দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে মাশরাফি বিন মুর্তজার অবদান অনেক। তিনি যেভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আগলে রেখেছেন, পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের কাছে— সেটি অতুলনীয়। খেলার মাঠে অনেক কঠিন সময় মাশরাফির দৃঢ় নেতৃত্বে সামলেছে টাইগাররা। এমনকি অনেক জয়ের পিছনে মাশরাফি বিন মুর্তজার অনুপ্রেরণা ও দক্ষ নেতৃত্ব মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। মাশরাফি মানেই ২২ গজের হিসেব, বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান-ভবিষ্যত। কিন্তু এখন চিত্রটা খানিক ভিন্ন। ক্রিকেট ছাপিয়ে আলোচনায় আসে ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন মাশরাফি’, ‘মনোনয়ন পত্র কিনলেন মাশরাফি’, ‘মাশরাফির মনোনয়ন বৈধ’ এসব বিষয়গুলো। ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচন করছেন মাশরাফি- এ কথা এখন আরো অজানা নেই। ওয়ান ডে অধিনায়কের রাজনীতিতে যোগ দেশের ক্রিকেটানুরাগীদের দু’ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিল। আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। কিন্তু এ ব্যাপারে মাশরাফি সবাইকে রেখেছিলেন ধোঁয়াশায়। চারদিকে এতো আলোচনা-সমালোচনা কিন্তু মাশরাফি যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। অবশেষে নিজের অবস্থানটা পরিস্কার করার জন্যই হয়তো সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চাইলেন ম্যাশ। তাতেও কি তিনি ক্রিকেটানুরাগীদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন? কেটেছে ধোঁয়াশা?
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়বেন মাশরাফি বিন মর্তুজা—এমন খবর বের হওয়ার পর থেকে সবার মনে নানান প্রশ্ন, কৌতূহল ও উদ্দীপনা। অনেকে সহজভাবেই নিয়েছেন বিষয়টি, কেউ কেউ পারেননি বিষয়টি হজম করতে। কিন্তু মাশরাফি নিজে কখনো নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক কথাও বলেননি। তবে ফেসবুকে দুইটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেখানেও থেকে গেছে সংশয়, রয়ে গেছে অনেক প্রশ্ন।
১৪ ডিসেম্বর সিলেটে তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ ওয়ানডে খেলবেন মাশরাফি। ম্যাচের পরদিন জিয়ারত করবেন হযরত শাহজালাল (র) এর মাজার শরীফ। এরপর ঢাকায় ফিরে ঠিক করবেন নিজের নির্বাচনী পরিকল্পনা। সবগুছিয়ে আগামী ১৭ বা ১৮ তারিখ যাবেন নির্বাচনী এলাকা নড়াইলে। এরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে মাশরাফির নির্বাচনী’- এসব খবর বের হওয়ার পর দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে সবার আগে প্রশ্ন এসেছে, তবে কি ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি?
