চাটুকারিতাই যেখানে নিয়ম, সত্য সেখানে অসুস্থতা

সরকারের ক্রাকডাউন নিয়ে জেল ফেরত শহিদুল আলমের সাক্ষাৎকার

চাটুকারিতাই যেখানে নিয়ম, সত্য সেখানে অসুস্থতা

দক্ষিণ এশিয়ার ফটোগ্রাফিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব শহিদুল আলম গত আগস্ট মাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় চলাকালীন আন্দোলনের সময়ে আল জাজিরা’কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ ঘটনায় সারা বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্প্রতি জেলহাজত থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ভারতের ফার্স্টপোস্ট পত্রিকাকে দেয়া এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে শহিদুল আলম তার কারাবাস, বাক স্বাধীনতা, সাংবাদিকতা, অ্যাক্টিভিজম, রাজনীতি, পুলিশ কাস্টডিতে নির্যাতন এবং ভবিষ্যতে প্রিজন রিফর্ম নিয়ে তার চিন্তাভাবনার ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলেছেন। নাজমুল আহসানের নেয়া লম্বা আলাপচারিতাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন জবানের স্টাফ রাইটার মোহাম্মদ এ. বাসেদ।


নাজমুল আহসান : অ্যামনেস্টি আপনাকে ‘বিবেকের আসামী’ উপাধি দিয়েছে, যার মানে হচ্ছে শুধুমাত্র নিজের স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার কারণেই আপনাকে জেলে যেতে হয়েছিলো। আপনার মতো আরো অনেকেই আছে যারা ঠিক একই কারণে একই পরিণতির শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। কেন সরকার আপনাদের মতো মানুষদেরকে হুমকি বলে মনে করে? এ ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন?

শহিদুল আলম : আমেরিকান সাংবাদিক আই এফ স্টোনের মতে ‘সব সরকারই মিথ্যা বলে’।  ‘পরিমানে কম বেশি’ হতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ দেশের সরকারই মুখে বাকস্বাধীনতার স্বীকার করলেও, বাস্তবে তা অস্বীকার করে। বিশেষ করে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের ক্ষেত্রে এই কথাটি অধিক প্রযোজ্য কারণ তারা মুক্ত চিন্তাকে ভয় পায় এবং ফলস্বরূপ ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ করে। বেশিরভাগ দেশের সরকার ভয়কে ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে তারা ভুলে যায় যে ভয় এবং সাহস- দুটোই সংক্রমনশীল। আমি যা বলেছিলাম তা গোপন কিছু ছিলো না। আমি এমন কোনো তথ্য দেই নি যা সম্পর্কে মানুষের অগ্রিম কোনো ধারণা ছিলো না। পার্থক্যটা হচ্ছে সামাজিক সুবিচারের পক্ষে কাজ করা একজন হিসেবে হোক কিংবা স্ট্যাটাস ক্যু বজায় রেখে চলা রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচক হিসেবে হোক— অন্য অনেকের কথার চাইতে আমার কথা অধিক গ্রহণযোগ্যতার দাবিদার। আলোচ্য ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। আমার বক্তব্য প্রমাণ করেছিলো যে, এই ধরনের কথা সকলের সামনে কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলা সম্ভব। সরকারের ভয় পাওয়ার এটাই হচ্ছে মূল কারণ।

বেশিরভাগ দেশের সরকারই মুখে বাকস্বাধীনতার স্বীকার করলেও, বাস্তবে তা অস্বীকার করে। বিশেষ করে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের ক্ষেত্রে এই কথাটি অধিক প্রযোজ্য কারণ তারা মুক্ত চিন্তাকে ভয় পায় এবং ফলস্বরূপ ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ করে।

 

এখন প্রচারণার প্রলেপের আড়ালে সত্য পালিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমার ঐ বক্তব্য সত্য ও মিথ্যার মধ্যবর্তী একটি পর্দা সরিয়ে দিয়েছে যা অন্যান্য আরো অনেক ভিন্নমত পোষনকারীদের জন্য মত প্রকাশের জায়গা করে দিয়েছে। সরকার ভয় পাচ্ছে কারণ তারা মনে করছে এভাবে চলতে থাকলে মিথ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবে এবং তাদের প্রচারণার জাল ভেদ করে সত্য বেরিয়ে আসবে।

 

আপনার কারাবাস বাংলাদেশে বাক স্বাধীনতার পরিবেশ সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মনোযোগ আকৃষ্ট করেছিলো। বর্তমানে আপনি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া একজন স্বাধীন মানুষ যাকে সবাই বাক স্বাধীনতার পক্ষে একজন নির্যাতিত যোদ্ধা হিসেবে চেনে। বাংলাদেশে মানবাধিকারের বেদনাদায়ক অবস্থার ব্যাপারে আপনি আপনার এই নতুন পরিচয়কে কিভাবে ব্যবহার করবেন?

