উন্নয়ন এবং সহিংসতা

আশীষ নন্দী’র লেখা

উন্নয়ন এবং সহিংসতা

উন্নয়ন স্বৈরাচারেরই একটি রুপ – নন্দীর এই বাক্য বাংলাদেশের জন্য কতটা সঠিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়নের জুলুমের রাজনীতি বাংলাদেশে এখন এতোটাই প্রবল যে এটা নিয়ে চিন্তা করার সাহসও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। নন্দী বলছেন, “সুনির্ধারিত পর্যায় অতিক্রম করার পর উন্নয়ন নিজে থেকেই স্বৈরাচার সৃষ্টি করে। এবং এই ঘটনাটি ঐসব সমাজেও ঘটে যারা নিরন্তর উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহনের মাঝখানে সেতুবন্ধন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে” । বাংলাদেশে এখন এটাই দেখতে পাচ্ছি। এই লেখাটি আশীষ নন্দী’র ‘রোমান্স অব দি স্টেট’ বই থেকে নেয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই লেখাটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাঠ করা, নতুন করে ভাবা, চিন্তা করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখতে পারলেই আমরা খুশি হবো। অনুবাদ করেছেন মোহাম্মাদ এ বাসেদ।

উন্নয়নের মতাদর্শগত ব্যর্থতা উন্নয়নবাদের কোনো আদর্শিক সমস্যা নয়। প্রথমদিকে যারা উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন, সেই সময়ে যারা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি যে তারা এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করছে যার সময় ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে, উন্নয়নের ধারণা আজ তাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা উপনিবেশবাদ এবং মৌলবাদী খ্রিস্টীয়বাদ যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, উন্নয়নবাদ (Developmentalism) সেখানে সফল হয়েছে। উন্নয়নবাদ নিজেকে আমাদের সময়কার একটি বিশুদ্ধ, সার্বজনীন বিষয় (Universals) হিসেবে নিজেকে হাজির করেছে। যে সকল সভ্যতা আজ টিকে থাকার লড়াইয়ে ধুকছে, উন্নয়নবাদ আজ তাদের একটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। যেসকল সমাজ বহির্বিশ্বের কাছে অপরিচিত, দুর্বোধ্য (less accessilble) হিসেবে একদা প্রতীয়মান হতো, উন্নয়নবাদ আজ তাদের নিজস্ব পরিচয়কেই পাল্টে দিয়েছে। যে বিষয়গুলোকে কখনো বদলানো যাবে না (non-proselytizable) বলে একদা ভাবা হতো, উন্নয়নবাদ আজ সে সকল বিষয়গুলোকেও আমূল বদলে দিয়েছে।

নিজস্ব পরিচয়ের (self-definition) মধ্যদিয়ে এই সকল পরিবর্তন দুটি গন্তব্যের দিকে এগিয়েছে। প্রথমত, আক্রান্ত সভ্যতাগুলোর নিজস্বতার (self) উপাদানগুলোর পূনঃর্বিন্যাস ঘটেছে। এসকল সংস্কৃতিতে একটি নতুন, বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ (preferred traits ) শাসনব্যবস্থা (hierarchy) অনুপ্রবেশ করেছে। অসংখ্য এশিয়ান, আফ্রিকান এবং দক্ষিন আমেরিকান সমাজে আজ ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে (cultural preferences ) অবমূল্যায়ন করা হয় এবং ঐসকল সমাজের অধিক আত্মসচেতন (self-cautious) সদস্যরা এগুলোকে লজ্জার কারণ বলে মনে করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে এ সকল সমাজে এমনকি গৎবাঁধা (atavistic), পিছিয়ে পড়া (retrogressive), এমনকি দুর্বোধ্য (obscurantist) বলেও ভাবা হয়। এসব সমাজের অভিজাত শাসকগোষ্ঠী (elite rulling) আজ বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার (global cultural order) সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংস্কারের (cultural engineering) সাথেও জড়িত। পোষ মানা জন্তুকে যেভাবে চালনা করা হয়, ঠিক একই উপায়ে উন্নয়নবাদ যে উন্নত পৃথিবীর (better world) ওয়াদা করে সেটির লক্ষ্যে নিজেদের সমাজকে চালনা করার জন্যে এইসকল শাসকশ্রেণি যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে রাজি। এধরনের আত্ম-সংস্কারকে (self-engineering) ব্যাখ্যা করার আরেকটি অপ্রিয় পন্থা হচ্ছে এটিকে আত্ম-হিংসা (self-hatred) এবং অনুকরণের (mimicry) একটি মিশেল বলে আখ্যা দেয়া যায়, যে মিশেলটি এসকল সমাজে এক ধরনের নব্য রাজনৈতিক স্বৈরাচারের (political authoritarianism) জন্ম দিচ্ছে। এই মিশেলটি আজ এমন সব সমাজেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যারা উন্নয়নের ইতিহাসে একের পর এক সফল অধ্যায় যোগ করার মাধ্যমে একদা পৃথিবীকে মহিমান্বিত করেছিলো।

উন্নয়নের পথে অতীতের যে অংশটুকুকে সহজে গ্রহণযোগ্য (conducive) বলে মনে করা হয় ততটুকুকেই কেবল গ্রহণ করা হয়, এবং যে অংশটুকুকে তথাকথিত উন্নয়ন এবং আধুনিকতার পথে বাধা বলে মনে করা হয়, তাকে ভুলে যাওয়া (rued) হয়।

 

