উপেক্ষার ব্যালন আগামীবারই আরাধ্য হবে না তো?

উপেক্ষার ব্যালন আগামীবারই আরাধ্য হবে না তো?

বিশ্বসেরার নির্ধারক বলে বিবেচিত ব্যালন ডি’অর অবস্থাদৃষ্টে এক রাতেই মনে হচ্ছে সতী সাবিত্রি থেকে পরিণত হয়েছে কলঙ্কিনীতে। হেতু, রোনালদো-মেসির ভিনগ্রহী রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে মদ্রিচের বিশ্বজয়। তো, দশ বছর পর এক আদম সন্তানের এমন বিজয় যে এতটা বিতর্কের জন্ম দিবে তা বোধকরি ভাবেননি কেউ। এই ভাবনা যেহেতু গত হয়ে গিয়েছে, আমার মনে উকি দিচ্ছে নয়া এক সাওয়াল।

যাদের সমর্থকরা ব্যালন’র ইজ্জত নিয়ে আচানক সন্দিহান হয়ে পরেছেন সে ত্রয়ীর কেউই ব্যালন প্রদানের রাত্রে অনুষ্ঠান স্থলে ছিলেন না। একজনের হদিস পাওয়া যায়নি, একজন সময় কাটিয়েছেন সন্তানদের সাথে এবং অপরজন জি জান লাগিয়েছিলেন প্লে স্টেশনে! পয়লা এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা যাক। ব্যালন প্রদানের রাত্রে তাদের আচরণ এটা স্পষ্ট করে দেয় যে, ব্যালন নামক স্বর্ণগোলক নিয়ে তারা চিন্তিত নন। যদিও গেল দশকে চিত্রটা ছিল সম্পুর্ণ ভিন্ন। এখন, এই যে উপেক্ষা সেটি আগামী বছরও একই রকম থাকবে তো?

রোনালদো বিষয়টি নিয়ে নিশ্চুপ থাকলেও তার বোনদ্বয় টুইটারে তোপ দেগেছেন সমানে। স্বভাবতই রোনালদোর বদলে মদ্রিচের নামটি তাদের হতাশ করতে পারে, তা থেকে টুইট বোমা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু, রোনালদো যদি আগে থেকেই জেনে থাকেন যে তিনি নন, লুকাই পেতে যাচ্ছেন বর্ষসেরার খেতাব তাহলে তার আরো আগে অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হওয়া উচিত ছিল। তার পক্ষে যা বয়ান দেয়ার বা সাওয়াল তোলার সেটি মিডিয়াই তুলছে, মিডিয়াই তুলত। দীর্ঘদিন এর সতীর্থকে সামনে থেকে সমর্থন জানালে রোনালদো উদারতার নয়া নজির গড়তে পারতেন। হ্যা, রিয়ালের সাথে তার সম্পর্কের ইতিটা মধুর হয়নি। সেটির দায় তো মদ্রিচের না। বরং, রোনালদোর পাঁচটি ব্যালনের যে কয়টির ক্ষেত্রে দলীয় সাফল্য প্রাধান্য পেয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে তাতে লুকারও অবদান ছিল। সুতরাং, রোনালদো যদি হাজির হতেন তাহলে তার নামের মহিমা মোটেও কমত না। যেহেতু, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফুটবলারদের মধ্যে তার অনুসারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তাই তার উপস্থিতি বরং অনুপ্রাণিত করত অনেককে। যারা বলবেন যে, প্রহসনের প্রতিবাদে এই বয়কট; সেটির পূর্ণ জওয়াব দেয়ার আগে এইটুকু বলে রাখি, রোনালদোর হয়ে মিডিয়াই সাওয়ালগুলো তুলছে। আর প্রহসনের শিকার হওয়া পয়লা আদমিও তিনি নন।

