জিজেকের জোকস’ কি জিনিস, তা নতুন কইরা ডেস্ক্রাইব করার দরকার নাই মনে হয়। স্লোভেনিয়ান দার্শনিক স্লাভো জিজেকের লেখালেখি, লেকচার ও ইন্টারভিউ’র সাথে যারা পরিচিত, তারা অলরেডি জানেন যে, জিজেক তার আইডিয়া, থটস ইত্যাদিরে ব্যাখ্যা করতে প্রায়ই জোকসের সাহায্য নেন। সেই সব জোকসরে একত্র করে ছাপাইছে এমআইটি প্রেস। সেই বইয়েরই নির্বাচিত, বলা উচিত, সুনির্বাচিত অংশের তরজমার নামই ‘জিজেকের জোকস’। তরজমা করেছেন কে এম রাকিব।
জোকস কি? জোকসের সাথে দর্শনের রিলেশন কি? বা আছে কিনা আদৌ? ভাবা যাইতে পারে। এই যে, ভাবতে গিয়া ফ্যাসাদে পড়া গেল—ভাবনা কোত্থেকে শুরু করি? জোকস দিয়াই শুরু করি। ভাবনা নিয়া একটা পপুলার জোকস আছে আমাদের বন্ধুমহলে— ভাবতে ভাবতে কী ভাবতেছি তা ভুলে যাওয়া! এই জোকসের ফানি এসেন্সটা হইলো, চিন্তক বেচারার চিন্তা করার ক্ষমতারে কটাক্ষ করা। কিন্তু, অন আ সিরিয়াস নোট, চিন্তার গভীরে ঢুকতে ঢুকতে আসলে চিন্তাটা কি নিয়া ছিলো, তা মিসিং হওয়ার নজির খুবই কমন! যেমন, জিজেকের জোকস নিয়া লেখতে গিয়া আমি হয়ত ভাবতেছি রেলিজিওন নিয়া! ফানি না?
এক অর্থে ফানি না। পুরা দুনিয়াটারেই একটা আয়রনি হিসাবে দেখার সিলসিলা আছে ট্রাডিশনাল সোফিস্টদের মধ্যে, দুনিয়া আর এর যাবতীয় কার্যকলাপের মধ্যে এক ধরণের ইন্টার্নাল অ্যাবসার্ডিটি অনুভব করেন তারা, যা তাদের লেখাপত্র বা গানের ভিতরে মওজুদ। ধরেন, দুনিয়ার এই ইন্টার্নাল অ্যাবসার্ডিটিতে দিশাহারা হইয়া তারা বলেন—‘এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া, এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই!’ বা ধরা যাক মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ কিংবা শংকরাচার্যের ‘মায়াবাদ’— দুনিয়া পুরাটাই এক মায়া, এই বাস্তবতায় থাইকা দুনিয়ার যাবতীয় কার্যকলাপ এবং সেইখানে রোল প্লে করতে থাকারে একটা গ্রেট জোক মনে হওয়াই তো স্বাভাবিক। এইজন্য দুনিয়ারে সুফিরা বলেন, দুই দিনের খেল তামাশা; হিন্দু ধর্মের সিলসিলায় চালু আছে ‘ঈশ্বরের লীলাখেলা’ ফ্রেজ, যার সেক্সুয়াল এসেন্স বাদেও একটা আয়রনিক টোন আছে। তাইলে, ধর্মের সাথে জোকসের একটা কানেকশন তো পাওয়া গেল!
২.
