আসছে জাতীয় নির্বাচন। দুঃখিত, জাতীয় নির্বাচন না বলে বলা ভাল, আসছে আওয়ামী নির্বাচন। আওয়ামী নির্বাচন কেন বলছি? আওয়ামীলীগের শাসনে নির্বাচন হচ্ছে, তাও শাসনটা যেনতেন না পুরাই পুলিশি শাসন। যে দল একসময় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করায় আস্থা পায়নি! এই নির্বাচনকে তাই আওয়ামী নির্বাচন আখ্যা দেওয়াটা জায়েজ বলেই মনে করছি। এখন প্রশ্ন আসে এই ‘আওয়ামী নির্বাচন’ কতটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে? ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ কতটুকু কার্যকর সে কথা না হয় ধানমন্ডি পার্টি অফিসেই থাকুক। আমরা ইতোমধ্যে মনোনয়নের নাটক দেখেছি এবং ‘কন্যার কাহিনী’ নামে সিনেমাও দেখছি এটা থেকেই নিরেপেক্ষতা যাচাই করা সম্ভব।
এই নির্বাচন কতটুকু কার পক্ষে, কার বিপক্ষে সে তর্কে পরে আসা যাক। প্রশ্ন হচ্ছে, আসছে নির্বাচন কতটুকু জনগণের পক্ষে? গণতন্ত্র বলে যে রাষ্ট্রের প্রকৃত রাজা জণগণ, এবং তাদের প্রতিনিধিই হবে রাষ্ট্র চালক। তবে বাংলাদেশের গত নির্বাচন (দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন), সেটা কি জনগণের নির্বাচন ছিল? মোটেই না, অথচ সেই নির্বাচনে জয়ী দলই আজকের সরকার! এবারের নির্বাচনকালীন সরকার! এবং এই সরকারই নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিবে বলে গলাবাজী করে চলেছে! আর নির্বাচন কমিশন? এই প্রতিষ্ঠানের কথা না বলাই শ্রেয়। তবুও একটু বলি, নির্বাচন কমিশন তখনই তার যোগ্যতা দিয়ে কাজ করতে পারে যখন তারা স্বাধীন হয়। আর বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ঠিক ততটাই স্বাধীন যতটা আমরা বর্তমান স্বাধীন এই বাংলাদেশে ! আমরা ততটুকুই বলি যতটা তারা বলতে দেয়, ততটুকুই শুনি যতটা তারা শুনতে দেয়, চেতনার চ্যানেল গুলো দিয়ে ততটুকুই দেখি যতটা তারা দেখতে দেয়। বলতে গেলে এবারের নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে স্বৈরশাসকের অধীনের একটি জনগণের গণতান্ত্রিক নির্বাচন! ‘স্বৈরশাসকের নির্বাচন হবে সুস্থ, নিরেপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য’- এই কথাটি আমি তখনই বিশ্বাস করতে পারি যখন একটি শেয়াল টানা তিনদিন নিষ্ঠার সাথে একটি মুরগি বর্গা রাখতে পারবে। আসলে নির্বাচন হবে। হবে না ভোট। জনগনের ভোটের দিকে এই সরকারের কোন মনযোগ নাই সব মনযোগ নির্বাচনকে নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার কাজে ব্যাবহারের দিকেই সব মনযোগ।
আসলে নির্বাচন হবে। ভোট হবে না । জনগনের ভোটের দিকে এই সরকারের কোন মনযোগ নাই সব মনযোগ নির্বাচনকে নিজেদের অবৈধ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার কাজে ব্যাবহারের দিকেই সব মনযোগ।
আমরা দেখেছি সরকারি দলের রাজপথ দখল করা মনোনয়ন উৎসব আর তাদের বিরোধী জোটের অন্যতম শরিক দল বিএনপির তথাকথিত সহিংস মনোনয়ন ক্রয় ও জমাদান পর্ব! খুবই হাস্যকর নয় কি? “আওয়ামী লীগ করলে লীলা খেলা বিএনপি করলে পাপ, কিছু কইলে কমিশনার সাহেবের মেজাজ খারাপ!” আমাদের জনতাকে কি উনারা এতটাই গর্দব মনে করেন? তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে প্রত্যেক ফ্যাসিস্ট সরকারই একটা সময় অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে জনগণকে বোকা ভাবতে শুরু করে। এবং সেটাই হয় ফ্যাসিস্ট পতনের ঐতিহাসিক কারণ। অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন আমার কথা, প্রশ্ন তুলতে পারেন যে আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা। উত্তরে বলব আমার একটাই মাথা আর আমারও প্রচণ্ড ভয় হয় গুম হওয়ার, খুন হওয়ার। এই জন্যেই আমি বুকে হাত দিয়ে বলব না এই সরকার ফ্যাসিস্ট সরকার নয় এরা ‘চেতনার’ গণতান্ত্রিক সরকার। তবে শুধু আম-জনতার কাছে এই প্রশ্ন করব, আদৌ কি এই সরকারের কাজ গণতান্ত্রিক? বা এই সরকার কি বিগত পাঁচ বছর নিজেদেরকে ফ্যাসিস্ট প্রমাণ করার যথেষ্ট যুক্তি উপস্থাপন করে নাই? আর কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মত জননন্দিত আন্দোলনগুলোর সময় সরকারে অবস্থান তাহলে কি প্রমান করে? এই হেলমেট বাহিনী কার?
