ফুটবলের অভিশাপ মধ্যপ্রাচ্য- পর্ব ১

ফুটবলের অভিশাপ মধ্যপ্রাচ্য- পর্ব ১

নব্বই মিনিট, সবুজ গালিচা বিছানো মাঠ, গ্যালারি ভর্তি হাজার হাজার সমর্থকের চিৎকার আর উন্মাদনা মিলিয়েই ‘ফুটবল’। ফুটবল ভক্তদের কাছে আবেগের আরেক নাম হচ্ছে ফুটবল। যে আবেগ মাঝে মাঝে প্রেমিকার ঠোঁটে চুমু দেয়ার চাইতেও বেশি রোমাঞ্চকর হয় কিংবা প্রেমিকার দেয়া আঘাতে হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়া কষ্টের চাইতেও বড্ড কষ্টকর হয়ে যায়। তবুও সব কিছুর পর তারা ফুটবলকে ভালোবেসে যায় নিঃস্বার্থ ভাবে। তাদের কাছে ফুটবল এক ধর্মের নাম, আর সবুজ ফুটবল মাঠ হচ্ছে উপাসনালয়। ফুটবল যখন পৃথিবীর প্রতিটি কোণে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছে। তখনই ফুটবলের দিকে চোখ পড়ে মুনাফা লোভী মধ্য প্রাচ্যের গুটি কয়েক ধনকুবের। প্রাথমিক অবস্থায় ফুটবলের সাথে এই ধনকুবদের সম্পৃত্ততার ইতিবাচক দিক দেখলেও বর্তমান বিশ্বে যারা সত্যিকার অর্থেই ফুটবলকে মনে প্রাণে ভালোবাসে তারা দেখতে পারছে  মধ্য প্রাচ্যের সেই ধনকুবদের প্রভাবে আজ ফুটবল শুধুমাত্রই বাজারজাত পণ্যে রূপ নিয়েছে। প্রতিটি ফুটবল ক্লাবগুলো অবশ্যই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই পরিচালিত তবে সেখানে যদি ফুটবল কম, টাকার হিসাব বেশি কষতে হয় তাহলে ফুটবল তার সৌন্দর্য্যের সাথে সাথে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ব্যবসায়ের বস্তুতে রূপ নিবে।

ইউরোপিয়ান ফুটবলে মধ্য প্রাচ্যের ধনকুবদের পদার্পণ  

প্রাথমিকভাবে আরব আমিরাত, কুয়েত, সৌদি আরবের ব্যবসায়ীরা নিজ দেশের ফুটবলে বিনিয়োগ করলেও তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ইউরোপিয়ান ফুটবলে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করা। কারণ ইউরোপিয়ান লিগ ফুটবল পুরো বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়। সেই চিন্তাধারায় প্রাথমিক অবস্থায় স্বল্প পরিমানে স্পন্সরশীপ থেকে শুরু করে ২০০৮ সালে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির স্বত্বাধিকার কিনে নেয় দুবাইয়ের তেল উৎপাদক কোম্পানি ‘আবুধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ’  যার মালিক হচ্ছেন শেখ মনসুর। শেখ মনসুর ম্যানচেস্টার সিটির মালিকানা গ্রহণ করার পরই দলে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে সকল নামী দামী প্লেয়ারদের দলে ভেড়ানো। এমন ও দেখা গিয়েছে যে অনেক প্লেয়ারকে দলে বেড়াতে প্রয়োজনের চাইতেও অধিক টাকা ঢালতে দ্বিধাবোধ করেননি ম্যানচেস্টার সিটি। ম্যানচেস্টার সিটি তাদের বর্তমান স্কোয়াড সাজাতে ব্যয় করেছে মোট ৭৭৭ মিলিয়ন পাউন্ড।

শুরুর দিকে ইউরোপিয়ান ফুটবলে ‘আবুধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ’ ও তার কর্ণধার শেখ মনসুর ছড়ি ঘুরালেও ২০১১ সালের গ্রীষ্মকালীন দল বদলের সময় ফরাসি ফুটবল ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মান (পি এস জি)’র মালিকানা স্বত্ব কিনে নেয় ‘কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট’ কোম্পানি। যার কর্ণধার নাসের আল-খেলাফি। দলের মালিকানা গ্রহণ করার পর খেলাফি নিজেই পিএসজি’র প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭০ সালে গড়ে উঠা ক্লাব পিএসজি হঠাৎ করেই শুভঙ্করের ভেলকিবাজির মত ফ্রান্সের সবচেয়ে ধনী ক্লাব এবং ইউরোপিয়ান ধনী ক্লাবের তালিকায় নাম লেখান।

২০১৭ সালে ট্রান্সফার মার্কেটে হৈ চৈ ফেলে দেয় নাসের আল খেলাফি। ২২২ মিলিয়ন ইউরোতে দলে ভেড়ান নেইমারকে। এটি এখন পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে বেশি টাকায় ট্রান্সফার রেকর্ড। বর্তমানে পি এস জি স্কোয়াড গড়তে খরচ করেছে ৭১৩ মিলিয়ন পাউন্ড। বর্তমানে ফুটবল ট্রাসফার মার্কেটে এককভাবে রাজত্ব করছে মধ্যপ্রাচ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা ক্লাবগুলো।

