এক দশক পরে ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ পুরষ্কার ব্যালন ডি’অরকে স্বর্গ থেকে মর্তে নামিয়ে আনলেন বলকান ম্যাজিশিয়ান লুকা মদ্রিচ। মেসি-রোনালদোর আগে এক দশক পূর্বে সর্বশেষ এ পুরষ্কারটি জিতেছিলেন তৎকালীন মিলান তারকা কাকা। ক্রোয়েশিয়া এবং মাদ্রিদের হয়ে স্বপ্নের মত মৌসুম কাটানোর পুরষ্কারই পেলেন মদ্রিচ।
মজার বিষয় হচ্ছে মদ্রিচের বিশ্বজয়ে বিতর্ক জমেছে বেশ। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এর উত্তাপটা টের পাওয়া যাচ্ছে বেশ ভালো করেই। কারো কাছে এটা বছরের সেরা কৌতুক তো কারো কাছে নির্মম প্রহসন! বিষয়টি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দেখলে বেশ কৌতুককর বলেই মনে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে গত এক দশকের মধ্যেই ব্যালন তার মর্যাদার অনেকটাই হারিয়েছে। এটা নিয়ে তেমন শোর হয়নি কেননা, বিজয়ী দুজনের সমর্থকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমন একজনের এটা জেতা প্রয়োজন ছিল, যার জয় চোখ খুলে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত মদ্রিচের মাধ্যমেই সেটি হল।
একটু পিছনের দিকে ফেরা প্রয়োজন। আপনি যদি বলেন যে, নৈপুণ্যের বিচারে এবার রোনালদোকে বঞ্চিত করা হয়েছে; তাহলে এটুকুও একটু ইয়াদ করে দেখেন এমন বঞ্চনার শিকারের তালিকাটা কিন্তু বেশ বড়ই। জাভি, ইনিয়েস্তা, স্নাইডার কিংবা রবেন; গত একদশক বিবেচনায় এদের অন্তত একজনের ব্যালন প্রাপ্য ছিল। আজকে যেটি অন্যায় বলে মনে হচ্ছে সে অন্যায়টির শিকার এরা হয়েছেন; তখন এতটা হইচই হয়নি, কেননা ব্যালনটি গিয়েছিল পছন্দের কারো হাতে।
ফিফা আর ব্যালন যখন একত্রিত হয়ে পুরষ্কারটি দেয়া শুরু করে তখন থেকেই নিষ্কলুষ ব্যালন নিয়ে প্রশ্ন উঠা শুরু। প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বাছাই প্রক্রিয়া। একাধিকবার ব্যালন প্রদান শেষে বিভিন্ন দলের কোচ এবং অধিনায়ক তাদের ভোট জালিয়াতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুললেও সেটি কেউই কর্ণপাত করেননি। একটি বিষয় খেয়াল করুণ, যে সময়কালটার কথা বলা হচ্ছে তখন যারা কর্তা ছিলেন তাদের অধিকাংশই ফিফা থেকে নির্বাসিত দুর্নীতির দায়ে। এর সামান্য আচড়ও যে ব্যালনের গায়ে পড়েনি এটা হলফ করে বলার সুযোগ বোধহয় নেই।
কিসের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় তা আজ অব্দি স্পষ্ট না। মদ্রিচের বিষয়টি আমলে নিলে ধারনা করা যায় যে, দলগত নৈপুণ্য এখানে একটি বড় নিয়ামক। যদি এটিই হয় তাহলে ইন্টার যে বছর ঐতিহাসিক ট্রেবল জিতল সে বছর বিবেচনায় তো স্নাইডার বেশ বড় দাবীদার ছিলেন ব্যালনের। অথবা স্পেন যেবার বিশ্বকাপ জিতল সেবার ইনিয়েস্তা। সেবার কিন্তু বলা হয়েছিল, এটা ব্যাক্তিগত নৈপুণ্যের পুরষ্কার। যার ফলে ভাগ্য শিকে ছিড়েনি কারো। এখন, এটা যদি বিশ্বাস করেন তাহলে এ মৌসুম বিবেচনায় রোনালদোই ব্যালনের দাবিদার ছিলেন। রিয়ালের হয়ে স্বপ্নের মতন মৌসুম কাটিয়ে তুড়িনের বুড়িদের জার্সি গায়েও বাজিমাত করছেন তিনি। কিন্তু, এবার আমলে নেয়া হয়েছে দলগত সাফল্য।
অতএব এটা পরিষ্কার যে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নিয়ে গোলমাল রয়েছে। আরো যদি গভীরে যাই, খেলাধুলাটা এখন আর শুধুই খেলাধুলা নেই। বাণিজ্য লিপ্সা’র অন্দরে বেশ গভীর ভাবেই প্রবেশ করেছে। আইসিসির সাথে ফিফার যে পার্থক্য সেটি হচ্ছে ক্রিকেটের বড় বাজারটা ভারতের দখলে থাকায় আইসিসির ওপর ভারত যেমন একাধিপত্য কায়েম করে ক্রিকেটকে দিন দিন মূমুর্ষ অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে সেখানে ফুটবলে একাধিক সমশক্তির দেশ থাকায় ফিফা নগ্নভাবে বাণিজ্যিক হতে পারছে না। কিন্তু, তারপরেও যে কর্তাদের বাণিজ্য এবং অর্থলিপ্সা মোটেও কম না তা সেপ ব্ল্যাটার গংদের নিষিদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়েই আমরা দেখেছি। এই শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের নিয়ামক হিসাবে বাণিজ্যিক দিক যে একেবারেই কাজ করেনি এটা বিশ্বাস করা কঠিন।
