পুনরায় গোমুখ্যুমি! গো-মাংস সংক্রান্ত স্রেফ একটি গুজব। সেই গুজবে উন্মত্ত হয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের বিক্ষোভের জেরে খুন। ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। উত্তরপ্রদেশের দাদরি জেলার বিশারা গ্রামের মুহম্মদ আখলাকের বাড়িতে ফ্রিজে গো-মাংস আছে, এই ছিল অভিযোগ। তার বাড়িতে চড়াও হয়েছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের একদল চ্যালাচামুণ্ডা, তারা পিটিয়ে খুন করেছিল ৫২ বছর বয়সি মুহম্মদ আখলাককে। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন সুবোধকুমার সিংহ। অবিলম্বে তিনি মুহম্মদ আখলাকের বাড়ির ফ্রিজে সংরক্ষিত মাংস পাঠিয়ে দেন গ্রেটার নয়ডায় মাংসের নমুনা গবেষণাগারে। প্রমাণিত হয়, খাসির মাংস ছিল ওটা, যা দাবি করেছিল নিহতের পরিবার। সুবোধকুমার সিংহ ছিঁড়ে দিলেন হিন্দুত্ববাদের মুখোশ! সমঝে দিলেন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দ্বারা গুজব ছড়িয়ে লোক খেপিয়ে মানুষ খুনের হিন্দুত্ববাদী চক্রান্তের স্বরূপ! অভিযুক্তদের কেবল গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, ওই মামলায় অন্যতম সাক্ষী হয়েছিলেন তিনি নিজে। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে পুলিশ বাহিনীতে ইন্সপেক্টর সুবোধকুমার সিংহ ছিলেন যেন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ! আখলাক-খুন মামলার শেষ দেখে ছাড়বেন তিনি, বুঝে গিয়েছিল প্রশাসন। তাই দেড় মাসের মধ্যে ৯ নভেম্বর তাকে আখলাক-খুন মামলার তদন্ত থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাকে বদলি করে দেওয়া হয় বারাণসী থানায়। তার জায়গায় নিয়োগ করা হয় আজ্ঞাবহ তদন্তকারী অফিসার! যথারীতি দীর্ঘায়িত হয় আখলাক-খুন মামলা, একে-একে জামিন পেয়ে যায় অভিযুক্ত খুনিরা। স্বাভাবিকভাবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নিশানায় ছিলেন এই ধর্মনিরপেক্ষ, বেপরোয়া পুলিশ ইন্সপেক্টর। তার স্ত্রী সুনীতা সিংহ জানিয়েছেন, বদলি হয়ে যাওয়ার পরও তাদের বাড়িতে নিয়মিত হুমকি চিঠি ও হুমকি ফোন আসত। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ষড়যন্ত্র করেই হিন্দুত্ববাদীরা খুন করেছে, নিহত পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারের এই দাবিও যথেষ্ট জোরদার। পরিবারের আরও দাবি, এই ষড়যন্ত্রে শামিল আছে পুলিশও।
সোশ্যাল সাইট এবং সংবাদমাধ্যমের দৌলতে প্রশংসা কুড়িয়েছিল উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহর জেলার দরিয়াপুর। ১-৩ ডিসেম্বর তিন দিনের ধর্মীয় সভা ‘তবলিগে ইজতেমা’ আয়োজিত হয়েছিল ওই শহরে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের এই সভায় জমায়েত হয়েছিল দেশের অন্যান্য স্থান থেকে আগত প্রায় দশ লক্ষ মানুষ। প্রচুর মানুষের সমাগমে নামাজ পাঠের জায়গা সংকুলান না-হওয়ায় স্থানীয় হিন্দু মানুষেরা শনি মন্দিরের দরজা খুলে দিয়েছিল নামাজ পড়ার জন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র দেশে। একদিন না-পেরোতেই ফের খবরের শিরোনামে বুলন্দশহর। ৩ ডিসেম্বর, সোমবার স্যানা মহকুমার অন্তর্গত মাহাউ গ্রামে আখ ক্ষেতে এবং অন্যত্র গো-মাংস পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে, এই খবর ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। জুতসই উপলক্ষ পেয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে গো-রক্ষক বাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসীদের বয়ান অনুযায়ী, বহু বাইক এবং চারচাকা গাড়ি নিয়ে হাজির হয় বজরঙ্গ দলের গো-রক্ষক বাহিনী। তারা আখ ক্ষেত থেকে গো-মাংস ট্রলিতে ভরে রওনা দেয় থানার দিকে। এলাকাবাসী শান্তি বজায় রেখে থানায় অভিযোগ দায়ের করার কথা বললে তা অগ্রাহ্য করে চিঙ্গারবটি থানার সামনে বিক্ষোভ শুরু করে তারা। ক্ষিপ্ত-উন্মত্ত বহু জনতাকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গুটিকয়েক পুলিশ। তখনই আখ গাছের আড়াল থেকে গো-রক্ষক বাহিনী ইট, পাথর ছুঁড়তে থাকে পুলিশদের দিকে। শুন্যে গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে চেয়েছিল পুলিশ, বাস্তবে আরও মারমুখি হয়ে