ইউরোপিয়ান ফুটবলে মধ্যপ্রাচ্যের পদার্পণ হয় ২০০৮ সালে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি ও দুবাইয়ের তেল উৎপাদক কোম্পানি ‘আবুধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ’র হাত ধরে। তার ৩ বছর পর ২০১১ সালে আবুধাবি ইউনাইটেড গ্রুপের দেখানো পথ ধরেই ফরাসি ক্লাব পিএসজি’র মালিকানাস্বত্ব ক্রয় করে ইউরোপিয়ান ফুটবল জগতে প্রবেশ করে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতারের ‘কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট’ কোম্পানি। প্রাথমিক অবস্থায় তাদের ফুটবল জগতে বিচরণ নেহাতই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা কিংবা পৃষ্ঠপোষকতার ইচ্ছা বলে মনে হলেও কয়েক বছর পরই তাদের উদ্দেশ্য গোটা ফুটবল বিশ্বের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়।
মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ‘গ্লোবাল বিজনেস’। যার সহজ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলকে। আর ইউরোপিয়ান ফুটবল সকল ফুটবল ভক্তদের কাছে অন্য মহাদেশের ফুটবলের তুলনায় অধিক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় তাদের নজর পড়ে ইউরোপের ফুটবলে। যদিও এখন তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান এমকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ফুটবল কেক বাণিজ্য শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
সেই ধারাবাহিকতায় ‘আবুধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ’ সিটি ফুটবল গ্রুপ নামে ফুটবল বাণিজ্য শুরু করেন। তারা সিটি ফুটবল গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় পুরো বিশ্বে ফুটবলকে ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ফুটবল ভক্তদের। আর সেটাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে মেজর লিগ সকার (যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল লিগ)এ নিউইয়র্ক সিটি এফসি এবং ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক ওয়াকিস নামে দুটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। সে বছরই অষ্ট্রেলিয়ার ফুটবল লিগে মেলবোর্ন হার্ট’র স্বত্বাধিকার গ্রহণ করে তার নামকরণ করেন মেলবোর্ন সিটি এফসি। এভাবে সিটি ফুটবল গ্রুপ তাদের ছত্রছায়ায় ফুটবল বিশ্বে তাদের প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেন।
স্পন্সর বাণিজ্য, নাকি আধিপত্য বিস্তার?
প্রথমদিকে মধ্যপ্রাচ্যের গুটি কয়েক ধনকুব ক্লাবের মালিকানাস্বত্ব ক্রয় করে পথ চলা শুরু করলেও এখন মধ্যপ্রাচ্যের বিমান সংস্থার থেকে শুরু করে বেশ কিছু কোম্পানি সরাসরি ইউরোপিয়ান ফুটবলের সাথে স্পন্সর বাণিজ্যের সাথে জড়িত। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কোম্পানিগুলো হলো- কাতার এয়ারওয়েজ, ফ্লাই এমিরেটস, ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজ, কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি ও বেন স্পোর্টসসহ বেশ কিছু মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ইউরোপিয়ান ফুটবলের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। বিশেষ করে কাতার এয়ারওয়েজ স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনার স্পন্সর ছিলো লম্বা সময়। সে সময় সুযোগ বুঝে টোপ ফেলতে ভুল করেনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমান সংস্থা ফ্লাই এমিরেটসও। তারা বার্সেলোনার চির প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদকে স্পন্সর করে লা লিগায় নিজেদের ব্যবসা বিস্তার করে। একই সাথে ফ্লাই এমিরেটস ফরাসি ক্লাব পিএসজি’কে স্পন্সর করেন। অন্যদিকে সময়মত সুযোগ লুফে নিতে ভুল করেনি মধ্যপ্রাচ্যের আরেক বিমান সংস্থা ইত্তিহাদও। তারা স্পন্সর করেন ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিকে। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবদের টাকার ঝনঝনানির কাছে হার মেনে অনেক ইউরোপিয়ান কোম্পানিও ইউরোপের ফুটবল থেকে তাদের স্পন্সর বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়েছে কিংবা ছোট দলগুলোর সাথে স্বল্প পরিসরে চুক্তি করেছে। সে সময় ফরাসি ক্লাব পিএসজির স্বত্বাধিকারী নাসের আল খেলাফি শুধুমাত্র ফুটবল খেলা সম্প্রচারের জন্য স্পোর্টস চ্যানেল ‘বেন স্পোর্টস’ চালু করেন। তার উদ্দেশ্য ছিলো ইউরোপিয়ান ফুটবলের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার স্থান পাকাপোক্ত ও প্রভাব বিস্তার করা। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য একটি ব্যবসায়ী সংস্থা প্যান-আরাব ( বর্তমানে এটি আল-জাজিরা স্পোর্টস নামে পরিচিত) নামে স্পোর্টস চ্যানেল চালু করেন। তারা প্রাথমিকভাবে ‘গ্লোবাল বিজনেস’ করার লক্ষ্যে ইউরোপিয়ান ফুটবলে প্রবেশ করলেও এখন তারা ইউরোপিয়ান ফুটবলের হর্তাকর্তা হয়ে উঠেছেন । যাদের হাতে এখন ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা চলে গিয়েছে।
ফুটবলে মুদ্রাস্ফীতি রোধে উয়েফা’র নেয়া পদক্ষেপ কতটুকু কার্যকর?