ফুটবল বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি

মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীরা ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান ফুটবল লিগের সাথে সম্পৃক্ত হলেও প্রাথমিক অবস্থায় তারা ইউরোপিয়ান ফুটবলে তেমন বড় প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে ২০১৭ সালের বার্সেলোনা থেকে নেইমারকে ২২২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্টের পৃষ্টপোষতায় থাকা এই ক্লাবটি। নেইমারের ট্রান্সফার হওয়ার পর থেকেই ফুটবল বিশ্ব ও ফুটবল বিশ্লেষকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও বেশ কিছু ফুটবল বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন নেইমারকে প্রাপ্য মূল্যের চাইতে অধিক টাকা দিয়ে দলে ভেড়ানোটা পুরো ফুটবল বিশ্বের প্রভাব পড়বে। বিশ্লেষকদের কথা বাস্তবে রূপ নিতে খুব বেশি সময় নেয় নি।

২০১৭ সালে নেইমারের ট্রান্সফারের পর ফুটবল ট্রান্সফার মার্কেটে মুদ্রাস্ফীতি হয় যার ফলে যে প্লেয়ারের মূল্য ৫০-৬০ মিলিয়ন হওয়ার কথা ছিলো তাকে ১০০ মিলিয়নের বেশি টাকা দিয়ে দলে ভেড়াতে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা দলেরা সহজেও এ অবস্থা সামাল দিতে পারলেও বেশিভাগ ক্লাবগুলোকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আর ফুটবলাররাও এখন বেশি ট্রান্সফার ফিতে দল বদলের দিকে আগ্রহী হচ্ছে।

নাসের আল খেলাফির  ২২২ মিলিয়ন ইউরোতে নেইমারকে  দলে ভেড়ানোর পর ২০১৭-১৮ সালে ২ বছরে ১০০ মিলিয়নের উর্ধ্বে ট্রান্সফার হয়েছে ৪ জন প্লেয়ার। যেখান ফুটবল ইতিহাসে এর পূর্বে ১০০ মিলিয়নের ট্রান্সফার তালিকায় ছিলো দুইজন। শুধু তাই নয়, এক দুই সিজনে ভালো খেলা সিজনাল ফুটবলারদের প্রাইজ ট্যাগ ও লাগানো হচ্ছে আকাশ চুম্বী। এর মাঝে ২০ বছর বয়সী ইয়াং প্লেয়ার এম্বাপেকে দলে ভেড়াতে খরচ করেছে ১৮০ মিলিয়ন ইউরো, ডেম্বেলেকে দলে ভেড়াতে বার্সেলোনা খরচ করেছেন ১০৫ মিলিয়ন ইউরো। বাস্তবিক অর্থে এসব তরুণ প্লেয়াররা প্রতিভাবান হলেও এ সময় তাদের এমন দাম এটা বাড়াবাড়ি বলা যায়।

বর্তমানে সময়ে হান্ড্রেড মিলিয়ন ট্যাগ যেনো দুধ ভাত হয়ে গিয়েছে ফুটবল ট্রান্সফার মার্কেটে। এখন ১৫০+ কিংবা ২০০ মিলিয়ন ট্রান্সফার ট্যাগ ও এঁটে দেয়া আছে বহু ফুটবলারের পিঠে।

যেখানে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একজন ভালোমানের ফরোয়ার্ড দলে ভেড়াতে হলে খরচ করতে হতো ৫০-৭০ মিলিয়ন পর্যন্ত। সেখানে ২০১৭’র পর ৩ জন ফরোয়ার্ডকে ১০০-১৮০ মিলিয়ন ইউরোতে ট্রান্সফার করা হয়েছে। হ্যারি কেইন, মো. সালাহদের প্রাইজ ট্যাগ দেয়া হয়েছে ১৫০-২০০ মিলিয়ন ইউরো।

অন্যদিকে মাঝ মাাঠের ফুটবলারদের ২০১৬ পর্যন্ত বাজার মূল্য ৪০-৬০ মিলিয়ন ইউরো থাকলেও ২০১৮ সালে কৌতিনহোকে দলে ভেড়াতে বার্সেলোনা খরচ করে ১২০ মিলিয়ন ইউরো। শুধু তাই নয়, নেদারলেন্ডের ডিফেন্ডার ভান ডিজককে দলে ভেড়াতে ৮৪ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে ইংলিশ ক্লাব লিভারপুল। আর ইংলিশ ক্লাব চেলসি তো স্প্যানিশ গোলকিপার কেপা আরিজাবালাগাকে দলে ভেড়াতে খরচ করে ৮০ মিলিয়ন ইউরো!

এই যে হিসাবগুলো দেয়া হলো তার সবগুলোই ওভাররেটেড এবং তাদের এমন অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণের মূল কারণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবদের অনিয়ন্ত্রিতভাবে টাকা বিনিয়োগ। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ইউরোপে টাকা বিনিয়োগ করেছিলো তবে তা এখন তা সরাসরি ফুটবলকে প্রভাবিত করছে। এখন স্বাভাবিকের তুলনায় ৩-৪ গুন বেশি দামে ফুটবলারদের দলে ভেড়াতে হচ্ছে। এতে করে ফুটবল ক্লাব ও ফুটবলারদের মাঝে বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হচ্ছে। একই সাথে মাঝারি মানের ক্লাবগুলো দিন দিন ফুটবল থেকে সরে যাচ্ছে আর ধনী ক্লাবগুলো সর্ব ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে।

এখন ফুটবল ক্লাবগুলোকেও টিকে থাকার জন্য খেলার চাইতে আয় ও ব্যবসায়িক দিকে বেশি মন দিতে হচ্ছে যেখানে ফুটবলের হিসাবের চাইতে, ব্যবসায়ের হিসাব বেশি চলছে।