নীল রঙ্গা পোলো শার্ট গায়ে নিথর নিস্তেজ দেহটি পড়ে রয়েছে। সাথে ফেড ডেনিম জিন্স, পায়ে স্পোর্টস শ্যু। লাশটিকে ঘিড়ে ভিড় জমিয়েছে কলম্বিয়ান আর্মির বিশেষ বাহিনী ‘সার্চ ব্লক’ এবং আমেরিকান মাদক নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা ‘ডিইএ’র এজেন্ট স্টিভ মার্ফি। ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে পোজ দিচ্ছে সবাই। লাশকে সামনে রেখে ইনসানিয়াতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনকারী এ বান্দাদের উল্লাসকে বর্বোরোচিত মনে হচ্ছে? হওয়াটিই স্বাভাবিক। কিন্তু, যদি শোনেন যে লাশটি পাবলো এস্কোবারের তাহলে মুহুর্তের জন্য মনের মাঝে সৃষ্টি হওয়া বিদ্বেষটুকু নিমিষেই উবে যাবে। এটি ছিলো ‘৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসের দুই তারিখের ঘটনা। পাবলোর ৪৪ তম জন্মদিনের ঠিক পরের দিন। খেলার পাতায় অপরাধ জগতের, আরো স্পষ্ট করে বললে মাদক সাম্রাজ্যের অবিসংবাদিত সম্রাট এর স্মরণ বিস্ময়ের হেতু হওয়া স্বাভাবিক। এক দমকে নয়, বরং ধীরে ধীরে বয়ান করবো পুরো বিষয়টা।
একজন মানুষ জীবদ্দশায় কতগুলো অপরাধ করতে পারে? আপনার আমার অনুমানের দৌড় বড়জোর খুন, ধর্ষণ, মাদক পাচার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু, তিনি ছিলেন পাবলো এস্কোবার। খুন, মাদক পাচার তো নস্যি। বোম্বিং, চলন্ত প্লেন উড়িয়ে দেয়া, প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থিকে প্রকাশ্যে খুন, এমনকি তার অপকরর্মের দালিলিক প্রমাণ নাই করে দেয়ার জন্য গোটা কোর্ট হাউজটাই উড়িয়ে দেয়া শুধু পাবলোর পক্ষেই সম্ভব। আশ্চর্য বিষয় এই যে, এহেন অপকর্মের পরেও তার নিজ শহর মেডেয়িনে এখনো পাবলো অনেকের কাছেই দেবতূল্য। তার কারনও আছে বৈকি। মেডেয়িনের রবিনহুড নিজ এলাকায় প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছেন, করেছেন হাসপাতাল। দূস্থদের জন্য করেছেন বাসস্থানের সুব্যাবস্থা। পাবলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি একটি আশ্চর্যরকমের দ্বিমুখী মানুষ ছিলেন। উপরে তার যে অপরাধগুলোক বয়ান দেয়া হয়েছে তা সংগঠিত করতে গিয়ে পাবলো প্রাণ নিয়েছেন হাজার চারেক জনের। আবার এই একই আদমি, নিজ শহর মেডেয়িন এর তরুণদের মাদকের মোহ থেকে রক্ষা করতে গড়ে তুলেছিলেন একের পর এক মাঠ। ব্যবস্থা করেছিলেন ফ্লাড লাইটের। এটুকুতেই থামেননি, নিজে উপস্থিত থেকে তরুণদের উৎসাহ যোগাতেন। পাবলোর মমতাময়ী মনের অন্যতম উদাহারণ হিসাবে একটি ঘটনার জিকর করা হয়। যেটি এমন সময় ঘটেছিল যখন পাবলো সার্চ ব্লক, ডিইএ, সিআইএ সহ নানা প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তখনকার। শীতের এক রাতে পাবলো আশ্রয় নিয়েছিলেন তার এক সেফ হাউসে। আচমকা পাবলোর উপস্থিতি নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। যার ফলে বন্দোবস্তোও তেমন তন্দুরুস হয়নি। তা সে সময় শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্য ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালতে গিয়ে দেখা গেল কাঠ ভিজে রয়েছে কুয়াশায়। কিন্তু পাবলো দমবার পাত্র হলে তো হতই। সঠিক সংখ্যাটি কেউই বলতে না পারলেও অনুমান করা হয় সে রাতে শুধু মেয়ের উষ্ণতার বন্দোবস্ত করতে গিয়ে পাবলো আগুন জ্বালানোর জ্বালানি হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন কয়েক মিলিয়ন ডলারের নোট! আশ্চর্যই বটে!