চিন্তার গভীরতা নিয়া বলতেছিলাম—ভাবতে ভাবতে কি ভাবতেছি তা ভুলে যাওয়া। মহামতি উইল ডুরান্ট এই মর্মে তার ‘দ্য স্টোরি অব ফিলোসফি’ গ্রন্থের ভূমিকায় জানাইতেছেন, অধুনা জ্ঞানের মাইক্রো মাইক্রো শাখা-প্রশাখা-অশাখা-কুশাখা নিয়া ‘ডিপ থিংকিং’ করতে করতে, আমরা চিন্তা বা দর্শনরে, বিজ্ঞানরে, ডিহিউম্যানাইজড কইরা ফেলছি, আর্ট বা ফিলোসফির মানবিকীকরণের আলাপ আর তুলতেই চাই না, যেন ওইটা খুব ওল্ড ফ্যাশন।
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে দর্শনের ইতিকথা বা স্টোরি লিখতে গিয়া ডুরান্টের ঝামেলাও ছিলো এই হিউমার নিয়া— দর্শনের মানবিকীকরণ করতে গিয়া হিউমার একটু কি বেশি হইয়া গেলো? পণ্ডিতেরা তো আস্তা রাখবে না। ডুরান্ট ঝুঁকি না নিয়া ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’ নীতিতে আগাইলেন— “এ ইতিকাহিনীতে কিছু রসবোধের আমদানি করা হয়েছে কারণ, আনন্দহীন নীরস পাণ্ডিত্য শুধু যে বিজ্ঞতার খেলাপ তা নয়, বরং যথাযথ প্রেক্ষিতে যে রসবোধের জন্ম তার সঙ্গে দর্শনের রয়েছে নিকট আত্মীয়তা— এরা একে অপরের আত্মাস্বরুপ। …তারা (পণ্ডিতেরা) মনে করেন, রসবোধের খ্যাতি রাজনীতিবিদ আর দার্শনিকদের জন্য এক সর্বনাশা ব্যাপার…।”
এই দেশের অনেক পোলাপানের জীবনের প্রথম পড়া ‘দর্শন’র বই কোনটা? হালকা জেনারেলাইজড কইরা বলি—ঈশপের গল্প। ঈশপের গল্প আমাদের ক্রিটিকাল থিংকিং-এর পয়লা সবক দ্যায়। কিন্তু এইটা তখনই বলা যায়, যদি আমি গোপাল ভাঁড়ের ঘটনাগুলারে স্রেফ জোক হিসাবে পড়তে চাই! গোপালের ঘটনাগুলা বরং ক্রিটিকাল থিংকিং-এর ক্ষেত্রে মোর ইফেক্টিভ
তো, সেই সিলসিলা আমাদের বাঙালি জীবনেও আমরা দেখি। এই দেশের অনেক পোলাপানের জীবনের প্রথম পড়া ‘দর্শন’র বই কোনটা? হালকা জেনারেলাইজড কইরা বলি—ঈশপের গল্প। ঈশপের গল্প আমাদের ক্রিটিকাল থিংকিং-এর পয়লা সবক দ্যায়। কিন্তু এইটা তখনই বলা যায়, যদি আমি গোপাল ভাঁড়ের ঘটনাগুলারে স্রেফ জোক হিসাবে পড়তে চাই! গোপালের ঘটনাগুলা বরং ক্রিটিকাল থিংকিং-এর ক্ষেত্রে মোর ইফেক্টিভ—গোপাল ঈশপের মত নৈয়ায়িক না, জীবনের হরেক রকম বাস্তবতার ভিতর দিয়া তার চিন্তাগুলি ইমার্জ করে, যে কারণে গোপালের গল্পগুলাও অনেক ক্ষেত্রে ভালগার, ভদ্র সমাজে যার অনেকগুলিই হয়ত পড়া যায় না।
৩.
