ক্যালেন্ডারের হিসাব বলছে, অগ্রহায়ণ মাস হেমন্তকাল। তবে, সেই হিসাবের তোয়াক্কা না-করেই হাজির হয়েছে শীত। সন্ধ্যা ঘনালেই হাওয়ায় শুষ্কতা এবং হিমেল হাওয়া জানান দিচ্ছে, শীত এসে গিয়েছে। আমরা তো এই শীতে নিজেদের মতো করে যত্নশীল থাকছি, গরম জামাকাপড় পরছি। প্রশ্ন হল, আমাদের পরিবারের ছোট্ট শিশুটির সঠিক পরিচর্যা করছি তো? কারণ, এই ঠাণ্ডা মরসুমে আপনার শিশুটির সঠিক পরিচর্যা একান্ত প্রয়োজন। আপনি যদি সচেতন এবং যত্নশীল হতে না-পারেন; তবে ঠাণ্ডা লাগা, হাঁচি-কাশি এমনকী টনসিলের সংক্রমণ ইত্যাদি রোগভোগের কবলে পড়তে পারে আপনার শিশুটি।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অম্লান দত্ত বলছেন, “শীতে হিম সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে শিশুদের। হেমন্তকাল থেকে অল্প হিম পড়ে। যদি সন্ধ্যার পর কিংবা খুব সকালে শিশু খোলা আকাশের নিচে খেলাধুলা করে এবং হিম পড়ে তাদের শরীরে, তবে নানা রোগভোগ তথা সংক্রমণ হতে পারে। অবশ্য কিছু নিয়ম মানলে এবং সচেতনতা অবলম্বন করলে নিরাপদ থাকবে শিশু।” কিছু উপায়ও তিনি বাতলে দিয়েছেন। একঝলকে দেখে নেওয়া যাক, কী কী পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
● কিছু শিশুর অল্প বয়সে গরমের ধাত এবং ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ধাত একসঙ্গে থাকে। যদি গরমে ঘুমন্ত অবস্থায় শিশু অল্প ঘামে এবং ঢাকা ফেলে দেয়, তবে অল্প গতিতে কিছুক্ষণ ফ্যান চালিয়ে নিন। এসি বিলকুল নয়। যদি ঘুমন্ত শিশু ব্লাঙ্কেট বা লেপ নিতে না চায়, অন্তত পাতলা একটা চাদর ঢাকা দিন। শেষ রাত্রের দিকে শিশুকে খোলা অবস্থায় রাখবেন না। খেয়াল রাখবেন, ঘুমন্ত অবস্থায় শিশুর পরনে যেন হালকা জামাকাপড় থাকে। শোয়েটার বা মোটা কাপড় পরে ঘুমালে শিশু ঘামবে, ফলে সর্দি-কাশি হতে পারে। ঘুমন্ত অবস্থায় শরীরের মেটাবলিজম রেট কম থাকে। তাই মোটা কাপড় পরে শিশু ঘুমালে সমস্যা হতে পারে হজমেরও।
● শীতকালে হাসিমুখে স্নান করবে, শিশু কি এমন সুবোধ হয়? যে-শিশু চলতে পারে, তাকে শীতে স্নানের কথা বললেই সে উল্টোদিকে দৌড় দেয়। শিশুকে স্নান করানো মহা ঝক্কির কাজ! বহু অভিভাবক মনে করেন, ঠাণ্ডায় স্নান করালে শিশুর সর্দি-কাশি হতে পারে। অম্লান দত্ত জানাচ্ছেন, বাস্তব কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। ঠাণ্ডা-লাগা থেকে রেহাই পেতে রোজ স্নান করাতে হবে শিশুকে। স্নান না-করলে শরীরে জলের চাহিদা পূরণ হয় না। স্নান করালে শরীরে ধুলোবালি সম্পূর্ণ ধুয়ে যায়, ফলে সংক্রমণের ভয় থাকে না। জন্মের পাঁচ দিন পর থেকে শিশুকে স্নান করানো উচিত। দেড় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে এক দিন অন্তর এবং দেড় মাসের অধিক বয়সি শিশুকে রোজ স্নান করানো খুব ভালো। তবে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি রোগ থাকলে কিংবা নির্দিষ্ট সময়ের আগে শিশুর জন্ম হলে শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ঠাণ্ডা বা গরম জলে নয়, ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করান আপনার বেবিকে। স্নান থেকে আপনার শিশুকে ছুটকারা দিলে ফল হবে হানিকর।