নিজস্ব পরিচয়ের প্রায়স সহিংস পরিবর্তন (retooling) এবং স্মরণযোগ্য অতীতের (remembered past) একটি উল্লেখযোগ্য অংশের বিলুপ্তি একই সাথে ঘটেছে। বিব্রতকর এবং অপ্রাসঙ্গিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত পুরোনো, বস্তাপচা বিষয়গুলোকে একের পর এক সমাজের গাঠনিক উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সত্যিকার অর্থে যেগুলো আসলে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কথা ছিলো। পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজই যেখানে নতুন, ভিন্নধারার কোনো না কোনো উপায় ধরে এগোচ্ছে, সেখানে এই ধরনের প্রক্রিয়া কেবলমাত্র রাষ্ট্রের সহিংস হস্তক্ষেপের (coercive apparatus) ফলেই সম্ভবপর হয়েছে। বর্তমানে, আধুনিকায়ন এবং উন্নয়নের পথে অতীতের যে অংশটুকুকে সহজে গ্রহণযোগ্য (conducive) বলে মনে করা হয় ততটুকুকেই কেবল গ্রহণ করা হয়, এবং যে অংশটুকুকে তথাকথিত উন্নয়ন এবং আধুনিকতার পথে বাধা বলে মনে করা হয়, তাকে ভুলে যাওয়া (rued) হয়। অতীতের যে অংশটিকে গ্রহণ করা হয় সেটি এক পর্যায়ে গিয়ে ইতিহাস গঠন করে এবং কিছুকাল পর নাগরিকদের জন্য স্মরণযোগ্য একমাত্র স্মৃতিতে পরিণত হয়। অতীতের বাকি অংশটুকু অনৈতিহাসিক (ahistorical), পুনর্জাগরণমূলক রুপকথায় (revivalist myth ) পরিণত হয়। নিজস্বতার যে অংশটুকু অতীতের এই হারিয়ে যাওয়া অংশের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সেটিও একই কাজ করে। বিব্রতকর বলে পরিচিত উক্ত অতীতে যে সকল সহিংসতা এবং অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে এবং যারা এইসকল ঘটনার পেছনে দায়ী তারা আজ “মৌলবাদের উপরে হামলা”, “প্রাচ্যদেশীয় স্বৈরাচার (oriental despotism) ” ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করার মাধ্যমে অভূতপূর্ব বৈধতা (enormous legitimacy ) উপভোগ করেন।

এতকিছুর পরেও, মানুষের চরিত্র যাই হোক না কেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনের প্রতিটি পরিকল্পনা তার উল্টো রুপ (counter visions) প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দ্বন্দ্ব(distinctive strains of dissent) সৃষ্টি করে। সারা পৃথিবীব্যাপী উন্নয়ন যে আগ্রাসী বল প্রয়োগ করছে তার বিরুদ্ধে আশির দশক থেকেই কণ্ঠস্বর জাগ্রত হয়েছে। কণ্ঠস্বরগুলো এই সচেতনতাবোধ সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে যে উন্নয়নবাদের আদর্শ যখন বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার সবচাইতে অসম্ভব বিজয়গুলো অর্জন করে চলেছে, সাথে সাথে এই একই উন্নয়নবাদ তার সবরকম বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনার পথকেও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। আমাদের সময়কারের উন্নয়নবাদ অসংখ্য সংবেদনশীল চিন্তকদের (sensitive minds) কাছে এখন কেবলই একটি ফাঁকা বুলি (tinsel glitter) হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে। কোথায়, কিভাবে, কি উদ্দেশ্যে (pragmatics & management)  উন্নয়নবাদ নামক আদর্শটিকে ব্যবহার করা যায় এ বিষয়গুলোতে যারা বিশেষ পারদর্শী কেবলমাত্র তারাই আজ উন্নয়নের খুটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে নাড়া-চাড়া করে থাকেন। বুদ্ধিবৃত্তিক ঔজ্জ্বল্যের (intellectual shine ) এই ক্ষয়ের (loss) ফলস্বরুপ বিশ্বমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতেও উন্নয়ন নিয়ে উচ্চবাচ্চ্য (nitty-gritty) করার ক্ষেত্রে একপ্রকার উদাসীনতা দেখা দিয়েছে। তবুও, লোকচক্ষুর অন্তরালে আজও উন্নয়নবাদের অশুভ গতিবিধি ক্রিয়াশীল রয়েছে, কারণ উন্নয়নের যারা ভুক্তভোগী তাদের ভাগ্যে কি ঘটে সে সম্পর্কে হয় অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞাত, নয়তো ঐসকল ভুক্তভোগীদের ভাগ্যের সাথে খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রাত্যহিক জীবনে সংশ্লিষ্ট।