সাধারণ এক মাদক পাচারকারী হিসেবে পাবলোর দিনকাল বেশ ভালোই যাচ্ছিলো। বিপত্তিটা শুরুটা বাধে এক তেলাপোকা তথা ককরোচকে দিয়ে। সাধারণ চোরা কারবারি পাবলোকে চিনতে ভুল করেনি অভিজ্ঞ মাদক ব্যবসায়ী ককরোচ। ককরোচ মাঠে আর পাবলো ব্যবস্থাপনায়; এমনভাবেই শুরু হলো অপরাধ জগতে পাবলোর যাত্রা। দুজনের কর্ম তৎপরতায়! তখন ত্রাহী মধূসদন অবস্থা বাকিদের। সারাজীবন দারিদ্রের সাথে লড়াই করা পাবলোর তখন টাকা রাখার জায়গার অভাব! আর এ অভাব দূর করতে তিনি যতগুলো পথ বেছে নিয়েছিলেন তার একটি ছিল ফুটবলে লগ্নি; সে বিষয়ে পরে আসছি। পাবলোর ঢালাও অর্থ উপার্জন অনেকের চোখে লাগলেও তখনো তিনি ডিইএ বা সরকারের সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হননি। পয়সা কামানোর সাথে সাথে পরিস্থিতির পূর্ণ গুরুত্ব বুঝে সিদ্ধান্ত নেবার বদলে বেপোরোয়া পাবলো তুচ্ছজ্ঞান করতে লাগলেন সবাইকেই। যেটি থেকেই বিপত্তির শুরু। ড্রাগ লর্ড হিসাবে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া পাবলোর আচমকাই বাসনা জাগে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করার। তা তিনি করেছেনও বটে, তবে সেটির মূল্য চুকিয়েছেন জীবন দিয়ে। তখনো সরকারের পুরো নজর পাবলোর ওপর ছিলো না; কিন্তু যখন তিনি কলম্বিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য হবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন এবং পূর্ণ সুবিধাভোগী মধ্যস্ততাকারী ঢুকে এবং একজন সাংবাদিকের প্ররোচনায় পুরোদস্তর প্রচারণায় নেমে নির্বাচনে জিতেও যান তখনই অপরাধ জগতে প্রবেশের পর প্রথম বার বাঁক নেয় পাবলোর জীবন। ইতিহাসটা বদলে গেলো তখন থেকেই। তৎকালীন বিচার মন্ত্রী লারা ইবোরা পাবলোর বিপক্ষে সরাসরি মাদক পাচারের অভিযোগ এনে তাকে পার্লামেন্ট থেকে ইস্তফা দেয়ার আহ্বান জানালেন। পাবলো ইস্তেফা দিয়েছিলেন ঠিকই, সাথে লারা ইবোরার জীবনটা নিয়ে। লারার অপমানে পাবলো হয়ে উঠেন আরো বেপোরোয়া এবং নৃশংস। তখন, পাবলো আর তার মেডিয়িন কার্টেলকে থামানোর জন্য কলম্বিয়া সরকার আমেরিকার সাথে বন্দি প্রত্যাবর্তন চুক্তি করলো উপায়ন্ত না দেখে। যা ছিলো পাবলোর সবচেয়ে বড় ভয়। এর পিছনে যে শুধু মৃত্যুভয়ই কাজ করেছে এমন না, শুনতে অবাক লাগলেও সত্য যে ভয়ের পিছনে আরো যে বিষয়টি পাবলোকে স্বস্তি দিচ্ছিলো না সেটি হচ্ছে মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার বেদনা। আগেই উল্লেখ করেছি, পাবলোর মাঝে এক আশ্চর্য দ্বিমুখীতা ছিল। যাই হোক, এ চুক্তি বাতিলের জন্য পাবলো বেছে নিলো সহিংস