আমি একজন স্বাধীন মানুষ নই। আমি জামিনে মুক্তি পেয়েছি কিন্তু আমার বিরুদ্ধে মামলা এখনো চলমান। কাগজে-কলমে এখনো আমার মাথার উপরে সাত থেকে চৌদ্দ বছরের কারাবাসের শাস্তি ঝুলছে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে এমন এক পরিবেশে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো যেখানে আমি স্বাধীন ছিলাম না। এই পরিবেশের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। একই দমনমূলক আইনকানুন, একই দমনমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং একই ধরনের শাসনব্যবস্থা এখনো কার্যকর আছে। তাহলে স্বাধীনতা কোথায়? আমার ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রচুর পরিমানে বিচার-বিশ্লেষণ এটাই প্রমাণ করে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে এখন আর সহজেই আড়াল করে ফেলা সম্ভব নয়। প্রচুর উন্নয়ন কাজের আড়ালে সরকার অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোকে আড়াল করতে চাচ্ছে। বাকপটু জনযোগাযোগ, পা চাটা বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকমহল, দাস মানসিকতার মিডিয়া এবং রাষ্ট্রযন্ত্র- সবাই একজোট হয়ে দেখাতে চাচ্ছে যে জনগন ভালো আছে, সুখে আছে। আমার ঘটনাটি এই মিথকে ধ্বংস করতে পেরেছে। এখন আমার এবং আমার মতো অন্য যারা এই দেশে এবং দেশের বাইরে পৃথিবীজুড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের সকলের দায়িত্ব হচ্ছে এই যে পর্দাটি সরে গিয়েছে সেটি যেনো আর কখনো বন্ধ হতে না পারে তা নিশ্চিত করা। এখন থেকে আর পিছু ফেরা যাবে না।

উন্নয়ন কাজের আড়ালে সরকার অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোকে আড়াল করতে চাচ্ছে। বাকপটু জনযোগাযোগ, পা চাটা বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকমহল, দাস মানসিকতার মিডিয়া এবং রাষ্ট্রযন্ত্র- সবাই একজোট হয়ে দেখাতে চাচ্ছে যে জনগন ভালো আছে, সুখে আছে। আমার ঘটনাটি এই মিথকে ধ্বংস করতে পেরেছে

 

বিশ্বায়ণ ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের সরকার এবং কর্পোরেট মহল এই সুবিধাগুলোকে খুব উপভোগ করে। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে একই বিশ্বায়ণ কিন্তু বৈশ্বিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও সাহায্য করে। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ পরস্পরের সাথে রেষারেষিতে ব্যস্ত সেখানে একই দক্ষিণ এশিয়া এবং পাশাপাশি সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক্টিভিস্ট, আর্টিস্ট, লেখক, সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণের একাত্মতা প্রমাণ করে দিয়েছে যে স্ট্যাটাস ক্যু মেনে চলা রাজনীতিবিদদের মুখের কথায় এখন আর আমরা বিশ্বাস করি না। আমার ঘটনাটি প্রমাণ করেছে যে প্রয়োজনে আমরা সবাই এক হতে পারি। পাশাপাশি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে প্রেস সেন্সরশীপ এবং সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা কেবলমাত্র বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। উন্নত বিশ্বেও একই ঘটনা ঘটছে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও এডওয়ার্ড স্নোডেন যার উজ্বল দৃষ্টান্ত। ডিজিটাল স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার কারণে আজও তাদেরকে নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। দ্য ট্রাইকন্টিনেন্টাল ইন্সটিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চের মতো সংস্থাগুলো আজো শান্তি এবং অস্ত্র নিষ্ক্রিয়করণের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। সশস্ত্র বাহিনী বা সাম্প্রদায়িক শক্তির চাপ থাকার পরেও ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলোর বিচার বিভাগ বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে বেশকিছু শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। চাইলেই এখন আর আমাদেরকে ঠেলে সরিয়ে দেয়া সম্ভব নয় এবং আমরা আমাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যাবোই।

যদিও এটা পরিষ্কার ছিলো যে আল জাজিরা’র সাথে আপনার দেয়া সাক্ষাৎকারের কারণেই আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো কিন্তু অফিশিয়ালি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাত্রদের আন্দোলন চলাকালে আপনার ফেসবুক লাইভ ভিডিওগুলোকে আপনার গ্রেফতারের কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলো। সম্ভবত এমনটা করা হয়েছিলো কারণ আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে দেয়া বক্তব্যের জের ধরে গ্রেফতার করা ও শাস্তি দেয়ার পক্ষে কোনো আইনের অস্তিত্ব নেই। একারণেই আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষকে আইসিটি অ্যাক্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছিলো। এই আইনটি কালো আইন নামে পরিচিত। বর্তমানে এরকম আরো দুটি আইন করা হয়েছে- ব্রডকাস্ট আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই দুটি আইনই মিডিয়াকে আরো সরাসরি হুমকির মুখে ফেলছে। এমনকি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন অনুযায়ী টেলিভিশনের টকশোতে দেয়া যেকোনো বক্তব্যকে মিথ্যা ও বানোয়াট হিসেবে চালিয়ে দিয়ে যে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব। আপনি কি মনে করেন আপনার গ্রেফতার হওয়াটা এই আইনদুটো বাস্তবায়িত হওয়ার পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিলো?

ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও আমাদের মতো আরো অনেকে যারা অতি সম্প্রতি আমাদের মতামত প্রকাশ করেছি তাদের প্রত্যেককেই ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে, তবুও বলবো এই আইনদুটো মূলত করা হয়েছে আগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখে।

 

ভালো সাংবাদিকতা সর্বদাই অনুসন্ধানমূলক। এই অনুসন্ধানের কাজ করতে গিয়ে অধিকাংশ সময় এমন অনেক তথ্য বের হয়ে আসে যা ক্ষমতাধরদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। সংবাদকে যদি এমন একটি বস্তু হিসেবে মনে করা হয় যাকে যেকোনো জায়গায় যে কারো পক্ষে দমন করা সম্ভব তাহলে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ করার কাজটি সবসময়ই ক্ষমতাসীনদের কারো না কারো স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। এই আইনগুলো সৃষ্টি করার পেছনে মূল কারণ এটাই- মিডিয়াকে দলীয় পিআরে পরিণত করা, যারা কেবলমাত্র সরকারের গুনগানই করবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনেকদিন ধরেই সরকারের টেবিলে আলোচিত হচ্ছিলো, এবং আমার যতটুকু মনে হয় ব্রডকাস্ট আইন করার ব্যাপারটিও অনেকদিন ধরেই সরকারের মাথায় ছিলো। কিন্তু এটা বলতেই হবে যে দুটি আইনই খুব তাড়াহুড়ো করে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যদিও আমি, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও আমাদের মতো আরো অনেকে যারা অতি সম্প্রতি আমাদের মতামত প্রকাশ করেছি তাদের প্রত্যেককেই ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে, তবুও বলবো এই আইনদুটো মূলত করা হয়েছে আগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখে। যতোই নির্বাচন এগিয়ে আসছে সরকারও ততোই বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

২০১৪ সালে যা হয়েছিলো এবার আর তেমন কোনোকিছুর মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার পার পেতে পারবে না। একারণেই আপকামিং নির্বাচনকে সরকার ম্যানেজ করতে চাচ্ছে এবং এক্ষেত্রে দমনমূলক আইন ও কিছু পা চাটা প্রাইভেট টিভি চ্যানেলকে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর কাজে এই চ্যানেলগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিটিভির চাইতেও অধিক কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি, পোষা কুকুরের ভূমিকা পালন করা বুদ্ধিজীবীরাও আগামী নির্বাচনকে ম্যানেজ করার কাজে সরকারের ম্যানেজমেন্ট ম্যাকানিজমের অংশ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

মজার বিষয় হচ্ছে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নতুন নির্বাচিত সরকার পুরাতন সরকারের করে যাওয়া সবকিছুকে বাতিল করে দিলেও দমনমূলক আইন বা কাজের ক্ষেত্রে তারা এই কাজ তো করেই না বরং পারলে পুরোনো আইনের সাথে আরো নতুন কিছু মাত্রা যোগ করে। উদাহরণস্বরুপ, র‍্যাব এবং আইসিটি আইন উভয়ই কিন্তু ২০০১-২০০৬ সালের বিএনপি আমলে সৃষ্টি করা হয়েছিলো। পাশাপাশি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম আওয়ামী লীগ শাসনামলে স্পেশাল পাওয়ার আইন চালু করা হয়েছিলো। এসকল আইন যখন চালু হয় তখন বিরোধী দলগুলো এসবের প্রতিবাদ করলেও তারা নিজেরা যখন ক্ষমতায় আসে তখন আর তারা এগুলো বাতিল করে না। বর্তমানে নতুন যে সকল আইন করা হয়েছে দুঃখজনকভাবে তা হচ্ছে মূলত এই ধারাবাহিকতারই অংশ। আমি নিশ্চিত নতুন যে সরকার আসবে তারা পুরোনো সরকারের করে যাওয়া অনেক কিছু বাদ দিলেও এই দমনমূলক আইনগুলোকে যথাস্থানে রেখে দিবে। যেমনটা বাম রাজনীতিবিদ জোনায়েদ সাকি বলছেন :

“যতক্ষণ এবং যতদিন পর্যন্ত আমরা পাকিস্তান ভাঙ্গার পরে সৃষ্টি হওয়া এবং তখন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে আজ অব্দি চলে আসা সাংগঠনিক স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করতে পারবো না ততক্ষণ পর্যন্ত এদেশের জনগণ মুক্ত হতে পারবে না।”

 

অতি সম্প্রতি আপনার এক ফেসবুক পোস্টে আপনি বলেছেন যে এখন থেকে আপনি আপনার অধিকাংশ সময় প্রিজন রিফর্মের পেছনে ব্যয় করবেন। আমরা সকলেই জানি বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে কতটা ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করে। তবুও, আপনার কারাবাসের কোন অভিজ্ঞতাটি আপনাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে? রিফর্মের এই কাজটি আপনি কিভাবে করতে চাচ্ছেন?