বিশ্ব রাজনীতিতে উন্নয়নবাদ যেখানে পরিষ্কারভাবেই বিজয়ী (triumphant), জ্ঞানের জগতে কেনো তবে উন্নয়নবাদের গ্রহণযোগ্যতার এতো ঘাটতি? এর অনেক কারণ রয়েছে, কিন্তু আদর্শ হিসেবে নীতিগত অবস্থানের দিক দিয়ে উন্নয়নের যে ধারাবাহিক অধঃপতন (gradual decline), মূল কারণগুলো এই বিষয়টির সাথে সরাসরি জড়িত। উন্নয়ন সম্পর্কিত বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দারুণ সমালোচনা রয়েছে, যেমন- উন্নয়নের ধ্বজাধারীদের বিশ্ববাজারের উপরে অগাধ বিশ্বাস রাখা নিয়ে সমালোচনা, তাদের অব্যক্তিগত-পেশাদার- চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে সমালোচনা, প্রকৃতিকে ব্যবহার করে  মুনাফা উপার্জন করা এবং প্রকৃতিকে হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করার সমালোচনা, বিশালাকার প্রতিষ্ঠান (mega- organizations) এবং প্রযুক্তির (mega-technology) প্রতি এদের অনভিজ্ঞ ভরসা স্থাপনের সমালোচনা ইত্যাদি। পাশাপাশি, প্রতিটি সমাজেই উন্নয়ন একটি প্যাকেজের অংশ হিসেবে আসে। এই প্যাকেজের আরও বেশ কিছু অংশ থাকে, যেমন- জাতিরাষ্ট্র ( nation-state ) প্রতিষ্ঠা করাকেই সকল প্রকার সমাজ পরিবর্তনের উপায় হিসেবে বিবেচনা করা, এটা মনে করা যে উন্নয়ন ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং পরিপক্ক একটি ধারণা এবং পরিশেষে, নগরায়ন এবং শিল্পায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন নামক ধারণাটিকে লোকায়তকরণ বা জনপ্রিয় করা । এগুলো সবই আধুনিকতার নৈতিক আঙ্গিকের সাথে জড়িত। আরতুরো এসকোবার ( Arturo Escobar ) যেমনটা বলেছেন, “আধুনিকতা যদি নৃতত্ত্ব হয় এবং উন্নয়ন যদি এই নৃতত্ত্বের একটি অধ্যায় হয়, আধুনিকতার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উপরে নীতিগত দিক থেকে যে পরিমান আলোকপাত (evaluation) করা হচ্ছে, উন্নয়ন তাকে এড়িয়ে যেতে পারে না।”

উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ণ কারীদের উন্নয়ন সম্পর্কে প্রচার করা দৈববানীর বিরুদ্ধে ক্রমশ বর্ধমান বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহ  সৃষ্টি হওয়ার পেছনে একটি কারণ আছে, এটি আসলে  ব্যাখ্যা করে উন্নয়নবাদ কি করে তার কমনীয়তা  হারালো।

 

ইতোমধ্যে এসকল আলোকপাত উন্নয়নের বিরুদ্ধে যেতে শুরু করেছে। উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ণ কারীদের উন্নয়ন সম্পর্কে প্রচার করা দৈববানীর বিরুদ্ধে ক্রমশ বর্ধমান বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহ  সৃষ্টি হওয়ার পেছনে একটি কারণ আছে, এটি আসলে  ব্যাখ্যা করে উন্নয়নবাদ কি করে তার কমনীয়তা  হারালো। ব্যক্তি (individual) বলতে আসলে কি বুঝায় – ধারণাটির অনেক বড় একটা অংশ উন্নয়নবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার নামে মুছে ফেলেছে। উন্নয়নের এইসব ধারণা আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে বেশিরভাগ বিষয় যেগুলো একসময় ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার অংশ ছিলো আজ বিভিন্ন সংস্থার হাতে চলে গিয়েছে, যারা প্রচার করে থাকে যে তারা একজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত-নয়, চুক্তিভিত্তিক এবং পেশাদার সিদ্ধান্ত দিয়ে বা নিয়ে থাকে। ফলে, ব্যক্তিটির করার মতো কেবল একটি কাজই বাকি থাকে, বিশ্ব বাজার ভোগ করার মতো যে সকল উপাদান সরবরাহ করছে, সেগুলোর মধ্যে কোনটি কিভাবে ভোগ করা যায়, শুধুমাত্র সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সন্তান লালন-পালন, সর্বত্র একই অবস্থা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে জনগণের মাঝে একটি মিথ্যা স্বাধীনতাবোধের (false sense of freedom) জন্ম হয়েছে, কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একসময় প্রতিটি সম্প্রদায়ের যে প্রাসঙ্গিক চরিত্র ছিলো, তা আজ সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সত্যি বলতে, মুক্ত হওয়ার নামে বিভক্ত হয়ে পড়ার ফলে মানুষ আজ বিশ্ববাজার এবং মহাপ্রযুক্তির অসীম শক্তির বিরুদ্ধে একেবারেই অসহায়।

একই সাথে, সহিংসতা অব্যক্তিগত আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট – হান্না আরেনড ( Hanna Arendt) যেটির কথা বলেছেন- আজ আমলাতন্ত্র অবাধভাবে বিচরণ করার শক্তিমত্তা অর্জন করেছে। যেহেতু যুদ্ধ, জনগণের উপরে সরাসরি সহিংস আক্রমন, অত্যাচার এবং অহরহ নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি— বিষয়ে জবাব দেয়ার সুযোগ দিনকে দিন কমে আসছে, আধুনিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পরোক্ষভাবে এবং বৈধ উপায়ে সহিংসতা, নজরদারী এবং জনসাধারনের জীবন রক্ষাকারী উপাদানসমূহকে ধ্বংস করার পরিমান তাই দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

পুরনো ধারার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ( Hegemony) অর্জনের মধ্য দিয়ে নগ্ন বলপ্রয়োগ এবং উন্মুক্ত শোষনের মধ্য দিয়ে এসকল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যাদের উদ্দেশ্যে উন্নয়নবাদ নামক আদর্শটির আমদানি, তাদেরই জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, যা কিনা অ-পশ্চিমী ( non-western ) সংস্কৃতি, কেড়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে এসকল পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষক, নীতি-নির্ধারক, উন্নয়ন সাংবাদিক, উন্নয়ন-বিষয়ক সংবাদের পাঠক, উন্নয়ন ব্যবস্থাপক এবং উন্নয়নবাদের সক্রিয় কর্মীদের একটি নতুন সম্প্রদায় আজ উন্নয়নকে একটি পেশাদার, সাংগঠনিক এবং উদ্যোগভিত্তিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঐতিহ্যগুলোর অযৌক্তিক (irrational), সহজে নিস্পত্তিযোগ্য (disposable ) কিছু বিষয় ব্যতীত অন্য জটিল বিষয়গুলোকে উন্নয়ন সমর্থনকারী বিশ্বব্যবস্থা খুব একটা চ্যালেঞ্জ করছে না।

