সাগরিকার শান্ত সৌম্য পরিবেশ থেকে মানব সমুদ্দুর মিরপুরে শুরু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ উইন্ডিজ সিরিজের সিরিজ নির্ধারনী টেস্ট ম্যাচ। প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে এটুকু নিশ্চিত যে, ‘নিজেদের মাঠে’র পূর্ণ সুবিধা নেবার পণ করেই মাঠে নামবে টাইগাররা। পিচ নিয়ে পুরোনো কাসুন্দি তাই আরো একবার ঘাটার সুযোগ থাকলেও সজ্ঞানে তা পরিহার করছি।
দল নিয়ে সর্বশেষ যে খবরটি চাওড় হয়েছে তা হলো ইমরুলের জায়গায় অভিষিক্ত হতে যচ্ছেন সাদমান। ইমরুলের বাদ পড়াটা যতটা স্বাভাবিক ততটাই অস্বাভাবিক ভয়াল সুন্দর দুটি ইনিংস উপহার দেয়ার পরেও সৌম্যের টিকে থাকা। যাই হোক, ইমরুলের বাদ পড়াটাকে বিতর্কিত বলার সুযোগ নেই, বরং ক্রমাগত ব্যর্থতার পরেও তার সুযোগ পেয়ে চলাটাই ছিল বিস্ময়কর। সৌম্যের টিকে থাকায় বোধ করি তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে উইন্ডিজের বোলাররা। হেতু না হয় ব্যাখ্যা নাই করি।
যাই হোক আমার এই লেখাটির দুই চরিত্র হচ্ছে মুমিনুল এবং তাইজুল। যাদের কেতাবী ভাষায় অনেকে আনসাং হিরো বলে থাকে, আমার কাছে যদিও মনে হয় অভাগা দুইজন। নিয়তই নৈপুণ্য দেখিয়ে যারা নানাবিধ কারণে আড়ালে থেকে যান। কখনো এর মূলে থাকে দলের বড় কোনো তারকার আরো উজ্জ্বল নৈপুণ্য কখনো বা দলের ব্যর্থতা। তবু, শেষ টেস্টে তাইজুল এবং মমিনুল দু’জনই দেখিয়েছেন তারা কতটা মাহির এবং মাহজাবীন।
শুরুর দিক বাদ দি, মাঝপথেও বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের গড় চল্লিশ কল্পনা করাও ছিল কষ্টসাধ্য। সেখানে মমিনুল সেটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন পঞ্চাশেরও ওপরে। হাথুরুর হঠকারী মনোভাবে হারিয়ে যেতে বসা মমিনুল চলতি বছরে যেন নতুন নওবাতের জানান দিচ্ছেন। চলতি মৌসুমে ইতোমধ্যেই চারটি শতক হয়ে গিয়েছে সাগর পাড়ের এই সন্তানের। সাগর পাড়ে জনম যার উন্মাতাল ঢেউয়ের সাথে তার সখ্য যে অন্যকারো যে বেশি হবে তা তো সহজেই অনুমেয়। যার ফলে সাগরিকায় নামলেই যেন শিরায় অনুভব করেন উন্মাদনা। চলতি বছরের চারটি শতকের তিনটিই এসেছে সাগর পাড়ের এই মাঠে। ভঙ্গিমাতেও রয়েছে উন্মাতাল ঢেউ এর খেল। নিখাঁদ টেস্ট বিশেষজ্ঞের তকমা গায়ে সেটে গেলেও মমিনুল মানেই রোমাঞ্চকর সব শট। এটা আরো বেশি চোখে পড়ে এই আদমি যখন নব্বইয়ের ঘরে প্রবেশ করেন তখন। এই সংখ্যায় যখন নামজাদারাও নিশির আধারে আলো হাতড়ে ফেরেন সেইখানে ছোটখাটো এই মানুষটি যেন সুনামির তাণ্ডব চালান। সর্বশেষ টেস্টেই শতক ছুঁয়েছেন বল সীমানার বাইরে পাঠিয়ে।
মমিনুল প্রসঙ্গের প্রারম্ভেই বলেছিলাম যে আমার কাছে তাকে অভাগা মনে হয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইজ্জত বাচানোর এসিড টেস্ট যে বাংলাদেশ সাফল্যের সাথে উতরে গিয়েছিল তার পিছনে অন্যতম অবদান মমিনুলের শতকের। কিন্তু একই ইনিংসে নতুন করে ইতিহাস লিখাতে উদগ্রীব মুশফিকের আলোর ছটায় ম্লান হয়ে যান তিনি। এটিই পয়লা নয়। বহুবারই এমন ঘটেছে, মমিনুলে মুগ্ধতার বয়ানের আগেই কেউ না কেউ আরো ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে সে রাশটি টেনে নিয়েছেন নিজের দিকে। অন্তর্মুখী এ আদমি তা