যদিও আমি বেশকিছু সময় ধরেই আমাদের জেল সিস্টেমের ব্যাপারে কাজ করতে চাচ্ছিলাম, তবে এটা বলতেই হবে এ ব্যাপারে আমার খুব বেশি ধারণা ছিল না। প্রায় একশো দিন জেলে থাকার ফলে আমার এমন কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে যা অন্য কোনো উপায়ে আমার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব ছিলো না। আমি এমন অসংখ্য মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি যাদেরকে বিনা দোষে গ্রেফতার করা হয়েছে, এমন অনেককে দেখেছি যাদের জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই (প্যারা লিগাল সুবিধা যেটা দেয়া হয় সেটা খুবই সীমাবদ্ধ)।

পরিবর্তন আনার মতো অনেক ক্ষেত্র বাংলাদেশের জেলগুলোতে রয়েছে। কারাগারে শিক্ষিত বন্দিদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অশিক্ষিত-কম শিক্ষিত বন্দিদের জন্য এডাল্ট এডুকেশন ক্লাসের ব্যবস্থা করেছেন। তাদের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে আমিও কারাগারের ভেতরে পুষ্টিকর খাবারের জন্য একটি সবজি বাগান, গান-বাজনার মাধ্যমে বিনোদনের ব্যবস্থা করার জন্য একটি ব্যান্ডদল ইত্যাদির মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভেবেছি। আমার পরিবার ও বন্ধুদের সাহায্যের মাধ্যমে আমার পক্ষে যতটুকু করা যায় ততটুকু আমি করেছি।

তবে, এদেশের কারাগার ব্যবস্থায় বড় ও কার্যকরী কোনো পরিবর্তন আনতে হলে কর্তৃপক্ষের সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়। পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের সিস্টেমের ভেতরে থেকে কাজ করতে হবে, সিস্টেমের ভেতরেই কারাসংস্কৃতি বদলানোর ব্যবস্থা খুজে বের করতে হবে। আমার মতে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে পারলে গতানুগতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব।

পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ ইত্যাদির মতো কিছু বিষয়ে আমি এই মুহূর্তে কাজ করার চেষ্টা করছি। তবে কারাগারে বসবাসকারী অনেক বড় একটা অংশের ওখানে থাকার একদমই কোনো কারণ নেই এবং তাদেরকে বের করে আনার ব্যাপারে আমি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাথে কাজ করতে আগ্রহী। বর্তমানে আমি জেল ভিজিটের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি যাতে করে আমি আমার কারাবাসের সময়ে পরিচিত হওয়া সাথীদের সাথে দেখা করতে পারি। কারাগারের ভেতরে বিভিন্ন পর্যায়ে এই মুহূর্তে আমার অনেক বন্ধু রয়েছে এবং এই পরিচয়কে আমি পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করতে চাই।

 

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই আপনাকে টর্চার রিলেটেড কমপ্লিকেশনের কারণে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। এমনকি আপনাকে গ্রেফতার করার পরে যখন আপনাকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন আপনাকে বলতে শোনা গিয়েছিলো যে আপনাকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছিলো যার ফলে আপনি যে পাঞ্জাবি পরিহিত ছিলেন সেটাতে রক্তের দাগ লেগে গিয়েছিলো এবং সেটাকে পুনরায় ওয়াশ করতে হয়েছিলো। পুলিশ কাস্টডিতে নির্যাতন বাংলাদেশে একটি স্বাভাবিক ও বহুল আলোচিত ঘটনা। আপনি কি আমাদেরকে বিস্তারিত জানাবেন পুলিশ কাস্টডিতে আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করা হয়েছিলো?

অন্যদের কাছ থেকে পুলিশি নির্যাতনের যেসকল বর্ণনা আমি শুনেছি সে তুলনায় আমার নির্যাতন নিতান্তই সামান্য ছিলো। মাড়িতে ব্যাথার কারণে কারাগারের প্রথম আড়াই মাস আমি ঠিকমতো খেতে পারি নি। কিছুদিনের জন্য আমি ভার্টিগোতে (মাথা ঘোরা) আক্রান্ত ছিলাম। উভয় রোগই বর্তমানে প্রায় সেরে গিয়েছে। গ্রেফতার হওয়ার পর আমাকে যেই মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সেটা থেকে সেরে উঠতে আমার আরো সময় লাগবে। কারাগারে কিছুদিন হ্যালুসিনেশন কাজ করলেও এখন সেটাও কেটে গিয়েছে। তবে যেই অপমানের ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে তা আমাকে আজীবন তাড়া করে বেড়াবে।