ওকে, কোটেশন দিয়া নিই। ভিটগেনস্টাইনের বিখ্যাত একখান কোটেশন অনলাইনে ‘জিজেক’স জোকস’র এডভার্টাইজিং প্রিফেসে পাওয়া যায়—‘শুধু জোকস দিয়াই খুব ভাল একটা দর্শনের বই লেখা যায়।’ মানে, জোকস বা স্যাটায়ারের সিরিয়াস কোন ফিলোসফিকাল বেজ বা ভূমিকা আছে কিনা, তা নিয়া তো ক্ল্যাসিক ফাসাদ আছেই। সেই ফাসাদে না ঢুকি। বরং একটা তথ্য এই দেওয়া যাক যে, ‘জিজেক’স জোকস’ বইয়ের ভূমিকা-লেখক, বিখ্যাত স্কটিশ মিউজিশিয়ান মোমুস তার পয়লা উপন্যাসের নাম রাখছেন ‘দ্য বুক অব জোকস’, যেই বইটা জোকসে জোকসে একটা ফ্যামিলির কাহিনী বয়ান করে। মোমুসের জোকসের প্রতি এই পক্ষপাতের পেছনে জিজেকের যে একটা হাত আছে, তাও আমরা জানতে পারি তার লেখা ভূমিকা থেকে। ভিটগেনস্টাইন বেঁচে থাকলে খুশি হইতেন।
কিন্তু জোকস কি লেখা যায়? মানে, ইমিটেট করা যায়, তৈরি করা যায়? জোকস গল্প-উপন্যাসের মত আধুনিক যুগের ক্রিয়েশন না, এইটা পৃথিবীর শুরু থিকাই আছে। তাই আধুনিক যুগে ইমার্জ করা আর্টফর্মগুলির মত এইটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক না, এর চরিত্র কালেক্টিভ। ননসেন্স রাইমের ক্ষেত্রে অরওয়েল তার ১৯৪৫ সালে লেখা ছোট্ট প্রবন্ধ ‘ননসেন্স রাইম’এ যে দুইটা কথা বলছেন, তা খাপে খাপ মিলা যায় জোকসের সাথেও। অরওয়েল প্রথম কথা বলছিলেন এই যে, আধুনিক যুগে সচেতনভাবে ননসেন্স রাইম বানানো শুরু করার আগে, ননসেন্স রাইম বলতে যা ছিলো, তার পরিমাণ খুবই অল্প এবং অ্যাডওয়ার্ড লেয়ারই প্রথম ব্যক্তিউদ্যোগে ননসেন্স রাইম লেইখা সফল হন। তার দ্বিতীয় বক্তব্য ছিলো এই যে, ননসেন্স রাইম আসলে বানাইয়া লেখার কোন জিনিস না। এইটা মানবসমাজের কালেক্টিভ কনশাসনেসের ভিতর দিয়া গ্রো করে। এবং সেইটাই ভালো।
এই ব্যাপারে অবশ্য আলাপ করছেন জিজেক নিজেও। ‘লেস দ্যান নাথিং’-এ জিজেক জোকসের লেখক থাকা-না থাকা নিয়া আলাপ তুলছেন। জোকসের যে সাধারণত অথর থাকে না, এই ব্যাপারে ইশারা দিয়া তিনি বলতেছেন, জোকস হইলো “ভাষার অনন্য সৃজনশীলতা, কিন্তু কালেক্টিভ কনশাস থেকে তৈরি, অথরলেস, স্বত্ত্বহীন।” জিজেকের মতে, জোকসের অথর থাকা একটা ‘প্যারানয়িক’ ব্যাপার; এটা এমন যেন ‘ভাষার যে অতলস্পর্শী অনিশ্চিত সৃজনশক্তি’ সেইটা কোন এক ‘এজেন্টের হাতে বন্দি, যে গোপনে গোপনে এইটারে কন্ট্রোল করে, নাটাইয়ে ঢিল দ্যায়, টাইট দ্যায়।’ এজন্যেই আল্লাহরে বলা হয় ‘দ্য আল্টিমেট জোকস্টার’, কারণ পৃথিবীর প্রথম জোকটা তিনিই করছিলেন। জুদিও-ক্রিশ্চান কম্যুনিটির মেম্বাররা প্রায় সকলেই এই জোকটা জানেন, বলতেছেন জিজেক; মুসলিম কম্যুনিটির মেম্বার হিসাবে আমরা সবাই জানি কিনা তা নিয়া আমার অবশ্য ডাউট আছে। যাহোক, আদম-হাওয়ার প্রতি আল্লাহর নির্দেশ—‘তোমরা বোধিবৃক্ষের ফল খেও না’ই হইলো সেই জোক।
৪.
