রিকেট মাঠে তার যে অর্জন তা ভুলবে কে?
সিরিজটা যে টেস্টের মতনই এক তরফা হবে, এমনটা আশা করতে না চাইলেও আশঙ্কাটা থেকে যাচ্ছে। চুড়ান্ত ভদ্রতা দেখিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে যুদ্ধে নামার পরেও উইন্ডিজ যে অসহায় আত্মসমর্পন করল তাতে সামনে আশাবাদী হবার মতন কিছু দেখছি না। কেউ যদি বলেন যে, উইন্ডিজ সেরা দল নিয়ে আসতে পারে নি বলে এই হালত তাহলে তার তীব্র প্রতিবাদ জানাবো। তাদের খেলোয়াড়দের জাতীয় দল রেখে টি টেন খেলতে প্ররোচিত আমরা করিনি। আর ক’দিন আগেই গেইল সমেত যে দলটি ছিল সেটিকে তাদের মাঠেই আমরা হারিয়ে এসেছি। সুতরাং, এ জয়টা আমরা নিজ যোগ্যতায়ই পেয়েছি। আর উইন্ডিজের চেয়েও এগিয়ে গিয়েছি নিজ যোগ্যতাতেই।