অপমানের ব্যাপারটাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটা হয়েছিলো আমাকে গ্রেফতার করার রাতে। আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। আমি বাধা দিচ্ছিলাম, এবং অধিকাংশ শারীরিক ব্যাথা আমি পেয়েছিলাম সাদা পোশাকের বাহিনীর সাথে ধস্তাধস্তির সময়ে, যখন তারা আমাকে বাসা থেকে বের করে জোর করে প্রথমে লিফটে ও পরে মাইক্রোবাসে ঢুকাতে চাচ্ছিলো। তারা হয়তো আমাকে আঘাত দিতে চায়নি কিন্তু তাদের আমার উপরে জোরজবরদস্তি চালানোর ফলেই আমি আঘাতগুলো পেয়েছিলাম। আমার দু’হাত পেছনে নিয়ে তাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো এবং কব্জির সাথে হ্যান্ডকাফের ক্রমাগত ঘষা লাগার কারণে কিছু জায়গায় আমরা চামড়া কেটে গিয়েছিলো। তবে এগুলো তেমন কোনো বড় ঘটনা ছিলো না। একদিকে আমি চিৎকার করছিলাম আর অপরদিকে কেউ একজন আমার মুখে চাপা দিতে চাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে আমি তার হাতে কামড় দিতে সক্ষম হই। এরপর তারা আর আমার মুখে হাত দিতে আসে নি, যদিও তারা আমার চোখ কালো কাপড়ে বেধে ফেলেছিলো।

তারা আমার উপরে প্রচণ্ড রেগে ছিলো কারণ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী আমি স্বীকারোক্তি দিচ্ছিলাম না। এই পর্যায়ে তারা আমার মুখে আঘাত করে এবং রক্ত পড়া তখন থেকেই শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক মাস আমার মুখে যেই ব্যাথা ছিলো তার কারণ ছিল এটি। ব্যাথাটি এখনো বিদ্যমান। আমি আসলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যখন তারা আমাকে হুমকি দিচ্ছিলো যে তারা আমার স্ত্রীকেও তুলে নিয়ে আসবে। এক পর্যায়ে তারা কাকে যেন পিন নিয়ে আসতে বললো এবং আমাকে পানিতে শ্বাসরোধ করার বিস্তারিত শোনাতে শুরু করলো। সম্ভবত আমাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্যই এই কথাগুলো বলা হচ্ছিলো। তারা চোখ বাধা অবস্থায় আমাকে সিড়ি দিয়ে উঠানামা করাচ্ছিলো, ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ঘোরাচ্ছিলো। তারা বার বার বলছিলো যে এখনো কিছুই শুরু হয় নি, একটু পরে আরো কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।

সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যখন আমার চোখের উপর থেকে কাপড় তুলে নেয়া হলো এবং আমি আমার সামনে একটা বড় পুকুর দেখতে পেলাম। তখনো আমার হাতে হ্যান্ডকাফ পড়ানো ছিলো, এবং যদিও আমি একজন ভালো সাতারু তবুও যদি আমাকে সে রাতে পুকুরে ফেলে দেয়া হতো তবে আমার পক্ষে কোনোভাবেই বেঁচে ফেরত আসা সম্ভব ছিলো না। ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার পর তারা আবারো আমার চোখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেয় এবং একটি অফিসে নিয়ে যায় যেখানে আমাকে দুটি টেবিলের মাঝখানের সামান্য একটু জায়গায় রাতে ঘুমাতে হয়েছিলো। শারীরিক যন্ত্রণার চাইতেও আমাকে যে দুটি ব্যাপার অধিক পীড়া দিচ্ছিলো তা হলো একে তো রুমটির টয়লেটের দরজা খোলা রাখা হয়েছিলো তার উপরে বাইরের দুনিয়ার সাথে আমার কোনো যোগাযোগই ছিলো না।

কেরানীগঞ্জ জেলে যাওয়ার যাত্রাটি যন্ত্রণাদায়ক না হলেও অসহনীয় ছিলো। অন্যান্য বন্দিরা প্রায় সকলেই আমাকে চিনতে পেরেছিলো এবং অনেক সাহায্য করেছিলো। কেউ একজন আমাকে একটি কলা ও পাউরুটি দিয়েছিলো। অপর আরেকজন দিয়েছিলো পানি। আমাদের সকলের হাতেই হ্যান্ডকাফ পড়ানো ছিলো। তারা বার বার আমাকে বলছিলো তারা আমাকে নিয়ে গর্বিত এবং তারা আমার কাজগুলোকে কি পরিমাণ সমর্থন করে। একই ঘটনা জেলের ভেতরেও ঘটেছিলো। অনেকেই আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো এবং বলছিলো তারা আমার জন্য কি পরিমাণ প্রার্থনা করেছে। এই ব্যাপারগুলো আমাকে ঐরকম বেদনাদায়ক অবস্থার ভেতরেও অনেক আরাম দিয়েছিলো।

এমনকি কারাগারের ভেতরেও মানুষ আমাকে চিনতে পেরেছিলো এবং সম্মান দিয়েছিলো। কারাগারের ভেতরে ‘আমদানি’ নামক একটি ওয়ার্ড আছে যেখানে সাধারন বন্দিদেরকে টাকার বিনিময়ে প্রেরণ করা হয়। আমাকে সৌভাগ্যবশত এই ওয়ার্ডে যেতে হয় নি। এর বদলে আমাকে ‘সূর্যমুখী’ ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছিলো যেখানে আরো একবার বন্দিরা আমাকে চিনতে পেরে সম্মান দেখিয়েছিলো।

