জীবনের শুরুটা রূপকথার মতো হয়নি মেহেদী মিরাজের। জীবনের গল্পে বলার মতো কোনো রোমাঞ্চও ছিল না। গাড়িচালক বাবার সংসারে থাকলে যেমন হয়, তেমন করেই আর আট-দশটা বাচ্চার মতোই কাটছিল তার জীবন। গাড়িচালক বাবা চাইতেন ছেলে পড়ালেখা করে বড় হোক। কিন্তু ছোটবেলাতেই বল-ব্যাট হাতে তুলে নেওয়া মিরাজ চেয়েছিলেন গল্পটা অন্যরকম হোক। গল্পটা আজ অন্যরকমই। বয়স মাত্র ২১। বাচ্চা-বাচ্চা ভাবটা এখনও কাটেনি মেহেদী হাসান মিরাজের। এই বয়সেই দলের ভরসার জায়গাটা পোক্ত করে ফেলেছেন। দলের প্রতি মিরাজের আবেগও যেন একটু বেশিই।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর আগেই ২০১৬ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে জানান দেন মিরাজ। বাংলাদেশকে শিরোপা পাইয়ে দিতে না পারলেও ব্যাটিং-বোলিং নৈপুণ্যে টুর্নামেন্ট সেরা হন তিনি। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকা এই চটপটে নবীন তারকা তখনই জানান অন্তত ১৫ বছর বাংলাদেশকে সার্ভিস দিতে চান। নিজের কথার প্রমাণ দেন ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক সিরিজেই। বল হাতে নিয়েছিলেন ১৯ উইকেট, গড়েছিলেন এক সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। ওই সিরিজে ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে দুই ইনিংসে ৬টি করে নিয়েছিলেন ১২টি উইকেট। গড়েছিলেন এক ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ডও।
এমন দুর্দান্ত অভিষেকের পর টেস্ট দলের নিয়মিত সদস্য ডানহাতি অফ স্পিনার মেহেদি মিরাজ। মাঝে এক বছর বিরতি দিয়ে আবারও ম্যাচে দশ উইকেট নিয়ে দেশের ইতিহাসের রেকর্ডবুকে আবারও নিজের নাম তুললেন এই তারকা। সাকিবের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে দুইবার ম্যাচে দশ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব গড়লেন তিনি। শুধু কি তাই? একটি জায়গায় সাকিবের চেয়েও এগিয়ে এই ক্রিকেটার। বাংলাদেশ অধিনায়ক প্রথমবার ম্যাচে দশ উইকেট পেয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের ৭ম বছরে। সেবার খুলনা টেস্টে দুই ইনিংসেই নিয়েছিলেন পাঁচটি করে উইকেট। এরপর ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঢাকাতেও একইভাবে ম্যাচে দশ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। অর্থাৎ দুইবার ম্যাচে দশ উইকেট নিতে এক দশক লেগে গিয়েছিল সাকিবের। সেখানে মিরাজের এ কীর্তি গড়তে খেলতে হয়েছে কেবল তিনটি বছর। ২০১৬ সালে অভিষেকের পর ২০১৮ সালেই দ্বিতীয়বারের মতো নিলেন ম্যাচে দশ উইকেট। অভিষেক সিরিজের ম্যাচে ১২ উইকেট নেওয়ার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চলতি টেস্টে ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই দশ উইকেট পূরণ করেছেন মিরাজ।
রেকর্ড অবশ্য অভিষেকেই মিরাজের পিছু নিয়েছিল। অসংখ্য রেকর্ড গড়েছিলেন অভিষেক ম্যাচে। এনামুল হক জুনিয়রকে ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে ১৯ উইকেট পেয়েছিলেন তিনি। এমনকি অভিষেকের পর প্রথম দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে সর্বোচ্চ ১৮ উইকেট নেওয়ার বিশ্বরেকর্ড এতদিন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক বাঁহাতি পেসার জন জেমস প্যারিসের দখলে ছিল। ১৮৮৬ সালে এ কীর্তি গড়েন তিনি। ১৩০ বছর পর অভিষেকের সেই কীর্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন মিরাজ। বাংলাদেশ সফরে এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে চট্টগ্রামের পর মিরপুর টেস্টেও উইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র আড়াই দিনে জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। গত রবিবার মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দুই ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে ক্যারিবীয়দের ইনিংস ও ১৮৪ রানের ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। তবে প্রথম টেস্টের চেয়ে দ্বিতীয় টেস্টের জয়টাই যেন বেশি আনন্দের, বেশি গৌরবের। কারণ এই টেস্টটি দিয়েই প্রথমবারের মতো ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ দল। দলের এই দাপুটে জয়ের পেছনে বল হাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট নেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে তরুণ এই অফ স্পিনার তুলে নেন আরও ৫ উইকেট। সব মিলিয়ে মিরাজের নামের পাশে যোগ হয় ১২ উইকেট। বল হাতে এমন পারফরম্যান্সের প্রতিফলন পড়েছে র্যাঙ্কিংয়েও। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২ উইকেট নিয়ে টেস্ট বোলারদের র্যাঙ্কিংয়ে ক্যারিয়ার সেরা অবস্থানে উঠে এসেছেন মিরাজ। মিরপুর টেস্ট শুরুর আগে বোলারদের তালিকায় ৩০তম অবস্থানে ছিলেন মিরাজ। কিন্তু দুর্দান্ত বোলিংয়ে এক লাফে ১৪ ধাপ এগিয়ে ১৬তম অবস্থানে উঠে এসেছেন তিনি। মিরাজের রেটিং পয়েন্ট ৬৯৬। টেস্টে বোলারদের তালিকায় এটাই মিরাজের ক্যারিয়ার সেরা অবস্থান।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলনে মিরাজ বেশ গর্ব নিয়ে বলেন এ বছর তাইজুল ইসলাম ৪৩টি উইকেট পেয়েছে। সংবাদ সম্মেলন শেষে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে এই নবীন তারকাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় তাইজুলের পাশাপাশি তিনিও এ বছর ৪১টি উইকেটের মালিক। সবিস্ময়ে মিরাজের সরল হাসিমাখা উত্তর, “কি বলেন! তাই নাকি? আরেহ! ভালো তো!”
দেশকে ১৫ বছর সার্ভিস দেওয়ার কথা বলেছেন মিরাজ। বাকি দিনগুলো তো পড়েই আছে। কতটা বিস্ময় উপহার দেবেন, নিজেই হয়তো জানেন না।