আত্নঘাতী গোল প্রাণঘাতী রুপে হাজির হলো যার জন্য!

মেডেয়িনের অভিশাপ : পর্ব ২

আত্নঘাতী গোল প্রাণঘাতী রুপে হাজির হলো যার জন্য!

ঘটনাস্থল কলম্বিয়ার মেডেয়িন শহরের ‘এল ইন্ডিগো’ বারের পার্কিং লট। নিজ গাড়িতে বসে তিন অচেনা ব্যাক্তির সাথে তর্কে লিপ্ত কলম্বিয়ান জাতীয় দলের রক্ষণভাগের সেনা আন্দ্রেস এস্কোবার। তর্কের মাঝপথেই আচমকা গর্জে উঠল পয়েন্ট থার্টি এইট ব্যারলের পিস্তল। একবার-দু’বার করে মোট ছ’বার। সাথে পিস্তলধারীর ‘গোল’ বলে চিৎকার। রক্তে ভেসে গেলেন আন্দ্রেস। হাসপাতালে নেবার ৪৫ মিনিট পর ডাক্তাররা আনুষ্ঠানিক ভাবে মৃত ঘোষণা করলেন আন্দ্রেসকে। কিন্তু কেন জীবন দিলেন আন্দ্রেস? আর আততায়ীই বা কে ছিলো?

১৯৬৭ সালের মার্চের ১৩ তারিখ মেডেয়িনে জন্ম নেয়া আন্দ্রেস ছিলেন কলম্বিয়ান রক্ষণভাগের অন্যতম স্তম্ভ। স্থানীয় ক্লাব অ্যাথলেটিকো ন্যাশনালের হয়ে ক্লাব ফুটবলে আগমন ঘটে আন্দ্রেসের। যে ক্লাবের মালিক ছিলেন পাবলো এস্কোবার। খেলেছেন নিজ বিদ্যালয়ের ফুটবল দলেও। জীবনের পুরোটা সময়ই অ্যাথলেটিকোর জার্সি গায়ে মাঠ মাতানো আন্দ্রেস মাঝে এক বছরের জন্য সুইস ক্লাব ইয়ং বয়েজে যোগ দিলেও মাঠে নামেননি একবারও। ক্লাবের হয়ে ধারাবাহিক নৈপুন্য দেখিয়ে ‘৮৮ সালে জায়গা করে নেন কলম্বিয়া জাতীয় দলে। মাত্র ছ’বছরের ক্যারিয়ারে ৫১ বার কলম্বিয়ার জার্সি গায়ে তুলেছিলেন আন্দ্রেস।

‘৯৪ এর বিশ্বকাপে অংশ নেয়া কলম্বিয়ান দলটি ছিলো তাদের ইতিহাসের সেরা। এর পিছনে যে আরেক এস্কোবার, পাবলোর অবদান ছিল সেটি তো গেল পর্বেই উল্লেখ করেছি। ভালদেরামা, রিঙ্কন, অ্যাস্প্রিয়াদের নিয়ে গড়া দলটির প্রতি সবার প্রত্যাশার পারদ দিন দিন বেড়েই চলছিলো। অনেকের চোখেই কলম্বিয়া ছিলো বাজির ঘোড়া। আর এটিই কাল হয়ে দাড়ায় আন্দ্রেসের জন্য। কলম্বিয়ার উপর বিশাল অংকের বাজি ধরেন মাদক ব্যাবসায়ি সান্তিয়াগো গ্যালিওন। পাবলো হত্যার পিছনের অন্যতম মূল কারিগর গ্যালিওন ভাইদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে আন্দ্রেসের আত্মঘাতী গোলে কলম্বিয়ার বিদায় নিশ্চিত এর সাথে বিশাল ক্ষতির মুখে ফেলে দেয় গ্যালিওনকে। যার উশুল তিনি করার চেষ্টা করেছেন নিজ দেহরক্ষী মুনোজকে দিয়ে আন্দ্রেসকে নির্মমভাবে হত্যা করিয়ে।