জোকসের অথরিটি কেউই ক্লেইম করতে পারে না আসলে। তবু যে বস্তুরে জিজেকের জোকস বলা হইতেছে, তার সাথে জিজেকের পারসোনালিটি আর কথাবার্তার ফিচারের একটা ইনিশিয়াল কানেকশন আছে। অনুবাদক কে এম রাকিব অনুবাদকের ভূমিকার একটা বড় অংশজুইড়া এই বইয়ের ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ সংক্রান্ত ঝামেলা নিয়া আলাপ করছেন। পলিটিকাল কারেক্টনেস নিয়া জিজেক বেশ ক্রিটিকাল। জিজেকের মতে, পলিটিকাল কারেক্টনেস ওপেন রেসিজমে বাধা দ্যায় এক রকম সেন্সরশিপের মাধ্যমে, ‘আপনি অমুকরে এইটা বলতে পারবেন না’র ভিতরে যে সেন্সরশিপ, তা ওপেন রেসিজমে বাধা দিলেও ভিতরে ভিতরে বিদ্বেষ, ঘৃণা ও মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিঙয়ে বাধা দ্যায়। এই নিয়া জিজেক তার জীবনের পার্সোনাল অভিজ্ঞতাও শেয়ার করছেন। সেইটাও জোক সংক্রান্তই, জিজেক বলতেছেন, যুগোস্লোভিয়া ভাঙার আগে সেইখানে নানা জাতির লোকেরা যখন ছিল—সার্ব, ক্রোট ও অন্যান্য— তখন তারা নিজেদের ভিতরেই নিজেদের নিয়া নানা ডার্টি জোকস বলতেন, যেগুলা সাধারণত ভালগার বা রেসিস্টও হইত। কিন্তু যুগোস্লোভিয়া ভাঙার পরে, নব্বইয়ের শুরুতে, এই জোকসগুলা আর তারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করতে পারতেন না। কারণ, একদিকে তখন দেশ ভেঙে গেছে, আর আশির শেষদিকে পলিটিকাল কারেক্টনেস চর্চার ব্যাপারটাও তখন গ্লোবাল ফেনোমেনা। জিজেকের মতে, এই পলিটিকাল কারেক্টনেসের চর্চা জাতিগুলার মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করছে।
জোকসের মধ্যে ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’র চর্চা করলে জোকসের স্বাদ নেওয়া যায় না, এই বিষয়ে অনুবাদক কে এম রাকিব তার ভূমিকায় বিস্তারিত লেখছেন। এই ব্যাপারে ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর জীবনিতে। মিথ্যা বলা ইসলামে গুনাহ, এই কারণে আর্টের ফিকশনাল ফর্মগুলা নিয়াও বহুদিন ফকিহদের মধ্যে তর্ক জারি ছিল— এখনও আছে মেবি— যে, এইটা মিথ্যার আওতায় পড়ে কিনা। তো, হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দরবারে এক বৃদ্ধা মহিলা আসলে নবীজি (স.) বললেন, কোন বৃদ্ধা মহিলা জান্নাতে যাবে না। বৃদ্ধা কান্নাকাটি শুরু করলে নবীজি আবার বললেন, ‘বৃদ্ধারা তো আসলেই জান্নাতে যাবে না। কারণ জান্নাতে যাওয়ার আগে সবাই যৌবন ফিরা পাবে, সেইখানে কেউ আর জরাগ্রস্ত থাকবে না। তো, রাসূল জোকস বলতে গিয়াও এমন কিছু বলতে নিষেধ করতেন, যা মিথ্যা বা যার ভেতরে সত্যের খেয়ানত আছে। এর কারণ সম্ভবত এই যে, বেশিরভাগ জোকসের ভেতরে যে জেনারেলাইজেশনের প্রবণতা ইনহেরেন্টলিই থাকে, এইটারে রাসূল অপছন্দ করতেন। জোকসের ক্ষেত্রেও পলিটিকাল কারেক্টনেস রক্ষারে তিনি তাই জরুরি ভাবতেন। অনেক সময় জোকসের ভেতরকার ইনহেরেন্ট সত্যও যে ওই জোকসের পাঞ্চলাইন হইতে পারে, রাসূলের এই ঘটন তার ভালো উদাহরণ।
৫.
জোকসের সোশিও-কালচারাল পারসপেক্টিভ থাকে, সাইকোলজিকালও তো বটেই। জোকস, কবিতার মতই, মানবমনের অন্ধকার জগত থিকা উইঠা আসা জিনিস, যারে ফ্রয়েড বলতেন ‘আনকনশাস মাইন্ড’। মানবমনের যে স্তরের নাম ফ্রয়েড দিছিলেন ‘ঈড’ বা ‘লিবিডো’, যা স্বভাবতই আদিম, অযৌক্তিক এবং অনৈতিক, জোকস এবং কবিতার উৎপত্তি সেই জায়গা থেকে। ফলে, এই দুই ফর্মে আপনি যেকোন ব্লাসফেমাস কথা যত সহজে বলতে পারবেন, অন্য ফর্মগুলাতে তা পারবেন না; মানুষের র্যাশনাল জাজমেন্ট, পলিটিকাল কারেক্টনেস এই দুই ফর্মে যেইভাবে ব্রেক হয়, অন্য ফর্মগুলাতে তা হয় না। আচ্ছা, পেইন্টিংয়েও হয়। কারণ সম্ভবত এই যে, সেইটাও মানবসভ্যতার আদিমতম আর্ট ফর্ম।
‘কবিতায় সাতখুন মাফ’ বইলা একটা কথা আছে। নজরুল যখন ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ লেখলেন, তখন তার মনে কী চলতেছিলো কেউ জানে না। পরে নজরুলভক্ত হুজুররা ব্যাখ্যা করছেন যে, এইখানে ‘খোদার আসন’ বলতে বৃটিশ শাসনরে বুঝানো হইছে। জোকসের মজা নেওয়ার জন্য আটখুন মাফ করতেও রাজি আছি আমি। কিন্তু, হেয়ার ইজ দ্য কোশ্চেন অব পলিটিকাল কারেক্টনেস। অবশ্য পলিটিকাল কারেক্টনেসের চর্চা কি করাই লাগবে—এমন প্রশ্নও উঠতে পারে।
করা তো লাগেই আসলে। ধরা যাক, কিছুদিন আগে হাসান আজিজুল হকের বাণী বা সম্প্রতি এক অ্যাডে তিশার পাহাড়ি মেয়ে সাজা কিংবা পন্ডস আর ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির অ্যাড নিয়া আমাদের দেশে প্রচলিত ক্লাসিক ক্রিটিকগুলা। এগুলার বেজ পলিটিকাল কারেক্টনেস। পলিটিকাল কারেক্টনেস আইডিয়া আকারে চর্চা না করলেও, আমরা যেসব আইডিয়ার চর্চা সচরাচর করি, তার অনেকগুলারই ভিত্তি পলিটিকাল কারেক্টনেস, সাপোজ—নারীবাদ, রেসিজম, হিউম্যান রাইটস। নারীবাদী লিটারেচারে খুব নির্মম সমালোচনা হয় বাংলাদেশে আদিম যুগ থিকা প্রচলিত অনেক সেক্সিস্ট জোকস ও প্রবাদের। এই সূত্রে একটা বিখ্যাত ঘটনা মনে পড়লো, আহমদ ছফা আর রেহনুমা আহমেদের। রেহনুমার জবানিতে গল্পটা এরকম—
“আহমদ ছফা’র সঙ্গে সেই একবারই দেখা। বছর ৯-১০ এক আগে। একটি সেমিনারে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত একজন বাঙালি শিক্ষার্থী, নৃবৈজ্ঞানিক ফিল্ডওয়ার্ক শেষে, তাঁর গবেষণা উপস্থাপন করেছিলেন। হাতে গোণা কয়েকজনকে ডাকা হয়েছিল। আমার প্রশ্ন ও মন্তব্য, ছফা ভাইকে ক্ষুব্ধ করে। সম্ভবত আমাকে সাইজ করার জন্য, আমার কথা-শেষে, তিনি একটি কৌতুক বলে বসেন। কোনো-এক কারণে তাঁর মনে হয়েছিল, আমি একজন পোস্টমডার্নিস্ট। উত্তর-আধুনিকতাবাদী হিসেবে জ্ঞান ফলাচ্ছি। শব্দের মার-প্যাঁচ কষছি।
নতুন নতুন বিষয় নিয়ে, বুঝে না-বুঝে বলতে গেলে (এ কথাগুলো আমাকে কটাক্ষ করে), তাহলে অবস্থা দাঁড়ায় সেই ছেলেটার মতো যে কি-না প্রথমবারের মতো ‘কতিপয়’ শব্দটা শিখেছে। বাবাকে চিঠি লিখতে বসে, শব্দটা মনে পড়ে। চিঠি শুরু করে এভাবে, ‘কতিপয় আব্বাজান, আমার সালাম নেবেন…’।
হাসির রোল শুরু হওয়ার আগেই আমি চট করে বলে ফেলি, “এটা যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের জোক, তা আপনি নিশ্চই বোঝেন? পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাইরে এই জোকের যে কোনো অর্থ দাঁড়ায় না, তা নিশ্চই জানেন?”