মেসি পরিবার অন্তঃপ্রাণ মানুষ, সেটি কতটা; তা প্রমাণের জন্য তিনিও কেন এ রাতটিকেই বেছে নিলেন সেটিও বিস্ময়কর। মিডিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে তার বিপুল সমর্থক থাকার কারণে অধিকাংশ দেশি মিডিয়াই চেষ্টা করে তাকে দেবতূল্য রুপে হাজির করতে। মানুষ হয়ে জন্মানো যে কারো জন্যই দেবতার রুপ ধারণ করা কঠিন, তবু মেসি বেশ ইতিবাচক একটি চারিত্রিক ধারাই বজায় রেখে এসেছেন এতদিন। রোনালদোর সাথে প্রকাশ্য না হলেও মানসিক একটা দ্বৈরথ যে তার রয়েছে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। রোনালদোকে সর্বদাই পিছনে ফেলার প্রয়াশে ব্রত এই বার্সা তারকা এমন এক জায়গায় রোনালদোর সাথে এক বিন্দুতে মিললেন যেটি না হলে তার সমর্থকরা অন্তত গর্ব করার সুযোগ পেত। হ্যাঁ, মেসির মতন মানুষের জন্য পঞ্চম হওয়াটা হতবাক করার মতই। কিন্তু, তাতে হতাশ হয়ে মঞ্চেই হাজির না হওয়াটা আরো হতাশার। যাদের ক্রমে তার সামনে রাখা হয়েছে তাদের চেয়ে যে তিনি বেহতার সেটি বেবোধও বোঝে। সুতরাং, অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে যে তার ইজ্জতের রফাদফা হতো এমন কিছু না। তার সামনে বরং আরো বড় সুযোগ ছিল। চির বৈরি দলের তারকাকে সম্মান জানিয়ে নিজের সম্মানকে নয়া উচ্চতায় নেয়ার।

পুরো মৌসুমে আন্তর্জাতিক বিরতি, মৌসুম শেষে বিরতি বা সপ্তাহ শেষে বিরতি বাদ দিয়ে ঠিক ব্যালন প্রদানের রাতটিকেই কেন প্লে স্টেশনে নিজের জান লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, সেটি নেইমারই ভালো বলতে পারবেন। মেসি রোনালদোর পরবর্তী সময়ের ফুটবল সম্রাট হিসাবে তার নামই বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। তিনি বাদ দিয়ে লুকার হাতে সে সাম্রাজ্যের সাময়িক হাত বদল তাকে আহত করতেই পারে। কিন্তু, সেটি তিনি যে পন্থায় প্রদর্শন করলেন; তাতে যদি আগামীবার তিনিই জিতেন তাহলে পরিপূর্ণ স্বস্তির সাথে নিতে পারবেন তো? উপমহাদেশের রাজনীতির নেতাদের আদর্শ মানলে সেটি ভিন্ন কথা। নতুবা, যে কায়দায় তিনি উপেক্ষা করলেন, শেষে না তা আক্ষেপের কারণ হয়ে দাড়ায়।

অনেকে বলছেন এই ত্রয়ীর অনুপস্থিতি ব্যালনের ঔজ্বল্যকে ম্লান করেছে। আমার আদতে তা মনে হয় না। বরং, যে রুপে তারা সংসদ বয়কটের মতন পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান বয়কট করে চলেছেন তাতে আগামীবারই যদি এদের কেউ জয়ী হয়, এ সে পুরষ্কার হাতে তারা তার মহিমা বয়ানের প্রয়াস চালান, অনেকের নিকটই সেটি কৌতুককর ঠেকবে। লুকার এক জয়ে ব্যালন কতটা ইজ্জত হারিয়েছে জানি না; তবে, পরিস্থিতির উত্তেজনায় দশক শাসন করা দুজনের সমর্থকরা যে সকল বয়ান রাখছেন সেটি আখেরে তাদের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সবদিক বিবেচনায় এবারের ব্যালনটি ছিল ব্যতিক্রম। ইজ্জ্বত হরণের যে তত্ত্ব নয়া তাত্ত্বিকরা দিচ্ছেন তা বাস্তবিক অর্থে ঘটেছে যখন ফিফা আর ব্যালন একত্রিত হয়েছিল তখনই। ফিফার সাথে একত্রিত হবার আগে ব্যালন জয়ী বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকতেন ফুটবল বিশ্বের নামকরা সব সাংবাদিক এবং বিশ্লেষকরা; ফিফার সাথে বিচ্ছেদের পরে আবার যে রাওয়াইয়্যাত চালু হয়েছে। যার ফলে এটির সম্মান, মর্যাদা ছিল আলাদা। এবং, এদের দ্বারা বাছাইটা হত বলেই ডিফেন্ডার হবার পরেও ব্যালন জিততে সক্ষম হয়েছিলেন ক্যানাভারো। কেননা, তখন শুধুই গোল সংখ্যা না; বরং পুরো মৌসুমে একজন খেলোয়াড় সে যে পজিশনেরই হোক তিনি ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেবার ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রাখছেন সেটি ছিল মূল বিবেচ্য।