● অনেক অভিভাবক ভয় করেন, রোদে রাখলে শিশুর ত্বক পুড়ে যাবে। আসল কথা হল, শিশুর হাড়ের জোর তৈরিতে এবং ত্বক ভালো রাখতে সূর্যের আলো দারুণ সহায়ক। অলিভ অয়েল বা সরষের তেল শরীরে মালিশ করে বেশ কিছুক্ষণ রোদে রাখুন শিশুকে। তারপর ঘেরা জায়গায় অথবা বাথরুমে স্নান করান। ফাঁকা জায়গায় স্নান করালে হাওয়া ঢুকবে, স্নান আরামদায়ক হবে না। স্নান শেষে শীঘ্র মাথা এবং কান ভালোভাবে মুছিয়ে দিন। তারপর অলিভ অয়েল বা সরষের তেল মালিশ করে আবার কিছুক্ষণ রোদে রাখুন। একটি ভুল অনেকে করেন, স্নানের পর গরম জলে তোয়ালে ভিজিয়ে শিশুকে মুড়ে রাখেন। এটা নেহাত বোকামি, শিশুর সর্দি লেগে যায় এর ফলে। প্রত্যহ একটি নির্দিষ্ট সময়ে শিশুকে স্নান করান, এই ক্ষেত্রে বায়োলজিক্যাল ক্লক হেরফের করা ভালো নয়। যদি কোনওদিন খুব ঠাণ্ডা থাকে, অল্প সময়ে স্নান সেরে নিন। শিশুর সর্দি অথবা জ্বর থাকলে ঈষদুষ্ণ জলে তোয়ালে ভিজিয়ে তা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিন।
● ত্বক বিশেষজ্ঞ কৌশিক লাহিড়ী জানিয়েছেন, শিশুর ত্বক সুন্দর রাখতে কী করণীয়। অধিকাংশ অভিভাবক নিজেদের ব্যবহৃত তেল, ক্রিম বরাদ্দ করেন তাদের বেবির জন্য। শিশুর ত্বক খুব সংবেদশীল হয়। তাই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ব্যবহৃত প্রোডাক্ট শিশুর ত্বক ক্ষতি করে। দশ বছর বয়স পর্যন্ত বেবি প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন। স্নানের সময় গ্লিসারিন সাবান এবং কম ক্ষারের শ্যাম্পু শিশুর ত্বক তরতাজা রাখে। স্নানের পর এবং দুই ঘন্টা অন্তর ব্যবহার করুন অ্যালোভেরা, মধু ও দুধ আছে এমন ক্রিম। পাঁচ বছর বয়সের পর মাঝারি এসপিএফ আছে এমন সানক্রিন লাগাতে পারেন। ঠোঁট ভালো রাখতে ব্যবহার করুন ভালো ব্রান্ডের ন্যাচারাল পেট্রোলিয়াম জেলি।
● শিশুর পরিচ্ছদের দিকেও কড়া নজর রাখুন। আঁশ আছে এমন শোয়েটার এবং কভার ছাড়া লেপ, কম্বল একদম ব্যবহার করবেন না। নরম অথচ গরম, এমন পরিচ্ছদ শিশুর ত্বক রক্ষা করে রুক্ষতা থেকে। গরম জামাকাপড় পরে শিশু খুব ঘামলে, বদলে দিয়ে অন্য পরান। দীর্ঘ সময় শরীর ভিজে থাকলে সর্দি লাগা অনিবার্য।
● শীতে তো বহু সবজির সমাহার! আপনার শিশু ভাত খেতে শুরু করার পর তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সবুজ শাকসবজি খাওয়ান। বেশি পরিমাণে খাওয়ান ভিটামিন সি আছে এমন ফল। লক্ষ্য রাখুন, কোনও সবজিতে শিশুর অ্যালার্জি হলে তা বর্জন করুন। টিফিনে তাকে দুধ-মুড়ি, চিড়ে-দই এই ধরনের হালকা খাবার দিন। তেলমশলা-যুক্ত জাঙ্কফুড যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। তবে, শিশু বায়না করলে মাঝেমধ্যে তাকে বাড়িতে হালকা তেলে মুখরোচক খাবার বানিয়ে দিন। বারংবার শিশুর আব্দার অগ্রাহ্য করা মনস্তত্ত্ব দিকে ভালো নয়।
● বাসে-ট্রেনে কোথাও গেলে কিংবা রাস্তায় বেরোলে মাস্ক ব্যবহার করুন, ধুলোবালির কবল থেকে আপনার শিশু রক্ষা পাবে। মাফলার কিংবা টুপি নিতেও ভুলবেন না।
শিশু যদি জ্বরজালায় ভোগে, তার পিতামাতা কিংবা আত্মজন ভালো থাকতে পারে কি? নিশ্চয় না। তবে, আমরা সঠিক পরিচর্যা করে শিশুকে ভালো রাখতে চেষ্টা করব না কেন? ছোট্ট সোনাটির জন্য একটু খরচ হলই-বা, আমরা তো চাই: আমাদের সন্ততি সুখে থাক! কী, তাই তো?