মূল শহরে যাওয়ার ঠিক মধ্যিখানে মধুপুর স্টেশন। তেমন বড় কিছু না। কিন্তু, মধুপুর বাজারটা বিখ্যাত হবার কারণে শহর ফেরত অনেকেই নেমে যায় বাজার করতে। দশ-বিশ মিনিট পর যেহেতু আরেকটি ট্রেন আসে তাই এ সুযোগটা নিতে কেউ কার্পণ্য করে না। ছোট্ট স্টেশন মধুপুরের কর্ম ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় সূর্য উঠার সাথে সাথেই। চায়ের দোকানগুলো খুলে চাওয়ালারা গরম কেতলি বসিয়ে দিয়েছে। ঝাঁপি নিয়ে হাজির আনাজ বিক্রেতারা। পাশেই টিনের বেড়া দেয়া হোটেল থেকে ভেসে আসছে পরোটা আর মাংসের ঘ্রাণ। আর কত বিচিত্র মানুষের যে সমাবেশ। কোট টাই পরে কেউ ছুটছে কোর্টে, ব্যবসাটা এখনো ঠিক জমেনি, আগে গিয়ে যদি দুটি মক্কেল বাগানো যায়। কারো হাতে আবার পেট মোটা ব্রিফকেস, তাতে যে কি আছে খোদা মালুম। সকালে মধুপুরের এই দৃশ্যটা আমার বেশ লাগে। নিয়মিত যাতায়াত করার ফলে স্টেশনের পরিচিত সব মুখই আমার চেনা। এদেরই একজন বশির মিয়া। কত হবে ? ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর বড়জোড়। মুখ ভর্তি সাদা কালো দাড়ি। কাঁধ সমান চুল। সুঠাম দেহ। আর অদ্ভূত মায়াময় এক চেহারা। বশির মিয়ার মাঝে এক অদ্ভুত রকমের সারল্য আছে। সেটি পুরো প্রকাশ পায় যখন সে হাসে তখন। চলতি ট্রেনে গেলো দশ বছর ধরে আইসক্রিম বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে বশির। আমি আইসক্রিম না খেলেও আমার সাথে বেশ একটা সখ্য গড়ে উঠেছে। দেখা মাত্রই এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে কথা বলতেই হবে আমার সাথে।
রোজকার মত সেদিনও ট্রেনে চেপে বসেছি। বিচিত্র রকমের সব মানুষ চারিদিকে। বিভিন্ন স্রোতের আলাপ চলছে। একটু খোঁজ খবর রাখা একদল দেশ নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় অস্থির প্রায়। তার থেকে পরিত্রানের উপায়ের জন্য একের পর এক বুদ্ধি বের করে যাচ্ছে সদলবলে। সামনেই কলেজ পড়ুয়া দু’জন ছাত্র মোবাইলে ঝুঁকে কি যেনো দেখছে। তা যে বৈধ কিছু না তা চেহারাতেই স্পষ্ট। একলা বসে কেবল ভাবনার জগতে ডুব দেবো এমন সময়ই বশির মিয়ার গলা
– ভাইজান ছালাম, শরীরটা ভালো আপনের?
মুখে সেই চেনা অপার্থিব হাসিটা। দাড়িগোফের আড়ালে মূল চেহারাটা ঢাকা পরে গেলেও মুখের হাসিটা এড়ায় না। মানুষের হাসি যে এতো সুন্দর হতে পারে তা বশিরকে না দেখলে বুঝতাম না। কোনো মেকি ভাব নেই, আশ্চর্য এক সরলতা ফুটে উঠে বশিরের হাসিটার মাঝে।
– ওয়ালিকুম আস্সালাম। তোর কি অবস্থারে বশির?
কথাটা জিজ্ঞাস করতেই হালকা একটা বিষাদের রেখা ফুটে উঠে ওর চেহারায়।
– খুব একটা ভালো নাই ভাই
– কেন রে?
– আইসক্রিমের বাক্সটা পুরান হয়া গেছে। ঠিক মতো বরফ জমে না। বেচাকিনি কম। একটা নয়া বক্স যে কিনমু সেইটাই পারতেছি না
– আমি কিছু টাকা দেই, কিনে নে। পরে নাহয় শোধ দিছ।
– না ভাইজান। এমনেই আপনের কাছ থাইকা কত কিছু নেই, দেখি অন্য কোনো দিক দিয়া কোনো ব্যাবস্থা করা যায় কি না?
একজন ক্রেতা বশিরকে ডাকছে। তাই আর এর বেশি কথা হলো না।
মাঝে কিছুদিন কাজের জন্য শহরের বাইরে যেতে হয়েছিলো। তাই বশিরের সাথে আর দেখা হয় নাই। বাড়ি ফিরে প্রথম ট্রেনে উঠবো তখনই বশিরের সাথে দেখা। মুখের হাসিটা যেনো থামছেই না
– কি রে, এত খুশি কেন ?
– বড়ভাই, দেখেন নয়া বাক্স কিনছি
– টাকা কই পেলি রে?