উন্নয়নের কিছু যথার্থ মিশনারি আছে, যাদের মাধ্যমে এই বিশ্বব্যবস্থাটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিগুলোতে প্রবেশ করছে এবং পৃথিবীর বুকে একটি সহজে গ্রহনযোগ্য, ধর্ম নিরপেক্ষ স্বর্গ সৃষ্টি করার বানী প্রচার করছে। এই বিশ্বব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, কেবলমাত্র বিশ্বজুড়ে উন্নয়নবাদকে স্থায়িত্ব দান করা এবং সংস্কৃতিগুলোকে টিকিয়ে রাখা। নন-ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতিগুলোকে টিকিয়ে রাখার গুরুতর সমস্যাগুলোকে এইসব সংস্কৃতিকে বর্তমান সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার এবং টিকিয়ে রাখার জন্য আবশ্যক আদর্শ হিসেবে হিসেবে গন্য করা হয়। বিশেষজ্ঞ কিংবা সক্রিয় কর্মী, যে যাই বলুক না কেনো, টেকসই উন্নয়নবাদ নামক যে স্লোগান প্রচার করা হচ্ছে, তার সত্যিকারের রুপ এটাই।

উন্নয়ন এবং সহিংসতার মধ্যকার সম্পর্ক শুধু পৃথিবীর দক্ষিণ অংশেই কেনো এতো জোরালো? একটা কারণ হতে পারে যে দক্ষিণের সমাজগুলোতে যারা এখনও উচ্ছেদের শিকার হয়নি কিংবা যাদের এখনো সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ঘটে নি, তারা এখনও উন্নয়নবাদকে সন্দেহের চোখে দেখে। একে শুধুমাত্র একটি বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখা হয় না, দক্ষিণের সমাজগুলোর অনেক অভিজাত মানুষদের মাধ্যমে এর গা থেকে সবধরনের ভূ-নৃতাত্ত্বিক (geo-ethnic) এবং আবশ্যিক যোগ্যতাকে খুলে নেয়া হয়েছে। যেসকল সমাজে সম্প্রদায়গুলো এখনো ভেঙ্গে পড়ে নি কিংবা নাগরিকরা এখনো পুরোপুরি নকলবাজ হয়ে উঠতে পারেনি, সেখানে পুরোপুরি বৈশ্বিক, জগত এবং সময়কে অতিক্রম করে চলা একটি স্বপ্নরাজ্য বিনির্মানের যে সমাজতাত্ত্বিক ধারণে তার প্রতি এক ধরনের সন্দেহ কাজ করে। এ সকল সমাজে হয় ধর্ম নয়তো অগ্রগতির যেসকল তত্ত্ব রয়েছে তাদেরকেই কেবল এইসব সমাজতাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

তারপরেও, একইসাথে মনে হচ্ছে উন্নয়নবাদ মানবচরিত্রের একটি সার্বজনীন অংশকে ছুয়ে যেতে পেরেছে। যখন বেইজিং থেকে বার্লিন এবং মস্কো থেকে নয়াদিল্লী পর্যন্ত গৎবাঁধা লক্ষ্য পূরণকেই উন্নয়ন ঘটিয়ে ফেলা বলে মনে করা হচ্ছে- একই বিষয়টিকে তৃতীয় বিশ্বের কিছুসংখ্যক কর্মী এবং সম্প্রদায় সন্দেহের চোখে দেখছেন, যা কিনা ঐসকল মানুষদের জন্য একটি বিব্রতকর ব্যাপার যারা বৈশ্বিক উন্নয়নবাদভিত্তিক শাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি একধারার গণ-সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখে। এমনটা করার মাধ্যমে এসকল কর্মী-বিশেষজ্ঞরা অন্য অনেক পরাজিত সভ্যতার পক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন, ঐ সকল প্রায়শ-হুমকিতে থাকা সভ্যতা যাদেরকে পশ্চিমা সভ্যতা বাতিল বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। এসকল মানুষ মনে করেন যে, উন্নয়নবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া মানে ঐ সকল সংস্কৃতিসমূহের হারিয়ে যাওয়া মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য সোচ্চার হওয়া যারা খুব শীঘ্রই হয় জাদুঘরে নয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে ঠাই পেতে যাচ্ছে। এইসব সংস্কৃতিসমূহের যে অবধারিত পরিণতি তা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়ে গিয়েছে, যেমনটা রাউল প্রেবিশকে নিয়ে আরতুরো এসকোবার বলেছেন, ‘“সময় এবং জগতের বাইরের অচেনা এক বিজ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির মতাদর্শগত বন্ধ্যাত্ব”।

অর্থনীতিবিদদের জন্য তৃতীয় বিশ্ব এবং দারিদ্রতা হচ্ছে একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, যা তাদেরকে আমাদের সময়কার স্থানীয় চিকিৎসকরুপে হাজির হয়ে ব্যবসার পসার ঘটাতে সাহায্য করে, বিশেষ করে ঐসব রোগ যেগুলো বংশ-পরম্পরায় অর্জিত। তারা এটা ঘৃণাভরে অস্বীকার করে যে দারিদ্র্যতা এমন কোনো সুপ্রাচীন রোগ নয় যা উন্নয়ন দূর করছে, দারিদ্র্যতা হচ্ছে আধুনিকতার যে স্বাস্থ্যকরী ছোঁয়া তারই বাই-প্রোডাক্ট মাত্র।