আমাকে একজন অপরাধ প্রমাণিত হওয়া খুনির সাথে একই সেলে রাখা হয়েছিলো যে আমাকে ঘুমানোর সময় বালিশ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এক খণ্ড কাপড় ও পিপাসা মেটানোর জন্য পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। ইতিমধ্যে লকআপের সময় পেরিয়ে গিয়েছিলো যার ফলে সেদিনের মতো আর রাতের খাবার যোগাড় করা সম্ভব ছিলো না। আমার খুনি সেলমেট ও আমি কলা ও পাউরুটি ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম। কারাগার কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছিলো পরের দিন ভোর পাঁচটায় আমাকে কেস টেবিলে যেতে হবে।

 

আমাকে একজন অপরাধ প্রমাণিত হওয়া খুনির সাথে একই সেলে রাখা হয়েছিলো যে আমাকে ঘুমানোর সময় বালিশ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এক খণ্ড কাপড় ও পিপাসা মেটানোর জন্য পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। ইতিমধ্যে লকআপের সময় পেরিয়ে গিয়েছিলো যার ফলে সেদিনের মতো আর রাতের খাবার যোগাড় করা সম্ভব ছিলো না। আমার খুনি সেলমেট ও আমি কলা ও পাউরুটি ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম। কারাগার কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছিলো পরের দিন ভোর পাঁচটায় আমাকে কেস টেবিলে যেতে হবে। আমাকে গুড়ি মেরে কেস টেবিলে যেতে বলা হয়েছিলো, কিন্তু সারা শরীরের ব্যাথার কারণে আমার পক্ষে নত হওয়া সম্ভব ছিলো না। শেষমেষ হাটু গেড়ে আমি টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাই। একজন ওয়ার্ডেন এতে আপত্তি জানিয়েছিলো কিন্তু বাকিরা তাকে বাধা দেয়। যে অফিসার আসামীদের নাম তালিকাভুক্ত করছিলো সেও আমাকে চিনতে পেরেছিলো এবং বসার জন্য একটি চেয়ার দিয়েছিলো। সেলে ফিরে যাওয়ার পর অনেক কয়েদি আমাকে দেখতে এসেছিলো এবং কে কিভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারে সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলো। তারা আমাকে খাওয়ার জন্য পানি ও বিস্কুট দিয়েছিলো এবং আমরা একসাথে দুপুরের খাবারও খেয়েছিলাম। এমনকি তারা ওয়ার্ডেনের সাথে লবিং করে আমাকে নিজস্ব একটি কামরা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিলো। এই কামরাটি অবশ্য সিঁড়ির পাশে ছিলো এবং এর ভেতরে প্রচুর ধূলা ছিলো। মেঝেতে শুতে শুতে আমি এলার্জিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ি, সম্ভবত নিঃশ্বাসের সাথে ধূলা প্রবেশের কারণে। এর ফলে আমার শ্বাস-প্রশ্বাসে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। যাই হোক, আমাকে যথাযোগ্য চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার জন্য আমার আইনজীবী ও পরিবার উভয়েই কারা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছিলো ও আপিল করেছিলো। অতঃপর আমাকে কারা হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো।

হাসপাতালে ডাক্তারকে আমি আমার সমস্যাগুলোর কথা জানাই এবং আমার পরিবারের আপিলের কারণে আমাকে কারাগারের বাইরের একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। এখানে আমার বেশ কিছু টেস্ট করা হয়েছিলো। আমার মূল সমস্যা ছিলো মুখে আঘাতের কারণে সৃষ্ট ব্যাথা কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় নি। অতঃপর আমাকে কারা হাসপাতালে ফেরত পাঠানো হয় এবং আমি এখানকার ডেন্টিস্টকে আমার সমস্যার কথা বলি। তিনি আমাকে কিছু ঔষুধ দেন এবং এই বলেন যে এই ব্যথা আরো কয়েক মাস থাকবে। তিন সপ্তাহ পরে যখন আমি আবার তার কাছে চেকআপের জন্য যাই তখনও আমার মুখে ব্যথা ছিলো এবং আমি শক্ত কোনো খাবার খেতে পারছিলাম না। ডেন্টিস্ট পরীক্ষা করে বলেছিলেন ব্যথা আরো কয়েক মাস থাকবে এবং একটা পর্যায়ে চলে যাবে। তিনি আমাকে গরম পানিতে লবন মিশিয়ে দিনে বেশ কয়েকবার কুলি করতে বলেছিলেন। তার এই বুদ্ধিটি কাজে এসেছিলো এবং আড়াই মাসের মধ্যে ব্যথা অনেকটাই কমে গিয়েছিলো।