– কয়দিন আগে টেরেনে এক লোকে ভুলে মানিব্যাগ ফালায় গেছিলো। আমি সেইটা পাইয়া হেরে খুঁইজ্যা দিয়া আইছি। হেয় এত খুশি হইছে যে নগদ পাঁচ হাজার টেকা ধরায় দিছে। আমি লইতে চাই নাই, জোর কইরা দিছে। কয় মানিব্যাগে নাকি খুব জরুরি কাগজ আছিলো ওইটা না পাইলে অনেক ক্ষতি হইতো হের
– তুই আসলেই ভালো মানুষরে বশির। আর ভালো মানুষরে আল্লাহই সাহায্য করে
– ভালা কি না সেইটা ত জানি না ভাই, তয় কোনো দিন মাইনষের ক্ষতি করছি না। বড়ভাই, বাক্সটা নিয়া যখন ঘরে গেছি আমার পোলাডারে যদি দেখতেন। সারা রাইত বাক্স জড়ায় ধইরা ঘুমাইছে। কয়িআব্বা, এখন যদি বেচা বাড়ে আমারে একটা খেলনা বন্দুক কিন্যা দিবা। আর মাইয়্যাটা ত শরমিলা। আমি কই তুই কি নিবি রে মা? কয় আব্বা আমারে একটা আলতা আইন্যা দিবা? আমার আলতা পরনের বহুত শখ
– তোর বেচা কেমন এখন?
– আলহামদুলিল্লাহ ভাই। আপনেগো দোয়ায় দুই দিন ধইরা খুব ভালো বেচতাছি। ইনশাআল্লাহ আজকা পোলাপাইন গুলার লাইগা শওদা লইয়্যা যামু
– তোর বৌরে কিছু দিবি না?
রোদে পোড়া চেহারাটায় লজ্জার এক আশ্চর্য আভা দেখা দেয়।
– একটা লাল শাড়ি কিন্যা দিমু ভাবছি ভাই
কথা আর এগোয় না। কাস্টমারের ডাক পরেছে। খুশি মনে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছে বশির মিয়া।
দিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছি। ট্রেনে থেকে নেমেই দেখি বিশাল একটা জটলা। ভীড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি পিলারের সাথে হেলান দিয়ে বশির মিয়া বসা। মারের চোটে মুখটা ফুলে গিয়েছে। ঠোঁট বেয়ে তখনো রক্ত ঝরছে। পাশেই সাধের আইসক্রিম বক্সটা পড়ে রয়েছে ভেঙ্গে। একটু দূরেই আলতা আর একটা খেলনা গাড়ি। কোনো কিছুই যেনো বুঝে উঠতে পারছি না। বশিরের নাম ধরে ডাক দিতেই আমাকে জড়ায় ধরে ডুকরে কেদে উঠলো বশির। কান্নার দমকে কথা বোঝা যায় না।
প্রথমেই বশিরকে ফার্মেসিতে নিয়ে অর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাবস্থা করলাম। তার পর বশির বলতে শুরু করলো ঘটনা
– বড়ভাই টেরেনের কামরায় ছয় সাতটা জোয়ান ছেড়া উঠছে। আর এক কোনায় এক যুবতী মাইয়্যা। পোলাডি মাইয়্যাটারে নিয়া যা তা কইতাছে। মাইয়্যা নামতেও পারতাছে না, কিছু কইতেও পারতাছে না। এত্তগুলা মানুষ বসা কেউ একটা কিছু কয় নাই বড়ভাই। টেরেনটা থামতেই এক পোলায় মাইয়্যার হাত ধইরা টান দিছে। তখন আর আমি সইয্য করতে পারছি না। আমি সুজা গিয়া থাপ্পর বয়ায়া দিছি। এরপরেই আমারে মাইর বড়ভাই। শুধু মাইরাই থামে নাই, বাক্সটারে ভাইঙ্গা দুই টুকরা করছে। মায়াটার লাইগা আলতা কিনছিলাম সেইডিও ফালায় দিছে। আর সমানে কিল ঘুষি ত চলতেই আছে। আমি কই বইনা, আমারে মারুক, তুমি পলাও। এত্তডি মানুষ ভাই কেউ একটাবার ধরলো না অগোরে, থামাইলোও না। বেগতে মুবাইল বাইর কইরা ভিডু করে বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় বশিরের। ধরা গলায় কথা আটকে যায়।
– বড়ভাই, আমার ত কিছুই নাই। কি লইয়্যা বাড়ি যামু এখন? মাইয়্যাটা কত শখ কইরা বয়া আছে আলতা দেওনের লাইগা, অর মুখের দিকে কেমনে চামু কন? তয় একটা সুখ আছে ভাই
– কি?
– মাইয়্যাটার ইজ্জত ত বাচছে। আমার নিজেরও ত মাইয়্যা আছে, অর লগে কেউ এমন করলে সইজ্য করতে পারতাম? কন ভাই?
আর বশিরের দিকে তাকাতে পারি না। চোখটা ভিজে আসে। নিতান্তই অশিক্ষিত একটা মানুষ অচেনা এক বোনের জন্য নিজের সব খুইয়ে বসে আছে। আর আমরা? হাজার টাকার মোবাইলে সে দৃশ্য ধারণ করি ফেসবুকে কিছু লাইকের আশায়।
এভাবেই বশিরদের স্বপ্নগুলো মারা যায়। আর না মানুষ আমরা সে মৃত্যু পুঁজি করে মেতে উঠি লাইকের নেশায়…