উন্নয়নের ধারণাটিকে প্রথমদিকে অত্যাচারী বলে মনে না হলেও, একসময় না একসময় এটাকে এমনটা হতেই হতো, কারন এটিকে একের পর এক সরকার তাদের অত্যাচারকে বৈধতা দেয়ার কাজে ব্যবহার করেছে।

 

সবকিছুর পরে, প্রতিটি মতাদর্শের একটি স্বাভাবিক জীবনকাল রয়েছে। সবচাইতে শ্রেষ্ঠ মতাদর্শগুলোও প্রাচীন হয়ে যায় এবং মানবচরিত্র যাই হোক না কেনো, সবচেয়ে বাধ্যতামূলক আলোচনাগুলোকেও একসময় সহিংসতা এবং শোষনকে বৈধতা দানের উদ্দেশ্যে বদলে ফেলা হয়। উন্নয়নের ধারণাটিকে প্রথমদিকে অত্যাচারী বলে মনে না হলেও, একসময় না একসময় এটাকে এমনটা হতেই হতো, কারন এটিকে একের পর এক সরকার তাদের অত্যাচারকে বৈধতা দেয়ার কাজে ব্যবহার করেছে।

এ ধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হওয়ার কারনে উন্নয়নের সংস্কৃতিকে তাদের পছন্দের সমাজের অন্যসব ভিন্নধারার দৃষ্টিভঙ্গিকে ধ্বংস করে দিতে হয়। এই কারনে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়নের গোপন কাঠামোর (hidden structure of dominance) বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চাইতেও বড় কোনো বিষয় হিসেবে একটি উন্নয়ন পরবর্তী সময়ের (post-development era) কল্পনা করা হচ্ছে, বর্তমানে যার অর্থ হচ্ছে বর্বর পৃথিবীকে তাদের নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা করার অধিকার দেয়া। পরিকল্পনাগুলো আর যাই হোক না কেনো, নন-ওয়েস্টার্ন বিষয়গুলোকে অ-একীভূত(de-homogenize) করতে, সামাজিক হস্তক্ষেপ (intervention) ঘটাতে এবং ভিন্নমতগুলোকে (dissent) নানা দিকে ছড়িয়ে দেয়ার (re-pluralize) অঙ্গীকার করে।

এই কথাগুলো আফ্রিকান-এশিয়ান জাতীয়তাবাদের প্রচ্ছন্ন আত্মরক্ষা কিংবা ‘দয়ালু বর্বরতা (noble savage)’ নামক ধারণাটির কাছে আবারও ফিরে আসার আকুতি নয়। এ কথাগুলো এটাই প্রমান করার একটি প্রচেষ্টা যে, মানবজাতিকে যদি পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়, তবে তারা যেকোনো অবশ্যম্ভাবী তত্ত্বকে সহিংসতা এবং শোষনকে জাস্টিফাই করার কাজে ব্যবহার করতে পারে। উন্নয়ন এখন পুরোনো ধারার ধর্মীয় কোন্দল, ঔপনিবেশিক যুদ্ধ এবং বর্ণবাদের কাছ থেকে মালামাল গ্রহণ করতে শুরু করেছে, যেগুলো একদা বিধিসম্মত উপায়ে এবং মানবসৃষ্ট সহিংসতাকে সমর্থন করার মাধ্যমে প্রাণ পাওয়া বিষয়গুলোর জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় বাকি থেকে যায়। আমাদের সময়কার একটি যন্ত্রনাদায়ক ব্যাপার হচ্ছে, উন্নয়নে সফলতা তৃতীয় বিশ্বের সমাজগুলোতে স্বৈরাচারী রাজনীতির উন্মেষ ঘটিয়েছে। একের পর এক সমাজ যারা উন্নয়নে সফলতা অর্জন করেছে কিংবা এমনটি করার চিহ্ন দেখিয়েছে- যে সফলতা অর্জন করার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে আজ তার কাছেই আমারা হুমকির সম্মুখীন— যা কিনা সুপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের তত্ত্বগুলোকে পুরোপুরি ভুল প্রমান করে ছাড়ে। উন্নয়ন এবং স্বৈরাচারের মধ্যকার সম্পর্কটি ভারত এবং শ্রীলঙ্কার মতো মুক্ত সমাজেও বেড়ে চলেছে- নব্বইয়ের দশকে তারা যখন উন্নয়নের আরও চিরায়ত (conventional) রুপ দেখতে চাইলো তখন থেকেই।

অতীতে আমাদেরকে বলা হতো যে উন্নয়নের অভাবে স্বৈরাচারের সৃষ্টি হয়। আমাদেরকে বলা হতো যে শেষে এসে হলেও উন্নয়ন গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের যেসকল সামাজিক-অর্থনৈতিক পূর্বযোগ্যতা দরকার সেগুলোতে যারা বিশ্বাস করতো- ট্যালকোট পারসোনস ( Talcott Parsons ) থেকে ডেভিড ইস্টন (David Easton ) এবং এডওয়ার্ড শিলস ( Edward Shills ) থেকে কার্ল ডাশ ( Karl Dusch ) পর্যন্ত, এবং যারা বিশ্বাস করতো যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ( state-regulated economic growth ) তারা যে স্বর্গরাজ্যের (Utopia ) স্বপ্ন দেখে সেটিকে সত্যে পরিণত করার একমাত্র রাস্তা— লেলিন থেকে শুরু করে নেহেরু পর্যন্ত, উভয় দিকের মানুষেরাই প্রাচ্যদেশীয় নির্যাতনকে (oriental despotism) স্বৈরাচারের প্রাথমিক কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। উভয়েই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই কেবল এশিয়ান এবং আফ্রিকান সমাজগুলোর মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসেবে দেখেছিলেন, মুক্তি থেকে দূরে সরে যাওয়ার উপায় হিসেবে নয়। ষাটের দশকে ইভরেট হ্যাগেন (Everett Hagen ) এবং কে ডব্লিউ কার্লের ( K.W. Karl) এর মতো বিশ্লেষকরা গণতন্ত্রবিরোধী ব্যক্তিত্ব ( anti-democratic personality ) এবং বিনিয়োগকারী ব্যক্তিত্বের ( entrepreneurial man ) মধ্যে সম্পূর্ন উল্টো সম্পর্ক তৈরি করে দেখিয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, চীন এবং ব্রাজিলে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে তা এই ধরনের চিন্তা করা নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয় যে সাধারণ তৃণমূল আন্দোলন (grassroots movement) এবং বিশেষত নাগরিক অধিকার আন্দোলনগুলো (civil rights movement ) উন্নয়ন নামক ধারণাটির প্রতি সহিংস হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি উন্নয়ন বলতে আসলে কি বুঝানো হচ্ছে, নতুন কোনো রুপ নাকি প্রথাগত(conventional ) উন্নয়ন, এই প্রশ্নটিরও তোয়াক্কা করছে না।