নিয়ে কখনোই খেদ প্রকাশ করেন নি। আখেরে দলের জন্যই তো খেলা। মমিনুলে যে বিষয়টি কিছুটা বিস্ময়কর ঠেকে সেটি হচ্ছে যৌথভাবে দেশের হয়ে টেস্টে সার্বাধিক সেঞ্চুরির মালিক হবার পরেও তার নামের পাশে একটিও ডাবল না দেখা। এটির জিকরের জওয়াবও মমিনুল দিয়েছেন নিজস্ব কায়দায়। তাকে যারা চেনেন, তার সে জওয়াবে দ্বিমত প্রকাশ করবেন এমন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। তবে শুধু সেঞ্চুরির সংখ্যার জন্যও না, যতক্ষণ তিনি ক্রিজে থাকেন খুব কম সময়ই মনে হয় তিনি আউট হতে পারেন। তাই, কিছুটা হতাশাও কাজ করে। তবে, সুখের বিষয় এই যে; মমিনুল মনস্তাত্ত্বিক চাপের মুখে হারিয়ে না গিয়ে নয়া নাজাকাত নিয়ে ফিরেছেন। মুখে কমই বলুন, তার ব্যাট যত কথা বলবে বাংলাদেশের জন্য ততই লাভ।
মমিনুল তো তবু মাঝে মধ্যে তারকাদের চোখ ধাঁধাঁনো রোশনী থেকে বের হয়ে নিজেকে চেনাতে পারেন। অপরজন, অর্থাৎ তাইজুল যেন সব সময়ই ঢাকা পড়ে থাকেন সাকিব নামক নক্ষত্রের আড়ালে। এটা অবশ্য এক রকম স্বাভাবিকই; সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা অল-রাউন্ডার; যিনি একের পর এক ছুঁয়ে যাচ্ছেন বা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের একের পর রেকর্ড; তার সামনে যে কাউকেই ম্লান দেখাবে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সাকিবের অনুপস্থিতি তাইজুলকে সুযোগ করে দিয়েছিল সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নেয়ার। তাইজুলে তন্ময় কোনো সমর্থকও বোধয় এতটা ভাবেননি, যতটা তিনি করেছেন। সাকিবের অভাবই শুধু পূরণ করেননি, নিজের করে নিয়েছেন এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড। সামনে সুযোগ রয়েছে পুরো বছরেরই সার্বাধিক উইকেট শিকারি হবার।
তাইজুল সব দিক দিয়েই নিজেকে অভাগা ভাবতে পারেন। একদিনের ম্যাচে অভিষেকেই হ্যাট্রিকের রেকর্ড করার পরেও দলে ব্রাত্য বেচারা। এতে অবশ্য কাউকে দায় দেয়ারও সুযোগ নেই। তিন পেসারের সাথে এক স্পিনারের কম্বিনেশনে ব্যাটিং দক্ষতার কারণে মিরাজ অটো চয়েজ। বোলিংয়েও তার কার্যকারিতা প্রশ্নাতীত। তবে, এক দিক দিয়ে এটা নিয়ে আক্ষেপ না করলেও চলে। এক ম্যাচেই তো ইতিহাসের অমরত্ব নিশ্চিত করেছেন। বরং, সাদা পোষাকেই তিনি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠুন। যত কথাই হোক, দিন শেষে কিন্তু টেস্টের নৈপুণ্য আলাদা কদরই পায়। বিগত কয়েকটি লেখাতে পিচ নিয়ে আমি বিস্তর সমালোচনা করেছি। হয়ত, প্রয়োজনবোধে সামনেও করবো। কিন্তু, পিচ যত সহায়কই হোক; ঠিক জায়গায় বল ফেলতে না পারলে ব্যাটসম্যানের বিদায় ঘন্টা যে বাজানো যায় না, সেটা না বোঝার মত বেবোধ এখনো হইনি। তাই, তাইজুলের অর্জনটা স্পিনিং পিচে হলেও প্রাপ্য কদর দিতে কসুর নেই।
মিরপুর টেস্টও ফাটা পিচে হবে বলেই অনুমান করছি। তাতে তাইজুলের সামনে সুযোগ আছে নিজেকে আরো উচুতে নিয়ে যাওয়ার। এমন পিচে মুমিনুলও আশাই দেখাচ্ছেন। গত ম্যাচে নৃত্যকলা প্রদর্শনীর মাঝেও যে তিনি সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন। আর এ অভাগাদের যুগলবন্দি যদি আরো একবার সুর তুলতে পারে তাহলে ক্যারিবিয়ানদের হারিয়েই জনম দেয়া যাবে নয়া ইতিহাসের।