পথ। চুক্তির পথে উচ্চকণ্ঠ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থিকে প্রকাশ্যে খুন করেই থামলেন না, একের পর এক অপহরণ, বোমাবাজিতে অশান্ত করে তুললেন কলম্বিয়াকে। শেষ পর্যন্ত নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিজার গাভেরিয়া পাবলোর দাবী মানতে বাধ্য হন। এই গাভেরিয়াকে হত্যার জন্য পাবলো প্লেনে তার এক অনুগতকে দিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিলেন। ডিইএর পরামর্শক্রমে গাভেরিয়া সে ফ্লাইট বাতিল করলে জীবন দেয় নিরীহ প্রায় শ’খানেক মানুষ, প্রাণে বেঁচে যান সিজার গাভেরিয়া। চুক্তি হয় নিজের তৈরি জেল ‘লা কাতেরদালে’ নিজের সাজার মেয়াদ শেষ করবেন পাবলো। পরিহাস এই ছিলো যে সে জেলের দু’মাইলের ভেতরে কোনো আর্মি বা পুলিশের প্রবেশাধিকার থাকবে না !!! আবারো বাঁক নিলো পাবলোর জীবন।
যার দৈনিক আয় ছিলো আমেরিকান ডলারে সত্তর মিলিয়ন ডলার খরচ করাটাও তো তার জন্য কষ্টসাধ্য। এত টাকা আপনি কোথায় খরচ করবেন? জনশ্রুত এই যে এই ডলারগুলোকে বান্ডিল বন্দি করতে পাবলোকে দৈনিক এক হাজার আমেরিকান ডলারের রাবার ব্যান্ড কিনতে হতো। তার মালিকানায় ছিলো প্রায় আটশটা বিলাস বহুল বাড়ি। ছিলো দুষ্প্রাপ্য জন্তুতে ভরা নিজস্ব চিড়িয়াখানা। প্রাইভেট জেট। আরো না জানা বহু কিছু। কিন্তু আয় অনুযায়ী এ সকল ব্যয়ই যে অপ্রতুল।
মূলত মাদক পাচারকারী হলেও ফুটবলের প্রতি পাবলোর এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিলো। নিজে অপরাধ জগতের অবিসংবাদিত সম্রাট হলেও ফুটবলের প্রতি পাবলোর ভালোবাসা ছিলো অটুট। তাই, নিজ শহর মেডেয়িনে গড়ে তুলেছিলেন অসংখ্য ফুটবল মাঠ। ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ফ্লাড লাইটের। নিজে মাদক সম্রাট হলেও নিজ শহরে মেডেয়িনের কিশোরদের হাতে মাদকের বদলে তুলে দিয়েছিলেন ফুটবল। প্রায়শই নিজেই মাঠে থেকে তরুণদের উৎসাহিত করতেন ‘এল পাতরন’। এটুকুতেই থেমে না থেকে কলম্বিয়ান ঘরোয়া ফুটবল লিগেও লগ্নি করেছিলেন প্রচুর অর্থ। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, মানি লন্ডারিং এর একটি উপযুক্ত পথ হিসাবে পাবলে ফুটবলকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু, তাতে আখেরে লাভ হয়েছিল কলম্বিয়ান ফুটবলেরই। নিজ শহরের ক্লাব অ্যাথলেটিকো ন্যাশিওনালের মালিকানা কিনে নেন পাবলো। বরাবরই উচ্চাকাঙ্খী পাবলো নিজ ক্লাবকে শুধুই কলোম্বিয়ার না; পুরো লাটিনেরই পরাশক্তি হিসাবে দেখার অভিপ্রায় প্রকাশ করলেন। এটি বাস্তবে পরিণত করার কাজটিও