গেরস্ত মঙ্গল

গেরস্ত মঙ্গল

– কি লা, মুখ এরম কইরা বইসা আছো কেন? শরীর খারাপ করছে?

– শরীর না গো, মনডা ভালো না

– কি হইছে কও তো

– আজকে রাস্তা দিয়া আসনের সময় একটা মাইয়্যা দেখলাম। তখন থাইকাই মনটা কেমন জানি লাগতেছে। কতকাল ছোট আপারে দেখি না

– তয় এক কাম করো না কে?

– কি কাম?

– হেগোর বাইত্তে যাও

– না রে, এখন সব নতুন বৌঝিরা আইছে।

– ছোট আপাই যদি না চিনে?

 

কার্জনের ফুটপাথ, রাতটা তখনো ঠিক জমে বসেনি। কথা হচ্ছিল হনুফা আর পরীর মায়ের মধ্যে। দু’জনই ফুল বিক্রি করে সংসার চালায়। সংসার আর কোথায়? হনুফার স্বামী তাকে ছেড়ে গিয়েছে সেই কবেই। ছেলেরাও আর খোঁজ নেয় না। কার্জনের ফুটপাথের এক কোণেই তাই সংসার পেতেছে সে। ফুল বিক্রি করে যে টাকা আসে তা দিয়ে নিজের দিব্যি চলে যায়। তবে, পরীর মায়ের গল্পটা অন্য রকম। সবাই পরীর মা বলে ডাকলেও পরী মারা গিয়েছে অনেকদিন আগেই। পরী চলে গেলেও পরীর মা, নামটা মোছেনি। পরীর মায়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে জাকিয়ার আসল নাম। পরীর জন্মের অল্প কিছুদিন পরই স্বামীহারা হয় সে।

খুব বেশিকাল আগের কথা না। কাজের খোঁজে জাকিয়া তখন এসে পৌঁছেছে ঢাকার ঠিক পাশের এক জেলায়। ক্লান্ত বিধ্বস্ত জাকিয়াকে দেখে একজন খোজ দেয় সরকার বাড়ির। তখন সরকারদের জমিদারি না থাকলেও বাড়ির কর্তা ইব্রাহিম সরকার জীবিত ছিলেন। জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও ইব্রাহিম সরকারের দাপট তখনো কমেনি। এলাকায় প্রভাব প্রতিপত্তির পাশাপাশি আরো একটা কারণে বেশ নাম ডাক ছিল ইব্রাহিম সরকারের। তার দুয়ার থেকে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরেনি। ঠিকানা মতন পৌছে সদর দুয়ারের সামনে গিয়ে ক্লান্তিতে জ্ঞান হারায় জাকিয়া।

কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল জাকিয়ার জানা নেই। জ্ঞান ফেরার পর জাকিয়া নিজেকে আবিষ্কার করে একটি ঘরে। সেই থেকে কতটাকাল কেটে গিয়েছে সরকার বাড়িতে জাকিয়ার খেয়ালেও নেই। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে দেয়া দরকার। জাকিয়ার এর আগেও বিয়ে হয়েছিল একবার। সে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই পালিয়ে এসেছিল জাকিয়া। সরকার বাড়ির সদর দুয়ারে পৌছানোর পরের দিন জাকিয়া প্রথমবারের মত দেখা পায় ইব্রাহিম সরকারের। জাকিয়ার কাছে সব ঘটনা শুনে তিনি জাকিয়াকে থেকে যেতে বলেন সরকার বাড়িতেই। তখন ইব্রাহিম সরকারের বড়ছেলে আরাফাত সরকারের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। তার সেবার জন্যই রেখে দেয়া হয় জাকিয়াকে।

সরকারদের গেরস্তের তখনো জমজমাট অবস্থা। বিশাল দোতলা বাড়ি। মূল বাড়ি থেকে একটু বাইরে টানা লম্বা টিনের ঘর। সেখানে বাড়ির কাজ কর্ম যারা করে তাদের থাকার ব্যবস্থা। প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত সরকার বাড়িতে। মানুষ আসছে, মানুষ যাচ্ছে; হিসাব রাখার কেউ নেই। ইব্রাহিম সরকারের হাকডাকে সব সময় তটস্ত সবাই। কম যেতেন না ইব্রাহিম সরকারের স্ত্রী বলাকা বেগমও। বাইরের দিকটা যেমন সরকার সাহেব সামাল দিতেন; তেমনি অন্দরের সব কিছু ছিল বেগম সাহেবের নখ দর্পনে।

