সৌভ্রাতৃত্বের নজির তৈরি করল কাশ্মিরের ভদ্রেওয়া গ্রাম

সৌভ্রাতৃত্বের নজির তৈরি করল কাশ্মিরের ভদ্রেওয়া গ্রাম

ক্ষমতাসীন শাসক দলের প্রত‍্যক্ষ অথবা পরোক্ষ মদতে সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালনে যখন আপামর শুভবাদী ভারতীয় নাগরিক সন্ত্রস্ত-আতঙ্কিত; সেই কঠিন দুঃসময়ে একটি সম্প্রীতির বার্তা আশান্বিত এবং গর্বিত করল আমাদের। জম্মু ও কাশ্মির প্রদেশের ভেলান-খরোঠি গ্রামের সংখ‍্যাগুরু হিন্দু বাসিন্দাগণ ঐক‍্যমতের ভিত্তিতে কোনও নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছাড়াই পঞ্চায়েত প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করলেন গ্রামের একমাত্র মুসলিম পরিবারের মুরুব্বিকে। ওই গ্রামের বাসিন্দা ৫৭ বছর বয়সি দুনি চাঁদ সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে বলেন, “বর্তমানে ধর্মীয় মেরুকরণের কৌশল দ্বারা আমাদের সমাজ বহুখণ্ডিত করার অপচেষ্টা চলছে। এই জমানায় আমাদের গ্রামের ঐক‍্যমত এবং গ্রামের একমাত্র মুসলিম পরিবারের কর্তার হাতে কর্তৃত্ব ন‍্যাস্ত করার উদ‍্যোগ নিঃসন্দেহে বিরল। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার মূল শক্তি এই ভ্রাতৃত্ববোধ। আমরা যে সকলে ভাই-ভাই, এই বিশ্বাস যে রাজনীতির মোড়কে বিভাজন নীতি ভেঙে দিতে পারে না, সেই সত‍্যটা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে পেশ করলাম।” বস্তুত, এই নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তারা দু’টি বার্তা দিতে চেয়েছেন। আমরা ঐক্যবদ্ধ, বিভাজনের রাজনীতি উপেক্ষা করে আমাদের অটুট রাখতে হবে ভ্রাতৃত্ব, এই বার্তা পরধর্ম-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা এবং গোমুখ‍্যুমিতে বিধ্বস্ত নরেন্দ্র মোদির ভারতকে। দ্বিতীয় বার্তা নবনির্বাচিত গ্রাম প্রধান চৌধুরী মহম্মদ হুসেনকে- আপনি বিচ্ছিন্ন এবং একা নন; আপনিও আমাদের পরিবারের অংশ। গ্রামের একমাত্র মুসলিম পরিবারের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা প্রদান করতে আমরা সকলে প্রতিশ্রুতিমান তথা দায়বদ্ধ।

গত ১৭ নভেম্বর থেকে মোট নয় দফার পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু হয়েছে জম্মু ও কাশ্মিরে, শেষ দফা ১১ ডিসেম্বর। ডোডা জেলার ভদ্রেওয়া তহশিলের অন্তর্গত ভেলান-খরোঠি গ্রামে বসবাস করেন প্রায় সাড়ে চারশো মানুষ। চৌধুরী মহম্মদ হুসেনের পরিবারের আট জন ব‍্যতীত সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সদ‍্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সকল গ্রামবাসী সর্বসম্মত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন- চৌধুরী হুসেনকে ‘সরপঞ্চ’ হিসাবে নির্বাচিত করা হোক। দ্বিমত ছিল না বিন্দুমাত্র, তাই বিরোধী প্রার্থী হিসাবে প্রতিপক্ষ হয়নি কেউ। ভোটভিত্তিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছাড়াই গ্রাম প্রধান নির্বাচিত হন ৫৪ বছর বয়সি চৌধুরী মহম্মদ হুসেন। ভদ্রেওয়া শহর থেকে ১০ কিমি পশ্চিমে হাঙ্গা পঞ্চায়েতে প্রধানের চেয়ার বর্তমানে হুসেন সাহেবের জন‍্য বরাদ্দ। গ্রামের সকলেই নিশ্চিত, সাড়ে চারশো জনের পরিবারকে ভালোভাবে পরিচালনা করবেন মুরুব্বি! পাঁচ পুত্র এবং চার কন‍্যার পিতা তিনি। চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, তারা স্বামীর সংসারে সুখ-সচ্ছলতায় বাস করেন। পাঁচ পুত্রের মধ‍্যে একটি পুত্র বিবাহিত। স্ত্রী, এক বৌমা এবং পাঁচ ছেলেকে নিয়েই হুসেনের সংসার। গুজ্জর সম্প্রদায়ের মানুষ তিনি, পশুপালন তার পেশা। গ্রামের হিন্দু ভাইদের এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ সিদ্ধান্তে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বলেন, “আমি সত্যিই ভাগ্যবান, তাই এমন পড়শি পেয়েছি। এই গ্রামের কল‍্যাণের জন্য আমি আমার জীবনও দিতে রাজি! এই গ্রামের ভালো করাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য।”

মোদি-জমানায় স্রেফ গো-হত‍্যার কারণে হত‍্যা করা হয়েছে মুহম্মদ আখলাক-সহ আরও কিছু নিরীহ মানুষকে। গত ৩ নভেম্বর গো-রক্ষকদের তাণ্ডবে খুন হয়েছেন বুলন্দশহর জেলার পুলিশ অফিসার সুবোধকুমার সিংহ। কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী যখন শাসক দলের মদতে মুসলিমদের ভীত-সন্ত্রস্ত করতে সচেষ্ট, সেই আবহে হিন্দু ভাইদের মহানুভবতা আমাদের আশার আলো দেখায় বৈকি! বর্তমান জমানা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রসঙ্গে প্রবীণ কবি শঙ্খ ঘোষ একটি কবিতায় লিখেছেন :

কিছুই কোথাও যদি নেই

তবু তো ক’জন আছি বাকি

আয় আরও হাতে হাত রেখে

আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।