আন্দ্রেস এস্কোবার

গত পর্ব পড়ে থাকলে আন্দ্রেসের আত্মঘাতী গোলটির হেতু আপনার জানার কথা। যার সঙ্গ থেকে পরিত্রাণ পাবার পথ খুজে ফিরতেন আন্দ্রেস সে পাবলোর মৃত্যু স্বস্তির বদলে জন্ম দেয় নয়া শঙ্কার। পাবলোর জীবদ্দশায় তিনি ব্যতীত অন্য কেউ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের দিকে তাকাতেন না। অন্ধকার রাজ্যের অবিসংবাদিত রাজা হলেও পাবলোর হাতে কোনো ফুটবলার হেনস্তা হয়েছেন এমন নজির নেই। কিন্তু, পাবলোর মৃত্যুর পর বদলে গেল দৃশ্যপট। শুধু গ্যালিওন ব্রাদার্সরাই না অন্যান্য ড্রাগ কার্টেলও আগ্রহী হয়ে উঠলো ফুটবল নিয়ে। তবে, এটি হয়ে উঠল ভয়াবহ। কারণ, তাদের ফুটবল প্রেমের মূলেই ছিল অন্ধ অর্থ লিপ্সা। যার ফলে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ শেষেই ম্যানেজারকে হুমকি, তার আগে এক খেলোয়াড়ের শিশু সন্তান অপহরণ মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল দুর্দান্ত দলটির। সে অস্থির মানসিকতারই শেষ নজির আন্দ্রেসের আত্মঘাতী সে গোলটি।

আন্দ্রেসের এ পরিণতি মানতে পারেননি কলম্বিয়ার সাধারন জনগণ।  ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ আন্দ্রেসের ছবি, মুখোশ নিয়ে সমবেত হন শেষকৃত্যে। ২০০২ সালে মেডেয়িন এ উন্মোচন করা হয় আন্দ্রেসের মুর্তি। মেডেয়িন মূলত কুখ্যাত আরেক এস্কোবার মাদক সম্রাট পাবলোর জন্য। মেডেয়িন এই আন্দ্রেসের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে যিনি নিহত হন বন্দুক যুদ্ধে। এখনো মেডেয়িন এর অনেকেই বিশ্বাস করে পাবলো সেদিন বেচে থাকলে আন্দ্রেসকে মারবার সাহস করতো না সান্তিয়াগো। ‘৯৫ সালে বিচারে দোষী সাব্যস্ত মুনোজের ৪৩ বছরের সাজা হলেও ২০০৫ সালে মাত্র ১১ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান হুমবার্তো কাস্ত্রো মুনোজ।

মাত্র একবছরের ব্যবধানে দু’বার রক্তে রঞ্জিত মেডেয়িন’র মানুষের পরিচয় হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি অনুভূতির সাথে। পাবলোর মৃত্যুতে উচ্ছ্বসিত মেডেয়িন স্তব্ধ হয়ে যায় আন্দ্রেসের মৃত্যুতে। শুধু মেডেয়িনই কেনো পুরো ফুটবল বিশ্বই চমকে উঠেছিলো এই খবরে। আত্মঘাতী গোল যে প্রাণঘাতী রুপে হাজির হয়নি আর কারো জন্যই।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যে পাবলো ছায়ার মত তাড়া করে ফিরতো আন্দ্রেসের মনে, সে পাবলোর মৃত্যুর পর তিনিই যে এমন পরিণতি ভোগ করবেন সেটি বোধহয় ভুলেও ভাবেননি। খুব অল্প সময়েই মধ্যেই দু’বার রক্তে রঙ্গিন হল মেডিয়িন’র মাটি। একবার তা আপাত স্বস্তি এনে দিলেও পরের বার চমকে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকেই। মেডেয়িনও যেন পরিণত হল এমন এক অভিশাপে, যে নামটি যখনই শিরোনামে আসে তখনই জন্ম নেয় বিষাদের এক গল্প।