অল্পকিছু দিনের মধ্যেই সরকার বাড়ির পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয় জাকিয়া। ঐদিকে আরাফাত সরকারের স্ত্রীর সন্তান জন্মদানের সময় এগিয়ে আসতে থাকে। আরাফাত সরকারের স্ত্রী শান্তার সাথে তখন সর্বক্ষণ ছায়ার মতন লেগে থাকত জাকিয়া। বলতে নেই, নিজের গুণেই শান্তা এবং বলাকা বেগমের মন জয় করে নিয়েছিল জাকিয়া। কিছুদিন পরেই শান্তার ছোট মেয়ের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় ইব্রাহিম সরকারের প্রিয় ফুল দোলনচাপার নামে। জাকিয়ার কাছে দোলন হয়ে যায় ছোট আপা। জন্মের পর থেকে দোলনকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিল জাকিয়াই।

শান্তার পরামর্শে বাড়ির দারোয়ান লতিফের সাথে জাকিয়ার বিয়ে ঠিক করেন বলাকা। শুরু হয় দুজনের সুখের সংসার। একজন সরকার বাড়ির অন্দরে অপর জন সদর দুয়ার রক্ষা করে বেশ চলছিলেন। বলতে নেই, বাড়িটাকে নিজের বাড়ির মতনই ভালোবাসত দু’জন। আর সরকার সাহেবও বাড়ির কর্মচারীদের সুখ দুঃখে এমনভাবে পাশে থাকতেন, যেন তার নিজেরই সন্তান।

জীবনের নিয়ম মেনেই একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলেন ইব্রাহিম সরকার। ছোট বেলাতেই বাবা হারানোর ফলে পিতৃ বিয়োগের অনুভূতিটা অপরিচিত ছিল জাকিয়ার কাছে। সরকার সাহেবের মৃত্যুতে যেন সে অনাকাঙ্খিত স্বাদটা পেল সে। বলা যায় সরকার বাড়ির পতনেরও শুরু তখন থেকে। সরকার সাহেবের চার সন্তানের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ কেবল জন্ম নেই নেই অবস্থা তখন।

কিন্তু বলাকার শক্ত হাতের কতৃত্বে তখনও সরকার বাড়ির গেরস্তরুপটি জীবিত ছিল। এর মাঝেই জন্ম নেয় লতিফ জাকিয়ার কন্যা সন্তান। ফুলের মতন ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখে যে কারোই মায়া লাগতে বাধ্য। ততদিনে দোলন স্কুলে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। জাকিয়ার মেয়ের নামটি ঠিক করলো সে নিজেই। রুপ দেখে নাম রাখলো পরী। সেই থেকে জাকিয়া হয়ে গেল পরীর মা। পরী রুপ নিয়ে জন্মালেও ভাগ্য ছিল বিরূপ। পরীর জন্মের কিছুদিন পরেই মারা যায় লতিফ। বিধবার শোক কাটতে না কাটতেই জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কার একটি খেল জাকিয়া। সরকার ভাইদের মধ্যে জন্ম নেয়া বিরোধ তখন কেবল প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এর পিছনের কলকাঠি যে সরকার পত্নীরাই নাড়ছিল তা বলাই বাহুল্য।

হাই প্রেশারের রোগী ছিলেন বলাকা বেগম। একদিন খাবার টেবিলে এক কথা দু কথায় চার ভাইয়ের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায়। ইব্রাহিম-বলাকার মেজ ছেলে আজমল সরকার তর্কের মাঝেই আচমকা আরাফাত সরকারের গায়ে হাত তুলে বসেন। ঘটনার আস্মকিতায় নির্বাক হয়ে যায় সবাই। জীবদ্দশায় ছেলেদের এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেননি বলাকা। স্ট্রোক করেন সাথে সাথেই। তাড়াহুরো করে ডাক্তার নিয়ে আসলেও বলাকা বেগমকে বাচানো সম্ভব হয়নি।

