হঠাৎ করেই ছন্দপতন আর অমনি আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়লো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি (৭বার) জয়ী ক্লাব এসি মিলান। ২০০৬-০৭ সালে শেষবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ছোঁয়া পেয়েছিলো রোজোনেরিরা (লাল-কালো)। এক সময় রোজোনেরিদের হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছে রোনালদো, রোনালদিনহো, মালদিনি, কাকা, ডেভিড ব্যাকহাম, ইব্রাহিমোভিচদের মত তারকা ফুটবলাররা। আজ সেসবই যেনো মিলান ভক্তদের কাছে সোনালি অতীত।
বর্তমানে এসি মিলানকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়তে হচ্ছে। অনেকে মিলানের এইভাবে হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী করছে ক্যালসোপোপলি স্ক্যান্ডালে জড়িত থাকাকে আবার অনেকে দায়ী করছে ইতালির সাবেক মালিককে। যিনি ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কারণ যখন ইতালির মিলান শহরে ইন্টার মিলান ও এসি মিলান দুটি ক্লাব যাত্রা শুরু করে তখন থেকেই এসি মিলানকে মিলানের শ্রমিক সমর্থিত দল ও ইন্টার মিলানকে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সমর্থিত দল হিসেবে মনে করা হতো। সেখানে ফুটবলের বাহিরেও সমাজে বসবাসরত নানা পেশার সাথে জড়িত সকলের সম্পৃক্ততা ছিলো লক্ষনীয়। তবে এখন মিলানের দুই ক্লাব শ্রমিক – মালিকশ্রেণি বৈষম্যের বলয় থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শের দলে রূপান্তরিত হয়েছে। যখন ইতালির গণমাধ্যম ব্যবসায়ী ও রক্ষনশীল দল থেকে নির্বাচিত ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুকনি এসি মিলানের মালিকানা গ্রহণ করেন এবং বামপন্থী তেল ব্যবসায়ী ম্যাসিমো মোরাত্তি ইন্টার মিলানের মালিকানা কিনে নেন। তখন থেকেই এসি মিলানকে ডানপন্থী ও ইন্টার মিলানকে বামপন্থী ফুটবল ক্লাব মনে করা হয়।
প্রাথমিকভাবে এর প্রভাব তেমন চোখে না পড়লেও এক সময় তা মহামারী আকারই ধারণ করে। অনেক ইতালীয় বংশোদ্ভূত ফুটবলার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এসি মিলানে যোগ দিতে অনিহা প্রকাশ করেন। তাছাড়া একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি যখন একটি ক্লাবের মালিক তখন ক্লাবটিকে আরও নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এর মাঝে ২০০৬-০৭ সালে ক্যালসোপোপলি স্ক্যান্ডাল যেনো আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। ১৯৮৪ সালের দিকে আরেকবার এসি মিলান ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়ালেও ২০০৬-০৭ সালের ক্যালসোপোপলি স্ক্যান্ডাল এসি মিলানকে বেশি প্রভাবিত করে। তার পর থেকেই যেনো এসি মিলান তাদের ফুটবল জৌলুশ হারাতে শুরু করে। ইউরোপিয়ান ধনী ক্লাবের তালিকায় যেখানে তাদের নাম সেরা ৩-৪ এর মাঝে থাকতো হঠাৎ করেই তারা সেরা দশের বাহিরে চলে যায়। ক্লাবের এমন অবনতি দেখে এসি মিলানের মালিক সিলভিও বার্লুকোনি ২০১৭ সালে এসি মিলানের মালিকানা হস্তান্তর করেন চীনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রসোনেরি স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট লাক্সের কাছে। ৭৪ কোটি ইউরোতে মিলানের নতুন মালিক হয়েছে চীনা বিনিয়োগকারী কোম্পানিটি।
নতুন মালিক হিসেবে ইয়ংহং লি ক্লাবের ভালো সময় ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। শিরোপা খরা কাটিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ সময়ে ফিরতে চায় নতুন ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সেই উদ্দেশ্যেই ২০১৭ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলের সময় দলকে ঢেলে সাজাতে উঠে-পড়ে নামেন এসি মিলানের নতুন মালিক ইয়ংহং। তবে তখন বাদ সাদে উয়েফা। তাদের দল সজানোর জন্য ট্রান্সফার মার্কেটে এই বিনিয়োগকে ‘অবৈধ’ বলে জানান উয়েফা। তার পরিপ্রেক্ষিতে এসি মিলানের মালিকপক্ষ সুইজারল্যান্ডের নিওনে উয়েফার দপ্তরে গিয়ে প্রায় ১৬৯ পাতার একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেখানে তাদের আগামী চার বছরের কর্মপরিকল্পনাসহ সকল বিষয়গুলো নথিভুক্ত ছিলো। যদিও তাতে মন ভরেনি উয়েফার। তারপরও এসি মিলানের প্রধান নির্বাহী মার্কো ফাসোনে ও মালিকের ডেপুটি ডেভওড হান লি উয়েফাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন তাদের আর্থিক সক্ষমতা বৈধ ও তারা উয়েফার ফিন্যান্সিয়াল প্লে’র কোনো আইন ভঙ্গ করেননি। তখনই আলোচনায় চলে আসে এসি মিলানের মালিক লি ইয়ংহং নিজেকে যে খনির মালিক বলে দাবি করেছেন তা সত্য নয়। তাই পরবর্তীতে তাদেরকে ট্রান্সফার বাজেট সীমিত করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। তাছাড়া প্রথম সিজনে যে পরিমান টাকা দল সাজানোর জন্য লি ইয়ংহং খরচ করেছিলো সে তুলনায় দলের তেমন অগ্রগতি দেখতে পাননি তিনি। উয়েফার নানা রকম আইনি জটিলতায় পড়ে এক সময় দল ছাড়ার কথাও তুলেছিলেন লি ইয়ংহং। তবে সে পর্যন্ত আর দল ত্যাগ করেননি। হয়তো এক মালিক পক্ষের সমস্যা হলে দল ছেড়ে নিজেকে সে সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে নিচ্ছেন অন্য মালিকের রুচি মত মুনাফা না হলে তিনিও মনস্থির করছেন দল ছাড়ার। কিন্তু দিন শেষে হারাতে বসেছে ইতালি তথা ইউরোপের অন্যতম সফল ক্লাব এসি মিলান। এক সময় যে এসি মিলানের নাম শুনে ইউরোপের প্রতিটি ক্লাবের কপালে দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়তো আজ সেই এসি মিলান ইউরোপিয়ান ফুটবল থেকে ঝ’রে পড়া এক নক্ষত্রের নাম মাত্র।