তিনি নিজেই করেছিলেন। তৃণমূলে পর্যাপ্ত মাঠ; আর পেশাদার পর্যায়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিকের প্রাচুর্যতায় কলোম্বিয়ার খেলোয়াড়রা দেশে খেলাকেই যৌক্তিক ঠাওরালেন। সাথে বাইরের দেশ থেকে আসতে থাকল বড় বড় সব ফুটবলার। আর তার জের ধরেই আচমকাই লাতিনে ফুটবল পরাশক্তি রুপে আবির্ভুত হয় কলম্বিয়া। শুধু মেডেয়িন কার্টেলই না, শোনা যায় পাবলোর দেখানো পথ উৎসাহিত করেছিল অন্যান্য মাদক সম্রাটদেরও। যার ফলে তৎকালীন কলম্বিয়ান লিগের নয়টি দলের ছয়টির মালিকানায়ই ছিলো কোনো না কোনো ড্রাগ কার্টেল। পাবলোরও স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। ন্যাশিওনাল জিতে নিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের শ্রেষ্ঠ ক্লাবের খেতাব।
এ সময়টায় কলম্বিয়া প্রস্তুত হচ্ছে পরবর্তী বিশ্বকাপের জন্য। ঘরোয়া লিগের উন্নয়নের প্রভাব সরাসরি পরেছিল জাতীয় দলে। যার ফলে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে অদম্য এক কলম্বিয়াকে আবিষ্কার করে ফুটবল বিশ্ব। তখন কলম্বিয়া এতটাই অসাধারণ খেলছিল যে খোদ ফুটবল সম্রাট পেলে কলম্বিয়াকে ঘোষণা করেন পরের আসরের অন্যতম ফেভারিট হিসাবে। সব কিছুই চমৎকার চলছিলো। বিপত্তটা বাধে তৎকালীন কলম্বিয়ান গোলরক্ষক রেনে হিগুইতার এক কর্মে। লা কেতারদাল থেকে পাবলোর সাথে দেখা করার পর তিনি মুখোমুখি হয়ে ছিলেন সাংবাদিকদের। যা জন্ম দিয়েছিলো ব্যাপক বিতর্কের। এর মাঝে পাবলোর দুই ব্যবসায়ীক পার্টনার গ্যালেয়ন এবং মোনকাদাকে হত্যা করে পাবলো নিজেই বিষয়টা আরো জটিল করে তোলেন। অনেকটা অজান্তেই যেন নিজের এবং কলম্বিয়ার বিশ্বকাপ স্বপ্নের সমাধি রচনার প্রাথমিক কাজটি করলেন পাবলো। পাবলোর সাথে দেখা করার জের ধরে জেলে যান কলম্বিয়ান গোলবারের ভরসা রেনে হিগুইয়তা। যদিও তার বিপক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছিলো অপহরনের। শুধু তিনিই নন, পুরো কলম্বিয়া দলটাই নিয়মিত ভ্রমণ করতো লা কাতেরদালে। কিন্তু, হিগুইতার প্রকাশ্য বয়ান কতৃপক্ষকে বেশ বিপাকেই ফেলে দেয়। যার ফলশ্রুতে বিকল্প ভাবতে বাধ্য হয় কলম্বিয়ান সরকার। কিন্তু, পাবলো তো পাবলোই; সোজা পথে হাটা কখনোই তার স্বভাবসিদ্ধ ছিলো না। তাই জেল ভেঙ্গে পালালেন সঙ্গীদের সহ।