জোকসের একটা প্রবলেম হইলো, জোকস আসলে জোকস না। আগেই আমরা বলছি যে, জোকসের সাইকো-সোশাল বেজ থাকে। সুফিরা দুনিয়ার সত্যরে ‘জোক’ ভাবেন, কিন্তু সেই জোক তো সত্যও! জোক মানুষের মানসগঠনে, জাজমেন্টে ব্যাপক প্রভাব রাখে, এইটা অনস্বীকার্য। কাউরে অপদস্ত করার সবচাইতে ভাল উপায় তারে নিয়া একটা জোক বলা বা একটা ফানি কমেন্ট বা বক্রোক্তি করা। যদিও জোকস, ফলে ফিকশন, তবু মানুষের জাজমেন্টের উপরে তা ক্রিয়া করে এবং মানুশ জোকসের উপর ভিত্তি করে তার একটা রিয়ালিটি খাঁড়া করে।
৬.
তাইলে প্রশ্ন এই যে, আমরা জোকসরে পলিটিকাল কারেক্টনেসের বাইরে রাখব কিনা? জোকসের উৎপত্তি হয় একটা সমাজব্যবস্থার বাস্তবতায়, যেমন সোভিয়েত রাশিয়ার জোকসগুলি। আবার, জোকসের যে ডিপ সাইকোলজিকাল রুট আছে, তাও ঠিক। সমাজ বা মানবমন যদি পলিটিকাল কারেক্টনেসের বাইরে না থাকে, জোকসেরও থাকা উচিত বইলা মনে হয় না। সেই অর্থে, জোকস বা হিউমার অনেকদিক থিকাই প্রবলেমেটিক।
জোকসের একটা প্রবলেম হইলো, জোকস আসলে জোকস না। আগেই আমরা বলছি যে, জোকসের সাইকো-সোশাল বেজ থাকে। সুফিরা দুনিয়ার সত্যরে ‘জোক’ ভাবেন, কিন্তু সেই জোক তো সত্যও! জোক মানুষের মানসগঠনে, জাজমেন্টে ব্যাপক প্রভাব রাখে, এইটা অনস্বীকার্য। কাউরে অপদস্ত করার সবচাইতে ভাল উপায় তারে নিয়া একটা জোক বলা বা একটা ফানি কমেন্ট বা বক্রোক্তি করা। যদিও জোকস, ফলে ফিকশন, তবু মানুষের জাজমেন্টের উপরে তা ক্রিয়া করে এবং মানুশ জোকসের উপর ভিত্তি করে তার একটা রিয়ালিটি খাঁড়া করে। এই জাজমেন্ট প্রবলেমেটিক বইলাই মনে হয়।
জোকসের আরেক প্রবলেম হইলো, এর জেনারেলাইজেশন। জোকস সাধারণত অতি-সরলীকৃত হয়, ধরেন আমাদের এইখানে নোয়াখাইল্লা বা বরিশাইল্লাদের নিয়া প্রচলিত জোকসগুলা। জেনারেলাইজেশন সবসময়ই পলিটিকাল কারেক্টনেসরে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে ভাল জোকসমাত্রই হয়ত পলিটিকাল কারেক্টনেস বিরোধী। কিন্তু, জোকস যেহেতু মানবসমাজের একটা সাইকো-সোশ্যাল রিপ্রেজেন্টেশনও, তাই সোশ্যাল স্টাডির জন্য, পলিটিকাল কারেক্টনেস চর্চার স্টাডির জন্য, জোকসও তো এক কেস-স্টাডি বটেই!