গত দশক জুড়ে রোনালদো-মেসির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। তা যে এখন নেই তা না। তবে, গেল বছরের কিছু ঘটনা তাদের জনপ্রিয়তায় পুরোপুরি না হলেও বাজারে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। ব্যালন জয়ী নির্ধারনের আগে সামনে চলে এসেছে রোনালদোর ধর্ষণ কাহিনী। এখনো বিষয়টি প্রমাণিত না হলেও এটি তার ইমেজের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা অস্বীকার করার জো নেই। এ ঘটনা প্রকাশের পরপর ইলেট্রনিক আর্টস যারা বহুল জনপ্রিয় ফিফা গেমটি তৈরি করে থাকে, তারা তাদের ফেসবুক কভার পিকচার থেকে তাৎক্ষণিকভাবেই রোনালদোর ছবি সরিয়ে নিয়েছিল। মেসির ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে; সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপটিতে তাকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ ছিল বেশ উচুতে। আরো একটি বিশ্বকাপ ব্যর্থতা মেসির জন্য কাজ করেছে নেতিবাচক হিসাবে। নতুবা, গত মৌসুম বলুন বা চলতি মৌসুমের অদ্যাবধি; দুজনের নৈপুণ্য কোনো অংশেই মদ্রিচের চেয়ে খারাপ না। মেসির ক্ষেত্রে বিষয়টা তো আরো বিস্ময়কর, কেননা তিনি শীর্ষ তিনেই জায়গা পাননি। যারা নিয়ত ফুটবলের খোজ রাখেন, তারা এতে বিষম খেয়েছেন স্বাভাবিক। মেসির খেলার এতটা অবনতি হয়নি, কিংবা তার আগের দুজন এমন আহামরী কিছুও করেনি যে মেসি শীর্ষ তিনেই জায়গা পাবেন না। চলতি মৌসুমে আরো একটি দিক নজর আকর্ষণের দাবি রাখে। রোনালদোর দলবদলে মেসি রোনালদোর যে দ্বৈরথ তা আগের মতন আর থাকবে না।
স্বভাবতই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা এসব পুরষ্কারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক তাদের প্রয়োজন ছিল নয়া মুখের। হ্যা, মদ্রিচ এর দীর্ঘস্থায়ী সমাধান না, তবে এটির মাধ্যমে নতুন পথ তো তৈয়ার করা হল। মেসি রোনালদোর বিকল্প হিসাবে নেইমারকে ভাবা হলেও গত মৌসুমের নৈপুণ্য এবং বিতর্ক বিবেচনায় তিনি বাণিজ্যের জন্য সঠিক না। আবার এমবাপ্পেকে শুধু বিশ্বকাপ বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করাটা আরো বিতর্কের জন্ম দিত। সবদিক বিবেচনায় ভাগ্য লক্ষী সহায় ছিলেন মদ্রিচের।
তবে, সবদিক বিবেচনায় রেখেই বলছি; মদ্রিচের ব্যালন জয়ে ব্যালন কলুষিত হয়েছেন বলে যারা দাবি করছেন সেটার সাথে আমি একমত হবার কোনো কারণ দেখছি না। বান্দা কিছুই করেনি এমন তো না। আর ব্যালন কলুষিত হয়েছে যখন ব্যালনের সাথে ফিফা যুক্ত হয়েছিল তখনই। প্রত্যেকবারই শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ শেষে কর্তাদের নানাবিধ যুক্তি নামক কৌতুকের জন্ম দিতে দেখা গিয়েছে তখন। বরং, মদ্রিচের এই ব্যালন জয়টা ইনিয়েস্তা, রবেনদের উপেক্ষার জওয়াব বলা যায়।
ব্যালন কি সত্যই শ্রেষ্ঠত্বের নির্ধারক কি না সেটি নিয়ে এখন বেশ একটা তর্ক জমবে। কাগজে কলমে মদ্রিচ বিশ্বের সেরার খেতাব পেলেও বাস্তবতা বিবেচনায় জায়গাটি এখনো রোনালদো মেসিরই। কিন্তু, এ ধাক্কাটার দরকার ছিল। কেননা, এর আগেও যখন ব্যালন নিয়ে এমন বিতর্ক হয়েছে তখন দু’পক্ষ নিজ নিজ জায়গা থেকে সাফাই গেয়েছে। এবার গণেষ উল্টানোর সাথে সাথে সুরও বদলে গিয়েছে।
মেসি রোনালদোর ওপর অবিচার করা হয়েছে কি না সে তর্ক ভিন্ন। তবে, মদ্রিচের এই জয়টা নতুন শুরুর একটি ভালো সময় হতে পারে। মেসি রোনালদো এখনো যেমন খেলছেন তাতে তারা আরো দু-তিনবার ব্যালন জিততেই পারেন। তবে, সেটা বিতর্কমুক্ত হবে, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবান্বিত না; এটাই কাম্য। গত দশক জুড়ে তারা অবিশ্বাস্য খেলেছেন সত্য, কিন্তু প্রত্যেকটি ব্যালনই যে তাদের প্রাপ্য ছিল এটা বলা কঠিন।
তবে, এসব বিতর্কের কারণে মদ্রিচকে অভিনন্দন না জানানোটা অন্যায় হবে। কারণ, তিনি সন্দেহাতীতভাবে সেরা না হলেও যা করেছেন তাও কম না। বিশেষ করে বিশ্বকাপে। সামনের দিনগুলোতে যে সকল অপ্রিয় সাওয়াল সামনে আসছে তার জওয়াব দেয়ার দায়িত্ব তারই। সেটা পারবেন কি না তা সময়ই বলে দিবে, তবে স্বর্গ থেকে ব্যালন কে মর্তে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বাড়তি অভিনন্দন তিনি পেতেই পারেন।