হিগুয়িতার সাথে পাবলোর সখ্যর কথা তো বললামই। পুরো কলম্বিয়া ফুটবল দলের সাথে পাবলোর সখ্যতার বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। কলম্বিয়া থেকে আমোরিকার বিমান পথে যাত্রা ছিলো বেশ সময় সাপেক্ষ। মাঝে একবার যাত্রা বিরতি করতে হতো প্লেনে তেল ভরার জন্য। আর এ কাজটি করার জন্য পাবলো একটি দ্বীপই কিনে নিয়েছিলেন। শুধু দ্বীপ কিনেই থেমে থাকেননি। সেটিকে পরিণত করেছিলেন স্বর্গে। আর সে স্বর্গে পাবলো নিয়মিতই আমন্ত্রন জানাতেন কলম্বিয়ান জাতীয় দলের ফুটবলারদের। বিলাশ বহুল সে কটেজে সকলের যে চমৎকার সময় কাটতো তা তো বলাই বাহুল্য। ন্যাশিওনাল ফুটবল দলের অধিকর্তা পাবলোর ব্যাপারে অস্বস্তি ছিলো শুধু একজনেরই। আন্দ্রেস দ্য জেন্টালম্যান এস্কোবার। পাবলোর অনৈতিক কর্মকাণ্ডে হতাশ এস্কোবার নিতান্তই বাধ্য হয়ে যোগ দিতেন বিলাস বহুল পার্টিগুলোতে। আর নিয়মিত খুঁজে ফিরতেন এ থেকে পরিত্রানের উপায়। যদিও আন্দ্রেস তখনো একটি বিষয় বুঝে উঠতে পারেননি; যার থেকে পরিত্রান পাওয়া নিয়ে নিয়ত ভাবতেন তিনি সেই পাবলোর মৃত্যু তার মরণেরও কারণ হয়ে দাড়াবে। এটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য লেখায় করবো। আপাতত পাবলোতেই থাকতে চাই।
পাবলোর জেল থেকে পালানোর পর বদলে যায় দৃশ্যপট। পাবলোকে ধরতে মরিয়া কলম্বিয়ান সরকার এবং আমেরিকান এজেন্সি ডিইএ শেষ পর্যন্ত হাত বাড়ায় আরেক চরমপন্থি সন্ত্রাসী সংগঠন ‘লস পেপেস’ এর সাথে; সঙ্গে সিআইএ তো ছিলই। পাবলোর অপরাধ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে ফেলার পেছনে মূল ভূমিকা ছিলো গ্যালিয়োন ব্রাদার্সের সংগঠন লস পেপেসের। যাই হোক, পাবলোর সাথে সখ্যতার কারণে হিগুইতার জেল বরণ কলম্বিয়ার জন্য ছিলো বড় আঘাত। কেননা, কলম্বিয়া তো দূর পুরো বিশ্বেই তখন হিগুইতার বিকল্প পাওয়া ছিলো দুষ্কর। বিপদের ষোলকলা পূর্ণ হলো পাবলোর মৃত্যুর পর। অবিসংবাদিত অপরাধ সম্রাটের বিদায়ের পর মাথাচাড়া দিয়ে উছলো ছোট খাটো অসংখ্য গ্রুপ। আর এটিই অনুঘটক হিসেবে কাজ করলো বিশ্বকাপ থেকে বাজির ঘোড়া কলম্বিয়ার অবিশ্বাস্য বিদায়ের পেছনে।
পাবলোর মৃত্যুর পর এক সন্ত্রাসী সংগঠন অপহরণ করলো কলম্বিয়ান জাতীয় দলের এক ফুটবলারের শিশু সন্তানকে। বহু চেষ্টা তদ্বিরের পর তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও খেলোয়ারটির মানসিক অবস্থাটা সহজেই অনুমান করা খুব সহজ। এমন অবস্থায় ফুটবলে মনোনিবেষ সম্ভব বলে মনে হয় আপনার ? অপরাধ জগতের প্রায় সব শাখাতেই অবাধ বিচরণ করলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পাবলো একটা সময় সরে এসেছিলেন অপহরণ নামক অপরাধ থেকে। তাই, পাবলোর অনুপস্থিতে অপহরণের এ ঘটনা যে খেলোয়ারদের মনে তীব্র আতঙ্কের সৄষ্টি করেছিলো তা বলাই বাহুল্য। আগেই যেমনটা উল্লেখ করেছিলাম; পাবলোর সাথে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সখ্য ছিলো বেশ। তাই, খেলোয়াড়দের গায়ে আঁচড় কাটার কথা পাবলো জীবিত থাকাবস্থায় কেউ কল্পনাও করেনি। বিশ্বকাপ খেলার আনন্দের বদলে সবার চোখে মুখে ছিলো চিন্তার ছাপ। প্রথম খেলায় অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর কলম্বিয়া যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা করছে তখনই কলম্বিয়ান কোচ একটি ফোন কল পেলেন। যাতে নির্দেশ ছিলো একজন বিশেষ খেলোয়াড়কে খেলানোর। বাচা মরার লড়াইয়ে যখন মূল দল নামানোই মূখ্য সেখানে কোচ বাধ্য হলেন দ্বিতীয় পছন্দের খেলোয়ারড়কে খেলাতে। তিনি বলেছিলেন “আপনি সবার জীবনের ঝুকি নিতে পারেন না”। যা হবার তাই হলো, পরের ম্যাচেই আন্দ্রেস এস্কোবারের আত্মঘাতী গোলে বিদায় রচিত হলো কলম্বিয়ার। অথচ, ভালদেরামা, রিংকন, এস্প্রিয়া, এস্কোবারদের নিয়ে গড়া কলম্বিয়া দলটি ছিলো অসাধারণ। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে আর্জেন্টিনার মত দলকে যারা ৫-০ তে উড়িয়ে দিতে পারে তারা কতটা অসাধারণ ছিলো তা সহজেই অনুমান করা যায়।
পাবলোর মৃত্যু সবার জন্য স্বস্তির হলেও কলম্বিয়ান ফুটবলে তা কত বড় আঘাত হয়ে এসেছিলো তা বিশ্বকাপের সময় আবছাভাবে অনুমান করা গেলেও নগ্ন রুপটা দেখা যায় পাবলোর শহর মেডেয়িনেই। যেখানে দ্বিতীয় ম্যাচে আত্মঘাতী গোলের অপরাধে অপরাধী আন্দ্রেস আততায়ীর গুলিতে জীবন দিয়ে ছিলেন! না কট্টর দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ কেউ আন্দ্রেস এস্কোবারকে হত্যা করেননি। পাবলো হত্যার পিছনের অন্যতম কারিগর গ্যালিওন ভাইদের আক্রোশের স্বীকার হয়ে জীবন দিয়েছিলেন তরুণ বয়সে আন্দ্রেস। সেটিও পাবলোর সাথে অস্বস্তিকর সখ্যতার জন্য নয়। বরং বাছাই পর্বে কলম্বিয়ার নৈপুণ্য দেখে বিশাল অংকের বাজি ধরেছিল গ্যালিওন ব্রাদার্স। আন্দ্রেসের আত্মঘাতী গোলে কলম্বিয়ার বিশ্বকাপ যাত্রা গ্রুপ পর্বেই শেষ হয়ে বিশাল আর্থিক ক্ষতির মুখে পরে তারা। যার জেরে প্রাণ যায় আন্দ্রেসের। এখনো, অনেক কলম্বিয়ানই ইয়াকিন করেন যে, পাবলো বেঁচে থাকলে গ্যালিওনরা এমন কিছু করার সাহসও পেত না। পাবলো নিঃসন্দেহে এক ঘৃণিত নাম। কিন্তু দেশের জন্য যে খেলোয়াড়রা খেলত তাদের গায়ে পাবলো থাকাবস্থায় হাত দেয়ার কল্পনাও ছিল অংহসম।