উন্নয়নের নামে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে অঢেল খরচের পক্ষে সমর্থন আদায়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞদের একটি দ্বিতীয় দলের কাছে, স্বৈরাচার (Authoritarianism) উন্নয়নবাদেরই একটি রুপ। তারা সরাসরি তাদের এই মতকে প্রচার করে না, বরং তারা তাদের মতের সমর্থনে নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিস্ট ইতালি, স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়া, মাওয়িস্ট চীন, যুদ্ধপূর্ব জাপান এবং ল্যাটিন আমেরিকার সামরিক একনায়কতন্ত্রের উদাহরণ টেনে আনে। এসকল সমাজে সংকীর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তরালে উচ্চাভিলাষী, কার্যকরী রাজনীতিকে প্রথমত (১) ভোগ করার ক্ষেত্রে বাধা ( consumption-restraints )  এবং সমষ্টিগত ত্যাগ স্বীকার ( collective sacrifice ) এবং দ্বিতীয়ত (২) উন্নয়নের নামে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে অঢেল খরচের পক্ষে সমর্থন আদায়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। জেমস গ্রেগর এই ধারাটির একটি বিশেষ অংশ নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন। তার বিশ্লেষণকে যতোই সন্দেহবাদী কিংবা পুরোদস্তুর রক্ষণশীলই মনে হোক না কেনো, সবকিছু মিলালে যারা উন্নয়নের ভুক্তভোগী এবং যারা প্রত্যক্ষ করেছে যে যখন অবস্থা অনুকূলে থাকে না তখন তাদের শাসকগোষ্ঠী এবং প্রথম বিশ্বের স্পন্সররা মুক্তির জায়গায় উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে সেইসকল মানুষদের অভিজ্ঞতার সাথে গ্রেগর সাহেবের বিশ্লেষণ পুরোপুরি মিলে যায়।

আরেকটি নীরব বিশ্লেষণ রয়েছে, নীরব কারণ বাস্তুতন্ত্র, সাংস্কৃতিক ভাবে টিকে থাকার লড়াই এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করতে থাকা দুনিয়াজোড়া অসংখ্য তৃনমূল পর্যায়ের সংস্থার কর্মকাণ্ডে একটি বিষয় গোপন থাকে, তা হলো একটি সুনির্ধারিত পর্যায় অতিক্রম করার পর উন্নয়ন নিজে থেকেই স্বৈরাচার সৃষ্টি করে। এবং এই ঘটনাটি ঐসব সমাজেও ঘটে যারা নিরন্তর উন্নয়ন এবং গনতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মাঝখানে সেতুবন্ধন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্লেষনটি আরও বলে যে স্বৈরাচারের উপাদানগুলো সবসময়ই উন্নয়নের মাঝে ছিলো, এমনকি গনতান্ত্রিক পশ্চিমেও। পশ্চিমে এই উপাদানগুলোকে হয় উপনিবেশবাদের মাধ্যমে, অধিকার সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার মাধ্যমে ( ইউরোপে এগুলো নিয়ে উচ্চারিত কণ্ঠগুলোকে জনগণের স্মৃতি থেকে মুছে দেয়া হয়েছিলো ) এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীদের অত্যাচার, বাস্তুতান্ত্রিক ধ্বংস, মূলোৎপাটন এবং বিলুপ্তির (যেমনটা হয়েছিলো উত্তর এবং দক্ষিন আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের সাথে) মাধ্যমে সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিলো (পশ্চিমে উপনিবেশবাদের ফলে সহায়-সম্বল হারানো লাখ লাখ জনগোষ্ঠীকে এইসব উপনিবেশে রপ্তানি করা হয়েছিলো এবং এসকল উপনিবেশ হতে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাচামালগুলোকে সস্তায় পশ্চিমে আমদানি করা হয়েছিলো ), নতুবা গোপন-উপনিবেশগুলোতে স্বৈরাচার আমদানির মাধ্যমে ( যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আমেরিকায় করে এসেছে যুগের পর যুগ ধরে)। যখন এইসকল সুবিধা হারিয়ে ফেলে, তখন উন্নত সমাজগুলোতেও স্বৈরাচার নিজেকে উন্নয়নের অপর পিঠ হিসেবে প্রমাণ করে ছাড়ে।