পড়ে বহু দুষ্কৃতি। তাদের ছোঁড়া পাথরের আঘাতে গুরুতর জখম হন পুলিশ ইন্সপেক্টর সুবোধকুমার সিংহ, অচৈতন্য হয়ে পড়েন তিনি। তাকে কোনওক্রমে গাড়িতে তুলে হাসপাতাল যাওয়ার চেষ্টা করেন পুলিশ গাড়ির চালক রাম আশ্রে। স্টার্ট দেওয়ার আগেই উন্মত্ত দুষ্কৃতিরা ঘিরে ফেলে গাড়ি, প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায় রাম। তখনই সুবোধ সিংহের সার্ভিস রিভলবার দিয়েই তাকে খুন করা হয়। এই তান্ডবের মাঝে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে সুমিতকুমার সিংহ নামে ২০ বছর বয়সি এক বিজেপি কর্মীর। দুপুর বারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত যেন কুরুক্ষেত্র ময়দান হয়ে ওঠে চিঙ্গারবটি এলাকা। দুষ্কৃতিরা বেশ কয়েকটি পুলিশ ভ্যান এবং গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
লোককথা অনুযায়ী, রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন মত্ত ছিলেন বেহালা বাজাতে! এই অনভিপ্রেত ঘটনায় যখন জ্বলছিল বুলন্দশহর, তখন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গোরক্ষপুরে লেজার শো দেখছিলেন, কাবাডি খেলছিলেন। তার সঙ্গী ছিল ছত্তীশগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ। রাতের দিকে ফেরার পর উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ঘোষণা করেন, নিহত সুমিতের বাবার দাবি অনুযায়ী ৫০ লক্ষ টাকা এবং এক জনের সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। পাশাপাশি ঘোষণা করেন, নিহত অফিসারের পরিবারকে ৪০ লক্ষ টাকা এবং তার বাবা-মাকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং এক জনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। সুবোধের বোন বলেন, “যত বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক না কেন, দাদার মৃত্যুর যন্ত্রণা কি লাঘব হবে? আমরা চাই, শহীদ ঘোষণা করে আমার দাদার স্মারক স্তম্ভ তৈরি হোক।”
মঙ্গলবার রাতে একটি বৈঠকের পর যোগী আদিত্যনাথ বলেন, “যারা গো-হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।” যারা গো-হত্যা করেছে তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অথচ লক্ষণীয়, পুলিশ খুনের বিষয়ে সমবেদনা অথবা খুনিদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে একটি বাক্য খরচ করেননি তিনি! খুব সঙ্গত কারণেই নিহত সুবোধকুমার সিংহের স্ত্রী সুনীতা সিংহ বলেছেন, “রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী গো-রক্ষা ছাড়া আর কিছুই করছেন না।” সুবোধ সিংহের ছেলে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র অভিষেক সিংহ সংবাদমাধ্যমে বলেন, “বাবা আমাদের শিক্ষা দিতেন, ধর্মের নামে লড়াই করে অসভ্য মানুষেরা! জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমরা সকলে মানুষ। মানবিকতার এই বোধ সকলের মধ্যেই থাকা প্রয়োজন। আমি একটি প্রশ্ন সকলকে জিজ্ঞাসা করতে চাই। এভাবে আর কতদিন হিন্দু-মুসলিম লড়াইয়ের মাঝে পড়ে আমাদের মতো সন্তানকে পিতৃহারা হতে হবে?”
পুলিশ অফিসার খুনের দায়ে মোট ২৭ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, অভিযুক্ত অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৬০ জন। মূল অভিযুক্ত যোগেশ রাজ ঘটনার পর যথারীতি বেপাত্তা ছিল, মঙ্গলবার রাত্রে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বজরঙ্গ দলের নেতা এবং বিজেপি যুব মোর্চার সদস্য অভিযুক্ত যোগেশ। গ্রেপ্তার হয়েছে আরও চার জন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ এবং ৩০৭ ধারায় খুন এবং খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের হয়েছে যোগেশের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি এফআইআর-এ নাম আছে বিজেপি যুব মোর্চার সদস্য শিখর আগরওয়াল এবং ভিএইচপি সদস্য উপেন্দ্র রাঘবের।
অন্যান্য রাজনৈতিক শিবির এই ঘটনার কড়া সমালোচনায় মুখর। বসপা নেত্রী মায়াবতী বলেন, “উত্তরপ্রদেশে এখন জঙ্গলরাজ চলছে বিজেপির মদতেই।” বিজেপির সর্বভারতীয় নেতাদের মধ্যে একমাত্র সংখ্যালঘু মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভী বলেছেন, “এটা মানবতার পরাজয়। রাজ্য সরকার দোষীদের কড়া শাস্তি দিক।”