বলাকার বিদায়ে যেন শেষ বাধাটাও আর থাকে না। চার ভাই জড়িয়ে পরে সম্পত্তির লড়াইয়ে। সম্ভ্রান্ত সরকার বাড়ি তখন সম্ভ্রম হারিয়ে ছিছি’তে পরিণত প্রায়। যে আশঙ্কাটা প্রায়ই করত জাকিয়া একদিন সেটিই সত্য হল। আলাদা হয়ে গেল চার ভাই, ভেঙ্গে গেল সরকার বাড়ি। গেরস্তই যখন থাকল না, তখন ভৃত্য পুষবে কে? শান্তা অনেকটা নরম স্বভাবের হলেও আরাফাতের মধ্যে দয়ামায়া তেমন ছিল না। একদিন জাকিয়াকে ডেকে কিছু টাকা দিয়ে নতুন জায়গায় কাজ খুজতে বললো সে। এখন যে অবস্থা তাতে মা মেয়ে দু’জনকে যে পালা সম্ভব না, এ কথা সোজা জানিয়ে দেয় আরাফাত। মাথায় আকাশ ভেঙে পরলেও অবাক হয়নি জাকিয়া। বরং এমন কিছু যে ঘটবে সেটা সে আগেই অনুমান করেছিল। পরদিন ভোর বেলাতেই পরীকে নিয়ে বেড় হয়ে যায় জাকিয়া। কিন্তু যাবে কোথায়?

বিভিন্ন পথ ঘুরে আশ্রয় নেয় কার্জনের ফুটপাথে। তখন থেকেই পরিচয় হনুফার সাথে। হনুফারও তো কেউ নেই। সব কথা শুনে হনুফা তার সাথে থাকতে বলে। বলে যে কয়টা টাকা আছে ঐটা দিয়ে ফুল কিনে বেচতে পারলে মা মেয়ের পেটটা অন্তত চলবে। তখন সবে বর্ষার শুরু। দু’দিন পরেই নামল ঝুম বৃষ্টি। মাথা গোজার ঠাই বলতে শুধু প্লাস্টিকের কিছু টুকরো। ঐটুকু দিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা যায়? ভোরের দিকে বৃষ্টি থামলেও পরীর গা কাপিয়ে জ্বর আসে। বহু চেষ্টা করেও পরীর জীবন বাচাতে পারে না জাকিয়া। সরকার বাড়িতে গিয়ে যে নতুন জীবন পেয়েছিল, সরকার বাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে যেন সে জীবনটার সমাপ্তি ঘটল জাকিয়ার। পরীর মৃত্যুতে যেন শেষ সুতোটাও ছিড়ে গেল।

কত বছর কেটে গেল এই কার্জনের ফুটপাথেই। কিছুই যেন চাওয়া পাওয়ার নেই আর জাকিয়ার। পরীর মতন বয়সের কাউকে দেখলেই বুকটা যেন কেমন করে উঠে। আর একজন এর কথা জাকিয়া কিছুতেই ভুলতে পারে না জাকিয়া, দোলনের কথা। কোলে পিঠে বড় করা দোলনকে যে দেখতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু সরকার বাড়িতে যেতে আর মন চায় না। তার চেয়ে বড় হয়ে কাজ করে একটা ভয়, দোলন যদি না চেনে তাকে?

হঠাৎ হনুফার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় জাকিয়া।

– কি লা, ঘুমাও নাই?

– না রে

– কই কি, একবার যাও; এত যখন মনে পরে, দুর থাইকাই না হয় দেইখা আসলা

কিছু না বলে কাত হয়ে চোখ বোজে জাকিয়া। দেখতে দেখতে এক সময় ঘুমিয়ে যায় জাকিয়া।

পরদিন সকালে আবারো ফুল নিয়ে বের হয় জাকিয়া। জাদুঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে একটি তরুণ জুটি। এদের কাছে বিক্রি ভালো হয়। সে কথা ভেগে এগিয়ে যায় জাকিয়া।

– আপা, একটা ফুল নিবেন…

বলেই থমকে যায় জাকিয়া। তার ডাক শুনে যে মানুষটি তার দিকে ফিরে তাকিয়েছে সে আর কেউ না, জাকিয়ার ছোট আপা; দোলনচাপা। যতবছরই পার হোক, দোলনকে চিনতে সামান্য ভুলও হয়না জাকিয়ার। আর কোনো কথা বলতে পারে না জাকিয়া, টপটপ করে চোখ দিয়ে নেমে আসে অবাধ্য অশ্রু…