এই ধরনের বিশ্লেষণ ‘স্বৈরাচারকে উৎসাহিত করে’- উন্নয়নের এমন তিনটি আঙ্গিকের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমত, যখন একটি উন্নয়নশীল সমাজে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের পরিমান বাড়ে এবং সামাজিক পরিবর্তনের নতুন নতুন পথ খুলে যায়, তখন এই ঘটনাগুলো সমাজের যে সকল শ্রেণি একদা একেবারে প্রান্তে চলে গিয়েছিলো তাদেরকে রাষ্ট্রব্যবস্থার একেবারে কেন্দ্রে নিয়ে আসে। যারা সমাজকে নিয়ন্ত্রন করে এবং উন্নয়নের সুযোগ-সুবিধাগুলোকে একমুখী করে তাদেরকে এই শ্রেণিগুলো হুমকিতে ফেলে দেয়। বিশেষত এমনটা হয় কারণ উন্নয়ন বলতে তখন বোঝায় রাষ্ট্র, সুসংগঠিত ক্ষেত্রসমূহ এবং বাজার কর্তৃক এসব সাধারন বিষয়গুলোর হাতবদল–যেগুলোতে একসময় ঐতিহ্যগতভাবে সমাজের একেবারে দূর্বলদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ ছিলো। এই হাতবদল হওয়া সাধারণ বিষয়গুলোকে তখন বাজার উপযোগী দ্রব্যাদি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এইসব দ্রব্যাদি যারা এই সাধারণ বিষয়গুলো থেকে একদা উপকার পেতো তাদের হাতে কখনোই পৌছায় না। তো, যখন এইসব অবস্থানচ্যূত উপকারভোগীদের কোনোপ্রকার ক্ষমতায়ণ ঘটে, তারা উন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ জনতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।

তাৎক্ষনিকভাবে বলতে গেলে, কোনো একটি বনে বসবাসরত কোনো উপজাতীয় গোত্র হয়তোবা বন থেকে উন্মুক্তভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি ( fossil fuels) সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু যখন ঐ বনটি বাঁধ নির্মাণ এবং পারমানবিক স্থাপনা (hydel plant) নির্মাণের জন্য কেটে ফেলা হয়, তখন এই উপজাতীয় গোত্রটি হয়তো বা নতুন এই জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ নাও পেতে পারে, কিন্তু অতি অবশ্যই তারা মূলোৎপাটন ( uprooting ), জীবিকা হারানো এবং সংস্কৃতি বিনষ্টের (de-culturation ) মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে করে এই বাস্তুচ্যুত হওয়া এবং বহিস্কৃত হওয়া তাদেরকে রাজনীতিমুখী করবে যা তাদেরকে রাষ্ট্রের জন্য হুমকিতে পরিণত করবে। রাজনীতিতে নতুন অংশগ্রহনকারীদেরকে জব্দ করা এবং তাদের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য তখন স্বৈরাচার একটি সহায়ক উপায়ে পরিণত হয়। জব্দ করার প্রক্রিয়াটিকে এ এফ কে অরগ্যান্সকি (organski) বলেছেন ‘নতুনরুপে পরিবর্তিত ক্ষেত্রগুলোর শোষন এবং নিয়ন্ত্রন’।

ফ্যাসিজমের অন্তরাত্মা হিসেবে এই শোষণ এবং নিয়ন্ত্রনকে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশকারীদের সুস্পষ্ট আদর্শহীনতা এবং অপরিণত আচরনের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবসময়ই রাজনীতিতে নিচুশ্রেণির বিশেষ স্টাইল দেখে চমক বোধ করে থাকে। রাজনীতিতে কারও অংশগ্রহণকে জব্দ করার জন্য স্বৈরাচার সবসময়েই এই ধরনের চমকের ফায়দা গ্রহণ করে এবং উন্নয়নের জয়গান এ সকল সমাজে এই জব্দ করার প্রক্রিয়াটিকে বৈধতা দান করে থাকে।

 

ফ্যাসিজমের অন্তরাত্মা হিসেবে এই শোষণ এবং নিয়ন্ত্রনকে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশকারীদের সুস্পষ্ট আদর্শহীনতা এবং অপরিণত আচরনের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবসময়ই রাজনীতিতে নিচুশ্রেণির বিশেষ স্টাইল দেখে চমক বোধ করে থাকে। রাজনীতিতে কারও অংশগ্রহণকে জব্দ করার জন্য স্বৈরাচার সবসময়েই এই ধরনের চমকের ফায়দা গ্রহণ করে এবং উন্নয়নের জয়গান এ সকল সমাজে এই জব্দ করার প্রক্রিয়াটিকে বৈধতা দান করে থাকে।

দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন মানে হচ্ছে ভবিষ্যতের কোনোকিছুর জন্য বর্তমানের কিছু জিনিসকে ত্যাগ করা। যখন উন্নয়ন রাষ্ট্রের একটি উদ্দেশ্যে পরিণত হয়, তখন বিশেষজ্ঞদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী এসকল ত্যাগের বোঝা জনগণের উপরে চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিজেকে বৈধ বলে মনে করে। স্বৈরাচার তখন রাষ্ট্র কর্তৃক বাছাইকৃত শ্রেণি থেকে হয় এই ত্যাগগুলো শুষে নিতে ( যে ক্ষেত্রে গভীর নিরীক্ষনে এই ত্যাগ-সংক্রান্ত ক্ষেত্রটি হয় রাষ্ট্রের সমালোচনাকারী নতুবা রাষ্ট্রের সমর্থনকারী হিসেবেই প্রতীয়মান হয়) নয়তো যারা রাষ্ট্রের এই পদক্ষেপগুলোতে বাধা দিতে অক্ষম তাদের উপরে যাচ্ছে তাই অধিকার ফলানোর একটি মাধ্যমে পরিণত হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শই বড় ব্যবসার হাতে সকল অর্থনৈতিক সুবিধা তুলে দেয়া ( trickle-down-effect ) কিংবা বাজার শক্তির ( market force ) আদর্শ চাপিয়ে দেয়া হয়।