পাবলো জীবিত থাকলে কলম্বিয়া কি বিশ্ব চ্যম্পিয়ন হতো? হয়তো হ্যা, নতুবা না। তবে, যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কলম্বিয়া ‘৯৪ এর বিশ্বকাপ খেলেছে তা যে খেলতে হতো না সেটি নিশ্চিত। পাইবে ভালদেরামা, এস্প্রিয়া, রিংকন, এস্কোবার, হিগুইতারা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও মত মাতানো ফুটবল যে উপহার দিতো এটি নিশ্চিত। বিশের উপরে টানা ম্যাচে অপরাজিত দল, যারা দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ৫-০ তে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখতো তাদের কাছে বড় কিছুর প্রত্যাশাটা মোটেও অমূলক ছিলো না।
জন্মদিনের ঠিক একদিন পরেই মাত্র চুয়াল্লিশ বছরে মারা যাওয়া পাবলো ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকবেন একজন মাদক সম্রাট হিসেবে। কিন্তু, কলম্বিয়ান ফুটবল বোদ্ধাদের কাছে এক আফসোসের নাম হিসেবে। যে বেঁচে থাকলে কলম্বিয়ান ফুটবল ইতিহাসটা হয়তো ভিন্নভাবেই লিখা হতো। একদম প্রথম প্যারায় পাবলোর পায়ের স্পোর্টস শ্যুটির কথা উল্লেখ করেছিলাম। সেটির কারণও আছে। ফুটবলেকে অস্বাভাবিক ভালোবাসা পাবলোর জীবনের প্রথম শ্যুটিও ছিল স্পোর্টস শ্যু। নিজেও খেলতে ভালোবাসতেন প্রচুর। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলুন বা নিয়তির লিখনে পাবলো ফুটবলার না হয়ে হয়েছিলেন ইতিহাসের সব চেয়ে ধনী এবং কুখ্যাত মাদক সম্রাট। অথচ, এই পাবলোই নিজ হাতে গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কলম্বিয়ান ফুটবলের ভিত্তি। যার ধারাবাহিকতায় এখন আমরা দেখছি হামেস রদ্রিগেজ, ডেভিড ওসপিনাদের মত তারকাদের। পাবলোর মৃত্যুর পর অনেক চড়াই উৎরাই অবশ্য পার হতে হয়েছে কলম্বিয়ান ফুটবলকে। যার পিছনের মুল কারণ অন্ধকার জগতের অধিকর্তারা। যারা ফুটবলকে দেখত শুধুই মানি লন্ডারিং এর একটি মাধ্যম হিসাবে। হ্যাঁ, পাবলোও এ কাজটি করেছিলেন। তবে, সেটিই মূখ্য ছিল না। যেটির চিত্র খুব স্পষ্ট। পাবলোর ফুটবল প্রেমের নজির তো মৃত্যুলগ্নেও তিনি রেখে গিয়েছিলেন।
জন্মদিনের ঠিক একদিন পর অর্থাৎ আজকের দিনে আমেরিকা-কলম্বিয়ার যৌথ বাহিনীর অভিযানে মারা যান পাবলো। সন্দেহ নেই খবরটি আনন্দ দিয়েছিল প্রায় চার হাজারের উপর স্বজনহারা পরিবারকে। কিন্তু, অবচেতনে কলম্বিয়ার ফুটবল হয়ত আফসোস করেছে। শুধু একটি বিশ্বকাপের জন্যই নয়; পাবলো থাকলে যে কলম্বিয়ার ফুটবল আরো উচুতে উঠতো সেটি তো হলফ করেই বলে দেয়া যায়। যদিও, এমন একজনের হাত ধরে ফুটবলের হাটাটা নৈতিকভাবে কাম্য না। কিন্তু চরিত্রের বর্ণিলতার জন্য পাবলোর বিষয়টায় একটু অন্য রকম ধারনা কাজ করে অনেকের মনেই। যার ফলে এখনো মেডেয়িন এর চার্চে নিয়মিত প্রার্থণা করা হয় পাবলোর জন্য!