প্রাথমিক অবস্থায় ইউরোপিয়ান ফুটবল ক্লাবগুলোর ট্রান্সফার বাজেট ধরা বাঁধা ছিলো না। ক্লাব যতটুকু ব্যয়বহন করতে পারবে এবং যতটুকু ব্যয় করতে ইচ্ছুক ততোটুকু ব্যয় করার স্বাধীনতা ক্লাবগুলোর ছিলো। তবে মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেরা ইউরোপিয়ান ক্লাবের মালিকানা গ্রহণ করার পর এবং স্পন্সরে মধ্যপ্রাচ্যের কোম্পানিগুলো যুক্ত হওয়ার পর ক্লাবগুলো ট্রান্সফারের সময় প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ ব্যয় করা শুরু করে। সে সময় ম্যানচেস্টার সিটি, পিএসজি, বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদসহ মধ্যপ্রাচ্যের স্পন্সরে থাকা ক্লাবগুলোর আধিপত্যের কাছে মধ্যম মানের ক্লাবগুলো ও মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ নেই এমন ক্লাবগুলো বেশ বিপাকে পড়ে যায়। তখন ইউরেপিয়ান ফুটবলের মুদ্রাস্ফীতি রোধের লক্ষ্যে উয়েফা নড়েচড়ে বসেন। সে সময় ক্লাবের আয়ের উপর ভিত্তি করে ট্রান্সফার মার্কেটে বিনিয়োগ নির্দিষ্ট পরিমানে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যার বেশি অর্থ কোনো ক্লাব ট্রান্সফার মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারবে না। তবে এতে করে ইউরোপিয়ান ফুটবলের মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। কারণ ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ক্লাব প্রচুর পরিমানে অর্থ তাদের দল সাজানোর কাজে ব্যয় করেছেন যা তাদের মূলধন অন্য ক্লাবগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা এটিকে ‘সফট ইকোনোমিক পাওয়ার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। উয়েফার নেয়া পদক্ষেপগুলো হয়তো ফুটবলের ভবিষ্যৎ মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করবে কিন্তু বর্তমানে ফুটবলে যে অর্থনৈতিক অসমতা তৈরি হয়েছে সেটা প্রতিকার করা সম্ভব নয়।
পরিশেষে বলা যায়, যে ইউরোপিয়ান ফুটবল পুরো বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের হৃদয়ে আবেগ ও অনুভূতি হয়ে লালিত পালিত হচ্ছিলো তা মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবদের ফুটবল বাণিজ্যের কাছে একটি বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। যার ফলে এখন ফুটবলের প্রতি দিন দিন মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে। যে দলগুলো অতিরিক্ত অর্থ ঢেলে দল সাজাতে ব্যর্থ হয়েছে তারা ইউরোপিয়ান লিগ গুলোতে তেমন ভালো কিছুই করতে পারছে না।
তারা শুধুমাত্রই ‘অংশগ্রহণকারী দল’ হিসেবে লিগগুলো খেলে যাচ্ছে। আর শিরোপাগুলো চক্রাকারে গুটি কয়েকটি দলের মধ্যে হাত বদল হচ্ছে।এক সময় প্রচলিত কথা ছিলো যে ফুটবলের জন্ম ল্যাতিন আমেরিকায়, আর বেড়ে উঠা ইউরোপ মহাদেশে। তার সাথে এখন যুক্ত করতে হবে ইউরোপে বেড়ে উঠা ফুটবল আজ মধ্য প্রাচ্যের ধনকুবদের হাতে মরতে বসেছে।