তৃতীয়ত, বর্তমানে উন্নয়ন বলতে যা বুঝায় তা যদিও ১৯৪০ এর দশকে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিলো, প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুম্যান ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি উন্নয়নের বর্তমান রুপের প্রথম বাস্তবিক ব্যবহার দেখিয়েছিলেন। ৩০০ বছরের যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব আজ তাদের বর্তমান রুপ লাভ করেছে সেটিকে নির্দেশ করতেই উন্নয়ন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। নন-ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে উন্নয়ন বলতে ঐ দেশটিকে বুঝার একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তা হিসেবেই দেখা হয়। উন্নয়ন ঘটানোর একদম শুরুর দিকে সহিংসতা এবং শোষণের মতো যেসব ঘটনা ঘটে, তেমন অপ্রিয় ঘটনার স্মৃতিও পশ্চিমের আছে। একইসাথে উন্নয়ন এই বার্তাটিও প্রচার করে যে অনুন্নত সমাজগুলোকেও উন্নত হতে হলে এধরনের রক্তত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ষোলো ঘন্টা কাজ করে এসে নিজের মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা, দশ বছরেরও কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের কারখানাগুলোতে সারাদিন ধরে কাজ করা কিংবা চিমনি ধোয়ার মতো বিপজ্জনক পেশায় নিয়োজিত থাকা, ইংল্যান্ডে বন্দি আন্দোলন, নারী শ্রমিক এবং বেশ্যাদের জিন গলিতে ভীড় করে থাকা- এসকল স্মৃতি পশ্চিমাদের অবচেতন মনে আজও একটি অভিশাপ হিসেবে রয়ে গেছে, যা তাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয় যে পশ্চিমা সভ্যতা যদি অগ্রগতির উচ্চ থেকে উচ্চতর শিখরে পৌছানোর উচ্চাশা হারিয়ে ফেলে কিংবা সহিংসভাবে মুনাফা অর্জনের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে, তবে তারা আবারও সেই পুরোনো অভিশাপে ফিরে যেতে পারে। উন্নয়নকে ঘিরে যে বিশ্ব রাজনীতির খেলা চলছে তার ভেতরে অতঃপর এই দুশ্চিন্তাগুলোকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এজন্যই, বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে পশ্চিমারাই সর্বদা প্রথম অবস্থানে থাকে, বিশেষ করে যদি উক্ত সামরিক শাসক উন্নয়ন নামক প্রবাদ-বাক্যটি উচ্চারনে বিশেষ পারদর্শী হয়। এই জন্যই ইরানের শাহকে পশ্চিমাদের কাছে একজন অতি কঠোর স্কুলশিক্ষক বলে মনে হয়েছিলো, এবং ইদি আমিনকে মনে হয়েছিলো পাথরযুগের দানবের মতো। পূর্বের জনকে মনে করা হতো একজন পেশাদার উন্নয়নবাদী হিসেবে, যদিও তা ছিলো সম্পূর্ন ভুল অনুমান।

পরিশেষে, উন্নয়ন এক সম্প্রদায়কে আরেক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ধর্মীয়, আন্ত-অঞ্চলীয় এবং নৃতাত্ত্বিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়। এর অর্থ এই নয় যে এধরনের অস্থিরতা অতীতে ছিলো না কিংবা এসবই উন্নয়নের পরিকল্পনাকারীদের সৃষ্টি। এর মানে হচ্ছে প্রেরণার (passion) জায়গায় মুনাফা অর্জন করাকে, দূরদৃষ্টি এবং বিশ্বচিন্তার জায়গায় ব্যবহারিক যৌক্তিকতাকে (instrumental rationality) অগ্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমে উন্নয়ন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যকার মূল্যবান, বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত (multi-layered) সম্পর্কগুলোকে এক-কেন্দ্রিক(one-dimensional), সুবিধা-কেন্দ্রিক(interest-based) এবং প্রতিযোগিতামূলক (competitive) সম্পর্কে পরিণত করে। এবং উন্নয়ন এমন কিছু ক্ষেত্রে এই কাজটি করে যেখানে ইতোমধ্যে প্রচণ্ড পরিবেশগত পরিবর্তন(environmental changes) ঘটে গিয়েছে এবং এর মাধ্যমে উক্ত পরিবেশের সাথে জড়িত বিশেষ সম্প্রদায়গুলোর ঐতিহ্যবাহী, জীবন-রক্ষাকারী বিষয়গুলোতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। একবার এরকম কোনো রুপান্তর ঘটে গেলেই, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলোকে আধুনিক রাজনীতি এবং অর্থনীতির আওতায় নিয়ে আসা হয় এবং এই দুটোর অধীনেই সমস্যার সুরাহা করা হয়। এভাবে একসময় যা সংস্কৃতিগুলোর মধ্যকার জটিল মেলবন্ধন হিসেবে পরিচিত হতো তা একটা সময়ে গিয়ে বাস্তব, উন্নয়ন-সম্পর্কিত অর্জন লাভের (development-related gains)  নিষ্প্রান যুদ্ধে (hard-eyed battle) পর্যবসিত হয়। ফলাফল হিসেবে, উন্নয়ন সাধনের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা, উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে দেখভাল করা কিংবা সহিংসতা এবং বর্বরতার(primitivism) উপরে কড়া নজর রাখার ছলে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সর্বশেষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার জন্য রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হয়। তৃতীয় বিশ্বে এই মধ্যস্থতা করার কাজটি সর্বদাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা এবং স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার উন্মেষ ঘটানোর ছুতো কিংবা সমর্থন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।