এতক্ষণ খুবই সাদামাটা কিছু প্রশ্ন করেছি। আমার মত সাধারণ একজন নাগরিকের মনে ঠিক যে রকম প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায়। এখন নির্বাচনে পরিস্থিতি কতটা কার দিকে সেটা একটু যাচাই করা যাক। নির্বাচন কমিশন গত সপ্তাহেই ঘোষণা দিয়েছে সকল নির্বাচনী ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার সরিয়ে নিতে কিন্তু এখনো আমরা পথে, ঘাটে, মাঠে, বাজারে ব্যানার আর ফেস্টুনে নৌকা ভাসতে দেখছি। এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যখন তাদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের কথা একটিবার চিন্তা করে ঠিক তখনই কমিশনের আরপিও আর নিতিমালার কথা মনে পড়ে! আমরা জনগণ কি কিছু বুঝিনা? যেখানে নৌকার পোস্টার ব্যানারে ছেয়ে যায় আর ধানের একটা শীষও দেখা যায় না কোথাও তখনই তো মানুষ বুঝে যে ফিল্ড কতটা লেভেল প্লেইং।
যশোরের কেশবপুর বিএনপি এর সহসভাপতি প্রথমে অপহৃত এবং পরে খুন হন। তিনি ছিলেন কেশবপুর থেকে ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তার লাশ পাওয়া যায় বুড়িগঙ্গায়! কি? চিত্র কি কিছুটা মিলছে? কখন লাশ ভাসতে দেখা যেত, সেটা কি আমাদের মনে নাই? হ্যাঁ, সেই একাত্তরে। কাক আর শকুনের খুবলে খাওয়া লাশ তখনও ভাসতে দেখা যেত। সেই একাত্তরের লাশ আর এখনকার লাশের মধ্যে পার্থক্য শুধু একটাই, এখনকার লাশ কাক-শকুনে খুবলে খায় না, তারা খাওয়ার আগেই লাশ উদ্ধার হয় আর সরকার দলের মন্ত্রী/সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দেন এই হত্যার কারন আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব! বাহ কি সুন্দর সমাধান
আমি যখন আমার এই লেখাটা লিখছি তার ঠিক দুরাত আগেই যশোরের কেশবপুর বিএনপির সহসভাপতি প্রথমে অপহৃত এবং পরে খুন হন। তিনি ছিলেন কেশবপুর থেকে ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তার লাশ পাওয়া যায় বুড়িগঙ্গায়! কি? চিত্র কি কিছুটা মিলছে? কখন লাশ ভাসতে দেখা যেত, সেটা কি আমাদের মনে নাই? হ্যাঁ, সেই একাত্তরে। কাক আর শকুনের খুবলে খাওয়া লাশ তখনও ভাসতে দেখা যেত। সেই একাত্তরের লাশ আর এখনকার লাশের মধ্যে পার্থক্য শুধু একটাই, এখনকার লাশ কাক-শকুনে খুবলে খায় না, তারা খাওয়ার আগেই লাশ উদ্ধার হয় আর সরকার দলের মন্ত্রী/সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দেন এই হত্যার কারন আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব! বাহ কি সুন্দর সমাধান। মানুষ মরুক, লাশ ভাসুক তদন্ত প্রতিবেদনে ফল একটাই-‘আভ্যন্তরীন কোন্দল’! আমার কথা, এত সহজেই যদি উপসংহার টানা যায় তাহলে এত বছরেও সাগর-রুনি, তনু হত্যার তদন্ত শেষ হল না কেন? আচ্ছা সে কথা থাক। এবার আসি নরসিংদীতে আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহতদের কথায়। কই একবারোতো ওবায়দুল কাদের সাহেব এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বললেন না। তাহলে কি এই হত্যা, লাশ, গুম সবকিছুকে এই সরকার নির্বাচনী উৎসবের অংশ হিসেবেই ভাবছে? ভাবতেই পারে। বিনা লহু মেহেফিল কি জমে! এটা তো রাজনীতি। মানুষ মরুক, রক্ত ঝরুক তাল গাছটা তাদের হলেই গণতন্ত্র টিকবে বলেই ভাবছেন তারা।
অনেক গুনগান তো গেলাম। এবার সাফ কিছু কথা না বললেই নয়। কিছুদিন আগেও সাধারণ মানুষের মুখেই শোনা যেত, “যে করেই হোক এই সরকার আবারো ক্ষমতা নিবে”, “ভোট কি আর দেওয়া হবে, তার আগেই ব্যালট ভরা সারা হয়ে যাবে!”। কিন্তু নির্বাচন আসছে, দিন যত ঘনিয়ে আসছে মানুষের মনে আশার সঞ্চারণ ততই বাড়ছে। খুবই ইতিবাচক বাতাস বইতে শুরু করেছে দেশে। এই সময়েও যদি ক্ষমতাসীনেরা ভেবে বসে থাকে নির্বাচন আবারো তাদের মত করেই করবে তবে সেটা হবে তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। শুধু ভুল না ইতিহাসের কাছেও দায়ী থাকবে তারা। কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মত আন্দোলনগুলোকে যারা স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে পণ্ড করেছে তাদেরকে এ যুগের তরুনেরা মোটেও বিশ্বাস করে না, যতই “লেটস টক/মিষ্টি” বুলি আওরান হোক না কেনো তারা এই ফ্যাসিস্টদের বিশ্বাস করবেও না। তাই আমার মত নগন্য একজন ক্ষমতাসীনদের একটাই উপদেশ দিতে চাই “সাধু সাবধান! জনগণকে ক্ষেপাবেন না।“ আর এই কথা যদি আমার মত নগণ্য একটা মানুষও বুঝে তাহলে সেই ক্ষমতাসীনরা কেনো বুঝবে না?