গত মঙ্গলবার শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে, বিসিবির একাডেমি ভবনের কাছে অস্থায়ী পুলিশ এনক্লোজারের সামনে প্রায় শ’খানেক সংবাদকর্মীদের সামনে স্ব-উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলন করেছেন মাশরাফি। সেখানে ‘ক্রিকেটার’ মাশরাফি নন, পুরোদস্তুর ‘রাজনীতিবিদ’ মাশরাফিকেই যেন পেয়েছিলেন সবাই। মনোনয়ন পত্র কেনার পর এই প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বলেছেন তিনি।
আগে কখনো সে অর্থে রাজনীতি করেননি। জীবনের দেড় যুগ কাটিয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনেই। ক্যারিয়ার সায়াহ্নে এসে নাম লিখিয়েছেন পুরোদস্তুর জাতীয় রাজনীতিতে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে লড়বেন নিজের জন্মস্থান নড়াইলের সাংসদ হওয়ার দৌঁড়ে। কিন্তু ঠিক কি কারণে এমন সিদ্ধান্ত মাশরাফির? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রিকেটার মাশরাফির ওজন অনেক বেশি। অন্য যে কোনো ক্রিকেটারের চেয়ে মাশরাফির জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। কিন্তু নির্বাচন তথা রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর অনেক পাড় ভক্তও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। এমন হবে জানতেন না মাশরাফি? এক দলের হয়ে নির্বাচন করায় অন্য দল মুখ ঘুরিয়ে নেবেন সেটি জেনেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এমন ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক।
একজন রাজনীতিবিদের অনেক দায়বদ্ধতা। সবদিকে রাখতে হয় সজাগ দৃষ্টি, নিতে হয় দায়িত্ব। সেই হিসেব করেই মাশরাফির কাছে জানতে চাওয়া হয় দেশের আলোচিত আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলণে কেন চুপ ছিলেন তিনি। মাশরাফি বললেন, “এত গভীর রাজনীতি আমি কখনো করিনি, জানি না, বুঝিও না। আমার উদ্দেশ্য খুব সাধারণ, আমি মানুষের জন্য কিছু করে শান্তি পাই। আপনি যদি আমাকে একেবারেই গভীর রাজনীতিবিদ ভাবেন, সে পর্যায়ে এখনো যাইনি। আমাকে ও পর্যায়ের ভাবলে আমার সঙ্গে অবিচার হবে। আমার অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। হ্যাঁ, যেটা বলেছি অবশ্যই ভালো কাজ করতে চাই। সেটা সামনে হয়তো দেখা যাবে কতটা করতে পারি।” মাশরাফি ক্রিকেটের মানুষ, গভীর রাজনীতিবিদ নন— এ কথা সবাই জানে। কিন্তু এমন দুটি আন্দোলনে অন্তত সমর্থন করার জন্য গভীর রাজনীতি করা, জানা বা বোঝার আদৌ দরকার ছিল কী?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভালো কাজ করা কতটা কঠিন মাশরাফির অজানা নয়। মাশরাফি কোনো স্বপ্ন দেখাতে আসেননি, কোনো দর্শন কিংবা গতানুগতিক কথাও বলতে চান না। নির্বাচিত হওয়ার পর কি করবেন, সে ব্যাপারে পরিস্কার করে কিছুই বলেননি।
মাশরাফির অগণিত ভক্ত। তাকে যারা ভালবাসেন কোনো শর্ত ছাড়াই। দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর তাদের সেই শর্তহীন ভালবাসাতে চিড় ধরেছে সেটি প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়। রাজনীতি রাজনীতিবিদের হাতেই থাকা উচিত। অন্য পেশা থেকে রাজনীতিতে গিয়ে দলীয় রাজনীতির চর্চাটা ভালভাবে করা যায় না; সম্ভবও নয়। পেশাগত অভ্যস্ততার বিষয়টি এখানে মুখ্য। মাশরাফি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। দলীয় পরিচয় সরাসরি বহন না করেও একটি নির্দিষ্ট দলের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য খুব প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম তিনি। যেহেতু তিনি রাজনীতিতে অভ্যস্ত নন। সরাসরি রাজনীতিতে না এসেও তিনি দিব্যি পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতে পারতেন।
মাশরাফির উদ্দেশ্য যদি নড়াইলবাসীর উন্নয়ন হয়, তবে দলীয় পোশাক গায়ে না লাগিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে যদি পরিবর্তনের কাজ করতেন সেটি বেশি ফলদায়ক হতো। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মাশরাফি বিন মুর্তজার চেয়ে দলীয় পোশাকবিহীন মাশরাফি বিন মর্তুজার কথা সমাজের মানুষেরা বেশি শুনতো ও মানতো। দলীয় পরিচয় বহনকারী মাশরাফি বিন মর্তুজার চেয়ে দলীয় পরিচয়হীন মাশরাফির বেশি শক্তিশালী, প্রভাবশালী ও গ্রহণযোগ্য। তবুও কেন মাশরাফির রাজনীতিতে আসা- ধোঁয়াশা।