জোকসের আরেকটা ঝামেলা হইলো, এইটা মানুষরে একটা অলটারনেট ওয়ে দ্যায়, তার অবদমনরে ওভারকাম করার। পৃথিবীতে অনেক ক্লাসিক জোক এবং স্যাটায়ার স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের পটভূমিতে গ্রো করছে। ‘সোভিয়েতভস্কি কৌতুকভ’ জ্বলন্ত উদাহরণ। অত দূরে না গেলে হাতের নাগালে বাংলাদেশই আছে। বাংলাদেশে এখন হিউমার বা কৌতুকের স্বর্ণযুগ চলতেছে। সোশাল মিডিয়ার মিম-কালচার বা ওয়ান লাইনার কালচারের বেজই দাঁড়ায়ে আছে কৌতুকের উপর। একটা ওয়ান লাইনার মানুষের সমস্ত ক্ষোভের আউটবার্স্ট হইতেছে। এ নিয়াও একটা ক্লাসিক মিথ আছে, সোভিয়েত রাশিয়ায় পুলিশের একটা গুপ্ত বাহিনী তৎকালীন রেজিমের বিরুদ্ধে হাস্যকর সব জোকস ছড়ানোর কাজ করতো। এতে করে পাবলিকের মধ্যে জোকসের চর্চা বাড়তো, তারা প্রশাসনরে মক করার একটা সহজ অলটারনেট ওয়ে পাইতো। জনতার ক্ষোভরে মিনিমাইজ করা যাইতো সহজে। বাংলাদেশেও, অনেকেরই ধারণা, বর্তমানে তাই হইতেছে। এই অবস্থাও এক হিসাবে প্রবলেমেটিক।
এখন তাইলে সওয়াল এই ওঠে যে, তাইলে কি আমরা জোকসের মধ্যেও পলিটিকাল কারেক্টনেস খুঁজতে থাকব? আদৌ কি জোকস আর পলিটিকাল কারেক্টনেসের কোন সন্ধি সম্ভব? পলিটিকাল কারেক্টনেসের ব্যাপারে জিজেকের ক্রিটিক ফালানো যায় না। কিন্তু ঘটনা এই যে, আজকে যা জোকস, কালকে তার কড়া খেসারত গোনা লাগতে পারে, আজকে যা গুরুগম্ভীর বাস্তবতা, কালকে তা পরিণত হইতে পারে জোকে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ‘মালাউন-যবন’ ডাকার যে কালচার, তার গোড়ায় ছিল ঘৃণা। কিন্তু ঘৃনার সেই অনুভূতি বিস্মৃত হইয়া একসময় শুধু শব্দ দুইটাই ছিলো, আমার গ্রামে আমি অহরহ মুসলমান-হিন্দুদের এই শব্দগুচ্ছে পারস্পরিক সম্বোধন করতে দেখছি, খুব স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু, এই মালাউন-যবনের ভিতরেই যে এতবড় ঘৃণার বীজ লুকায়ে আছে, যার ভিত্তিতে উপমহাদেশ ভাগ হয়া গেলো, তা কে ভাবছিলো! ফলে, জিজেক যুগোস্লোভিয়ার যে কাহিনী দিয়া পলিটিকাল কারেক্টনেসের ক্রিটিক করতে চাইছেন, তা পুরাপুরি ঠিক না। এতকিছু সত্ত্বেও, যুগোস্লোভিয়া তো ভাইঙাই গেলো, আর তার পিছনে জাতিগত বৈরিতা তো আছেই! আর সেই জাতিগত বৈরিতারই কিছু নমুনা ওইসব রেসিস্ট জোকস, যা জিজেকরা পরস্পরে শেয়ার করতেন৷ সেসব শেয়ারিং জাতিগত বিদ্বেষ ঠেকাইতে পারে নাই, দেশভাগও থামাইতে পারে নাই।