পরবর্তীতে আমাকে ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত কারাগারের ‘ডিভিশন’ নামক অংশে স্থানান্তরিত করা হয়। এখানকার কামরাটি আকারে বড় ও পরিষ্কার ছিলো, খাবারের মান ভালো ছিলো ও ঘুমানোর জন্য এখানে একটি খাটও ছিলো। আমাকে সপ্তাহে একদিন ‘অফিস কল’র সুযোগও দেয়া হয়েছিলো। এই সময়টাতে আমি আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে নিরিবিলি পরিবেশে আধা ঘন্টার জন্য কথা বলতে পারতাম। আমার পরিবার আমার পড়ার জন্য বই ও লেখার জন্য কাগজ-কলম নিয়ে আসতো যা কারাগারের ভেতরে আমার জীবনকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছিলো। ডিভিশনের এই কামরাটিতে একটি হাই কমোডও ছিলো যা আমার টয়লেট ব্যবহারের কাজকে সহজ করে দিয়েছিলো। ঠিক এই সময়ে আমি আমার সেলের বাইরে বাসা বাঁধা এক ঝাঁক চড়ুই পাখির সাথে বন্ধুত্ব করতে শুরু করি। আমি ফেলে রাখা একটি কার্ডবোর্ডের সাহায্যে একটি পাখির খোপ তৈরি করি যেখানে এই চড়ুই পাখিগুলো দিনশেষে এসে আশ্রয় নিতো। কারাগার থেকে ফেরার সময়ে আমি এই খোপটি আমার সেলের পাশ্ববর্তী কয়েদির কাছে দিয়ে এসেছি। এই পাখিগুলোর দেখভালের ব্যাপারে তিনি আমাকে প্রতিজ্ঞাও করেছেন।

আমার রক্তভেজা (পরবর্তীতে ওয়াশ করা) পাঞ্জাবি তারা আর আমাকে ফেরত দেয় নি।

 

মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনার আইনজীবীরা প্রায় চার বারের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরে হাই কোর্ট থেকে আপনার জামিনের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। বেশকিছু বিচারক লজ্জাবোধ করাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে আপনার জামিনের শুনানি খারিজ করে দিয়েছিলেন, জামিন দেয়া হবে কি হবে না সেটার সিদ্ধান্ত নেয়া তো পরের কথা। এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে কি ধারণা পাওয়া যায়?

দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত থাকা এবং বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের মাঝে কোনো তফাত না থাকা বিষয়ে আইনজীবীদের নিয়মিত অভিযোগের পরেও ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে মাঝে মাঝে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরুপ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ধনঞ্জয় যশোবন্ত চন্দ্রচুদের “ভিন্নমত হচ্ছে গণতন্ত্রের সেইফটি ভালভ। যদি এই সেইফটি ভালভকে না রাখা হয় তাহলে প্রেশার কুকার ফেটে যাবে”র মতো সিদ্ধান্ত আশার খোরাক যোগায়। বাংলাদেশি বিচারকদের এরকম কোনো রায় দিতে যদিও আমি এখনো দেখিনি তবে হাই কোর্টের বিচারকদের যে বেঞ্চ আমাকে জামিন দিয়েছেন তারা এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে আমাকে যা বলার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছিলো তার সাথে আমি আসলে যা বলেছিলাম তার কোনো মিল নেই। আমাদের বিচারকদের এমন রায় আমার মাঝে আশার সঞ্চার করে। আমি একজন আশাবাদী মানুষ, এবং আমি এখনো বিশ্বাস করি যদি মানুষ পথ দেখায় তবে বিচারব্যবস্থা অবশ্যই তাদের নিজস্ব কণ্ঠ ফিরে পাবে। এধরনের ঘটনা এর আগেও একবার ঘটেছিলো ২০১০ সালে যখন তৎকালীন সরকার আমার ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ নামক প্রদর্শনীটিকে বন্ধ করতে চেয়েছিলো। জনতার প্রতিবাদের মুখে কোর্ট সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিতে বাধ্য হয়েছিলো যার ফলে সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে হয় এবং আমার প্রদর্শনীটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। যদিও অবস্থা এক্ষণ আরো ভয়ানক কিন্তু তবুও আমরা আশা ছেড়ে দিতে পারি না। জনতাকে অবশ্যই পথ দেখাতে হবে। এটা বর্তমান সময়েও প্রযোজ্য।

 

আপনি যখন জেলে ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রয়টার্সের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে আপনি ব্যবহার করতে ও উস্কানি দিতে চেয়েছিলেন। তিনি আপনার পরিবারের সদস্যদের প্রতি, বিশেষত আপনার মৃত নানার প্রতি আপনার আচরণকেও প্রশ্নবিদ্ধ বলেছেন। ঐ মুহূর্তে আপনার পক্ষে এসকল অভিযোগের জবাব দেয়া সম্ভব ছিলো না। এখন কি কিছু বলতে চান?

