রাজরোষে কথাশিল্পী

রাজরোষে কথাশিল্পী

শিল্পীর নিকট তার সৃষ্ট শিল্প সন্তানসম। অন‍্যান‍্য ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার মতোই লেখক এবং তার রচিত গ্রন্থ সম্বন্ধে একই কথা প্রযোজ্য। একজন লেখক বেশ কিছু বইয়ের লেখক হলেও দু’-একটি স্বরচিত বই তার বেশি প্রিয় হতে পারে। নেপথ‍্য কারণ হতে পারে, সংশ্লিষ্ট গ্রন্থটি লেখকের প্রিয় কারও স্মৃতিতে রচিত কিংবা দীর্ঘ কয়েক বছরের পরিশ্রমে তিনি রচনা করেছেন সেই গ্রন্থ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বেশ কিছু উপন্যাস ও গল্প সংকলন পাঠক মনে রাখবে চিরকাল। কিন্তু, ‘পথের দাবী’ গ্রন্থটি পাঠক দরবারের পাশাপাশি স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসে। ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল ‘পথের দাবী’। গ্রন্থটি দ্বারা নাকি ইংরেজ ভাবাবেগ আহত হয়েছিল।

গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ফলে লেখক গভীর মর্মাহত হন। জীবনযাপন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে লেখকের। গ্রন্থটির মুক্তির আশায় পদস্থ অনেক ব‍্যক্তির নিকট সুপারিশ করেন তিনি। সেই সময় অলবেঙ্গল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত প্রথম অধিবেশনে কথাশিল্পী বলেছিলেন, “আচ্ছা, তোমাদের এটা তো সারা বাংলার লাইব্রেরীর ব‍্যাপার। তোমরা একটা কাজ কর না, আর তোমাদেরই তো এটা কাজ। এই যে সরকার আমার ‘পথের দাবী’কে আটকে রেখেছে, এটা ছাড়াবার একটা প্রস্তাব সভা মঞ্জুর করতে পার না? প্রকাশ‍্য সভা থেকে এর একটা প্রতিবাদ হলে অনেক কাজ হবে- সরকারের টনক নড়বে। আমার আর পাঁচখানা বই যদি সরকার বাজেয়াপ্ত করত তাহলে আমার এত দুঃখ হত না।”

শরৎচন্দ্র মনে করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি তার পক্ষ নিয়ে ইংরেজ সরকারের নিকট সুপারিশ করেন, তবে মুক্তি পেতে পারে ‘পথের দাবী’। এই মর্মে তিনি অনুরোধপত্র লেখেন কবিগুরুকে। কিন্তু, প্রতুত্তরে কবিগুরু যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে শরৎচন্দ্র ভীষণ বেদনাহত হয়েছিলেন। ‘শরৎচন্দ্রের টুকরো কথা’ গ্রন্থ থেকে কিছু উদ্ধৃতি, “সে কী উত্তেজনা! কী বিক্ষোভ! রবীন্দ্রনাথ নাকি ‘পথের দাবী’ পড়ে ইংরেজদের সহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছেন। এই বইয়েতে নাকি ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষের ভাব আছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। আমার ‘পথের দাবী’ পড়ে আমাদের দেশের কবির কাছে যদি এই দিকটাই বড় হয়ে থাকে তাহলে স্বাধীনতার জন‍্যে আর আন্দোলন কেন? সবাই মিলে তো ইংরাজদের কাঁধে করে নিয়ে বেড়ানো উচিত। হায় কবি, তুমি যদি জানতে তুমি আমাদের কত বড় আশা- কত বড় গর্ব, তাহলে নিশ্চয় এমন কথা বলতে পারতে না। কবির কাছে আমার ‘পথের দাবী’র যে এত বড় লাঞ্ছনা হবে এ আমার স্বপ্নের অতীত ছিল। কী মন নিয়েই যে আমি এই বইখানা লিখেছিলুম, তা আমি কারুকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না।”

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, কথাশিল্পী তার প্রিয় উপন্যাসটির মুক্তি আমৃত্যু দেখে যেতে পারেননি। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি আলবার্ট হল-এ শরৎচন্দ্রের প্রথম মৃত‍্যুবার্ষিকী পালন করা হয় এবং ‘পথের দাবী’ বইটির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানানো হয়। অতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রস্তাব করেন এবং অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ও বঙ্কিম সেন প্রস্তাব সমর্থন করেন। তদানীন্তন সময়ে ‘শের-এ বাংলা’ নামে পরিচিত ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বকালে ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে ‘পথের দাবী’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।