অবশ্য, পলিটিকাল কারেক্টনেসের সাথে সন্ধির একটা ইনিশিয়াল পদ্ধতি আমরা একরকম আবিষ্কার কইরা ফেলছি৷ নিজেদের অজান্তে হইলেও, এই পদ্ধতি জোকস বলার ক্ষেত্রে বক্তা আর শ্রোতার মাঝে একটা স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করে। পোস্টমডার্ন এরায় পলিটিকাল কারেক্টনেস রক্ষা করতে গিয়া একটা ভাল জোকসরে জলাঞ্জলি দিতে আমরা কেউই আসলে রাজি না, বরং একটা মজার জোকসের খাতিরে আমরা আটখুন মাপ করতেও প্রস্তুত। কিন্তু এনলাইটেনমেন্টজাত পলিটিকাল কারেক্টনেসের যে দান সভ্যতায়, তারে, অন্তত আমাদের আজকের পৃথিবীর প্রেক্ষাপটেও একেবারে ফেলনা ভাবতে পারতেছি না আমরা, যদিও, দিকে দিকে উগ্র ডানপন্থার উত্থান ঘটতেছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে রেইসিস্ট বক্তব্য দিতে পারতেছেন, এবং টু সাম এক্সটেন্ড, এইটারে অনেকে পূর্ববর্তীদের তুলনায় তার ‘সততা’র তকমাও দিতেছেন। ফলে, আমাদের পোস্টমডার্ন অন্তর একটা সন্ধি কইরা নিছে জোকস আর পলিটিকাল কারেক্টনেসের সাথে। সেইটা এই যে, আমরা জোকস বলার আগে সেই জোক্সের সেক্সিস্ট, রেসিস্ট বা ভালগার এসেন্সের ব্যাপারে অডিয়েন্সরে সতর্ক করি—‘জোকটা কিন্তু হালকা রেসিস্ট/সেক্সিস্ট’ বইলা। এতে কইরা যা হয়, শ্রোতারে তার চয়েজের ব্যাপারে স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং জোকসের সমস্ত কনটেক্সট যে কথকের মাথায় আছে, অ্যান্ড এপার্ট অল অফ দ্যাট, তিনি জোকসটা থেকে আনন্দ নিতে চাইতেছেন, এইটা ক্লিয়ার হয়। এর ফলে একটা স্বস্তি তৈরি হয় অডিয়েন্সেও যে, ওকে, আমরা তো জানিই যে এইটা সেক্সিস্ট! অনুবাদকের ভূমিকায় কে এম রাকিবের এই সংক্রান্ত খোলামেলা আলাপও তাই আমাদের মধ্যে এক ধরণের স্বস্তি তৈরি করে, ঠিক এই ওয়েতেই।
তবু কথা এই যে, ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’র আলাপ বাদও যদি দিই, প্রত্যেকটা জোকসরেই আসলে তার স্থান, কাল, পাত্র থিকা ডিকন্সট্রাক্ট কইরাও পড়া যায় খুবই ইজিলি, যেমন আমরা ‘জিজেকের জোকস’এ পাইতেছি। ‘জিজেকের জোকস’এ এক দুইটা জোকস ছাড়া, আর কোন জোকসের সাথেই বিশেষ কোন কনটেক্সট দেওয়া নাই ওইভাবে। ফলে, কনটেক্সট-ছাড়া টেক্সটের পাঠ এইরকম ওয়েতে খুবই সম্ভব এবং উপভোগ্য, ব্যক্তি হয়ত ব্যাপারগুলিরে তার সময়ের সাথে, তার অভিজ্ঞতার সাথে রিলেট করতে পারবে। সেইখানে জোকসগুলার স্থান, কাল, পাত্র গৌন হয়া যাবে; গৌন হয়া যাবে তার সেক্সিস্ট বা রেসিস্ট এসেন্সটাও। আর এই জায়গাতেই ‘জিজেকের জোকস’র গুরুত্ব, জিজেকের ভালগার জোকগুলার সাথে চিন্তা ও মানসের সংঘর্ষে হয়ত বাঙালি সমাজে পলিটিকাল কারেক্টনেস নতুন কোন ডাইমেনশন পাবে, হয়ত আমাদের সহিষ্ণুতা আরেকটু বাড়বে। ‘জিজেকের জোকস’র অনেক বক্তব্যের কড়া বিরোধী হইয়াও আমি এইরকম ভাবতে যে পারতেছি, তাও তো একরকম সহিষ্ণুতাই, নাকি!