আমি শুরু করতে চাই এই বলে যে রয়টার্স আমার স্ত্রীর কাছ থেকেও মন্তব্য চেয়েছিলো। রেহনুমা বিবৃতিতে লিখেছিলো “পুলিশ শহিদুলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং ওর বিরুদ্ধে তদন্তও চলছে। এরকম পরিস্থিতিতে আমার মনে হয় না ক্ষমতায় থাকা মানুষদের এমন কোনো কথা বলা উচিত যা তদন্তের কাজকে বাধাগ্রস্থ কিংবা বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করতে পারে।” আমি জানি না কেনো কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে রয়টার্স তাদের লেখায় এই তথ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত করে নি। যদিও ও যা বলেছিলো তা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

একজন মানুষের তার আত্মীয়-স্বজনের উপরে কোনো হাত নেই। সে পছন্দ করে তার বন্ধুদের।” এটা সত্যি যে আমার নানীর ভাই আব্দুস সবুর খান একজন যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। আমি তার রাজনীতি মোটেই সমর্থন করি না এবং আমি নিজেই তার এই রাজনীতির ব্যাপারে পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমালোচক।

 

আত্মীয়-স্বজনের প্রশ্নে বলতে গেলে সলিল ত্রিপাঠীর একটি উক্তির কথা বলতে হয়। তিনি বলেছেন “একজন মানুষের তার আত্মীয়-স্বজনের উপরে কোনো হাত নেই। সে পছন্দ করে তার বন্ধুদের।” এটা সত্যি যে আমার নানীর ভাই আব্দুস সবুর খান একজন যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। আমি তার রাজনীতি মোটেই সমর্থন করি না এবং আমি নিজেই তার এই রাজনীতির ব্যাপারে পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমালোচক। কিন্তু তখন এমন একটা সময় ছিলো যখন একটি বড় পরিবারের একেক জন সদস্য একেক দলের রাজনীতি করতেন। সবুর খানের বড় ভাই ছিলেন আব্দুল গনি খান। তারা উভয়েই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং একজন আরেকজনের বিপক্ষে দাড়িয়েছিলেন। সবুর খান নির্বাচন করেছিলেন মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে যেখানে গনি খান করেছিলেন যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে। পারিবারিক ইতিহাসে কথিত আছে যে আব্দুল গনি খান একজন বোরকা পরা মহিলার মধ্যে তাদের মায়ের অবয়ব হাজির করেছিলেন যা তাকে যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করেছিলো। পরবর্তীতে যখন আওয়ামী লীগ গঠিত হয় তখন তিনি এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ছিলেন।

পারিবারিক ইতিহাসে এও জানা যায় যে ১৯৭২ সালে সবুর খান যখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে জেলে ছিলেন তখন তার সাথে দেখা করতে আমার নানী এবং আব্দুল গনি খান কারাগারে গিয়েছিলেন। সে সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গনি খানের হাত দিয়ে তখনকার সময়ে ১০,০০০ টাকা সবুর খানের কাছে পাঠিয়েছিলেন কারাগারের ভেতরে খরচ করার জন্য। ইতিহাসকে সুবিধাজনক ও নিজ স্বার্থ অনুযায়ী ব্যবহার করাটা ক্ষেত্রবিশেষে কাজে দিলেও তা প্রচুর ভুল ধারণারও জন্ম দেয়। তবে আমাকে দেশে ও বিদেশে আমার সে সকল বন্ধুদেরকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে যারা আমার চরিত্র নষ্ট করার সকল চেষ্টার পরেও শেষ পর্যন্ত আমার পাশে ছিলেন।

আর আন্দোলনে উস্কানি দেয়ার ব্যাপারে বলতে চাই যে আমি কেবলমাত্র তাই বলেছিলাম যা ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছিলো। এই লেখার যে সকল পাঠক এ ব্যাপারে ধারণা পেতে চান তাদেরকে আমি বলবো ৪ আগস্টের আন্দোলনের সময়ে আমার ফেসবুক লাইভ ভিডিওতে বলা কথার সাথে পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে সতর্কভাবে সাজানো-গোছানো বানোয়াট যুক্তি ও বক্তব্যগুলো নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক তাসনীম খলিলের লেখাটি পড়তে। এই লেখাটিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যাবে আমি সেদিন সেসব বিষয়েই কথা বলেছিলাম যেগুলো ইতিমধ্যে সকলের চোখের সামনে ঘটে গিয়েছিলো। আমার বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়ার অভিযোগ শুধু একথাই প্রমাণ করে যে সরকারদলীয় লোকেরা ‘কারণ’ ও ‘ফলাফল’ এর মধ্যকার যুক্তিতে বিশ্বাসী নন।

সবশেষে যা বলতে চাই তা হচ্ছে অসুস্থতা নির্নয় করা হয় শারিরীক অবস্থার উপরে ভিত্তি করে। যেখানে চাটুকারিতা, মেরুদণ্ডহীনতা ও দাস মনোবৃত্তিই হচ্ছে নিয়ম সেখানে সত্য কথা বলাকে অসুস্থতা হিসেবেই দেখা হবে। আমি আশা করি এই অসুস্থতা একদিন প্লেগের মতো করে জনে জনে ছড়িয়ে পড়বে।