ফিফা ব্যালনের সাথে যুক্ত হবার পর যে প্রক্রিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ শুরু হয়, সেটাই বরং নিঃশঙ্কোচে সম্ভ্রম লুটেছে এ পুরষ্কারের। গেল দশ বছরে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল সেরা খেলোয়াড় না, সেরা গোলদাতাকে পিচিচির সাথে বাড়তি হিসাবে ব্যালন দেয়া হচ্ছে। রোনালদোর সাথে যে অন্যায়টি হয়েছে বলে এতো শোর, সেটি এর অনেক আগেই ইনিয়েস্তা, স্নাইডারদের সাথে হয়ে গিয়েছে। পুরষ্কার হাতে লুকাও বিষয়টি উল্লেখ করতে ভুলেননি। হ্যাঁ, এবারের ব্যালনটি লুকারই প্রাপ্য এমনি শতভাগ জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই, তবে; অমানিশায় অন্তত এইটুকু আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে; ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন পূর্বের ভুলটি অনুধাবন করেছে। এবং সেটি থেকে তারা বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে।

আর লুকার এ বিজয় বেইজ্জতিকর বলে যারা দাবি করছেন, তাদের বিষয়টি স্পষ্ট না। এহেন কি পাপ করে ফেলেছেন বান্দা যে, তার জয়ে পুরো বিষয়টিই বেইজ্জতিকর হয়ে গেল? বরং, অনুতাপ হওয়া উচিত যে, প্রশ্নবিদ্ধ বাছাইয়ের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার বঞ্চিত হয়েছেন একাধিক আদমি। তাদের তখন নিশ্চুপ থাকাটা বরং, বাজে দৃষ্টান্ত। লুকার বাকি সব বাদ দিন, যে রকম নেতৃত্ব দিয়ে ক্রোয়েশিয়ার মতন দলকে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন তাতে, তার ব্যালনজয় পাপসম হতে পারে না অন্তত।

গেল দশক ধরেই রোনালদো মেসির শ্রেষ্ঠত্বের তর্কে তাদের সমর্থকরা ব্যালনকে বরাবরই সামনে নিয়ে এসেছেন। এ রাতে তারা যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন তাতে সামনেও তারা এমনটি করেন কি না সেটি দেখাটা হবে বেশ মজার। আজকে উপেক্ষার, কালকেই আরাধ্য এবং ঐশ্বরিক; বিষয়টি যদি এমন হয় তাহলে গিরগিটির মতন রঙ বদলানো কিছু রাজনৈতিক নেতার সুবিধা হবে। বেশ জোর গলায়ই তারা বলতে পারবেন, তাদের যে আদর্শের সমালোচনা আমরা করি, সেটি অন্যায্য। কেননা, তাদের চরিত্র আমরা না বুঝলেও ফুটবল অঙ্গনের রাজা-মহারাজারা ঠিকই বুঝেছেন।

শ্রেষ্ঠত্ব শুধু গোলেই নির্ধারিত হয় না, ফিফা ব্যালনের বিতর্কিত প্রণয়ের পূর্বে এমনটা দেখা যায়নি। বরং মাঠে একজন খেলোয়াড়ের থাকা না থাকার প্রভাবটাই ব্যালন বিজয়ের ক্ষেত্রে বিবেচিত হত। এবার হয়ত বিতর্ক হচ্ছে; এর অন্যতম একটি কারণ, একটি প্রজন্ম ঐ প্রক্রিয়ায় সেরা নির্ধারণ হতেই দেখেনি। তবে, এ বিতর্ককে উপেক্ষা করে ব্যালন কতৃপক্ষ যদি পূর্বের চরিত্রে ফিরতে পারে তাহলে রবেন, রিবেরি, স্নাইডার, ইনিয়েস্তাদের মতন নয়া কোনো অভাগা জনম নিবে না। তারমানে এও না যে, ঐ প্রক্রিয়ায় ফিরে গেলে মেসি বা রোনালদো কখনোই বহুচেনা এই স্বর্ণ গোলক হাতে নিতে পারবেন না। বরং, চলতি মৌসুমের হাল হকিকত দেখে মনে হচ্ছে আগামীবারই এমনটা ঘটার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে।

কৌতুহলী মন অনেকে সাওয়ালেরই জওয়াব খুঁজে হয়রান হয়। যেমন, খুব জানার ইচ্ছে আগামী মৌসুমের শীর্ষ তিনে যদি বয়কট করা তিনজনের নাম থাকে তারা কি তখন অনুষ্ঠান স্থলে হাজির হবেন? শূন্য প্লে স্টেশন, কিংবা বাবাকে ছাড়া মাত্তেওর সময়টা কেমন কাটবে ভাবছি। টুইটারে মিডিয়া কর্মীদের আর কি কি ভাষায় আক্রমণ করা যায় সেটিও চিন্তার। সে চিন্তা আমিই করি, মদ্রিচ বরং উপভোগ করুন। অভাগাদের উপেক্ষার জওয়াব তো দেয়া গেল!