সাগরিকার মাইন ফিল্ডে ক্ষতবিক্ষত উইন্ডিজ!

সাগরিকার মাইন ফিল্ডে ক্ষতবিক্ষত উইন্ডিজ!

শিরোনাম দেখে ঘাবড়ানোর কিস্সু নাই। আচমকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েনি, সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে ক্যারাবিয়ানরাও বাংলাদেশে যুদ্ধ করতে আসেনি। তবে, সাগরিকায় পিচ নামে যে জায়গায় খেলা হলো তাকে মাইনফিল্ড বৈ কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। এটাকে অবশ্যি অন্যভাবেই দেখা যায়।

চাইলে আপনি এটি কিপার এবং ব্যাটসম্যানের যুগল নৃত্যের অনুপম মঞ্চ বলেও মনে করতে পারেন। যদিও এইরুপ কলা প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমিসহ নানা স্থাপনা রয়েছে, তারপরও বিসিবি উন্মুক্ত মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শনের জন্য যে খোলা ময়দানের বন্দোবস্ত করেছে, সেটিকেও বাহবা দিতে পারেন। শুরু থেকে ঘোরা বল আজকের দিনে যেভাবে ঘুরছিল, আর ব্যাটসম্যান কিপার যেসব বিচিত্র ভঙ্গিমার জনম দিচ্ছিলেন, তা আমার কাছে নৃত্যই মনে হয়েছে।

অনেকেই অবশ্য এ জয়ের আগে ঐতিহাসিক শব্দটি যোগ করবেন। আত্মশ্লাঘায় ভুগবেন প্রতিশোধ নিতে পারার আনন্দে। তা যে কেউ করতেই পারেন, মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা তো আমাদের আছেই! আমি অন্তত এ জয় নিয়ে আত্মশ্লাঘার কিছু দেখছি না। পয়লা দিনই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম যে ম্যাচটি পাঁচ দিনে গড়াবে কি না? পাঁচ দিনের আধ্ধেক, অর্থাৎ আড়াই দিনেই ম্যাচ শেষ করে দিয়ে আমার আস্থার প্রতিদান দিয়েছে ক্রিকেটাররা। মারহাবা!

নাঈমের পাঁচ উইকেট, সাকিবের দ্রুততম সময়ে ৩০০০ রান এবং ২০০ উইকেট, প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে ২০০ উইকেট, মুমিনুলের বছরের চতুর্থ এবং ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরি কিংবা শেষ ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়ে তাইজুলের এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের হয়ে সার্বাধিক উইকেট, কবুল করছি অর্জন ব্যাপক। কিন্তু যেভাবে এসেছে তা কি সত্যই গর্ব করার মতন?

ইদানিং টেস্ট দেখলে গাঁয়ের কথা মনে পরে। অদ্ভুত শোনালেও সত্য। আগে এক গাঁয়ের সাথে আরেক গাঁয়ের রেশারেশি থাকলে, প্রায় বলতে শোনা যেত, পারলে আমাদের গাঁয়ে আসিস, দেখায় দিবানি! টেস্টের হালতও এখন অনেকটা ঐরকমই। নিজ নিজ দেশে খেলা পড়0লেই সবাই সবাইকে দেখায়ে দিচ্ছে! যদিও এই কাজ করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা ইংল্যান্ড এর হাতে কষে চপোটাঘাত খেয়েছে। তবে, সবকিছু দেখে মনে হয় এ অবস্থায় ক্রিকেটের কি হালত হচ্ছে তা ভাবতে বয়েই গিয়েছে যেন আইসিসির।

এই টেস্ট থেকে ইতিবাচক যদি কিছু নেয়ার থাকে, সেটি নিতে পারে আইসিসি এবং মোস্তাফিজ! বিস্ময়করই ঠেকছে? পরিষ্কার করেই বলি। টেস্টে ম্যাচের সময়কাল নিয়ে বহুদিন ধরেই চিন্তিত আইসিসি। যার ফলে নিত্য নতুন আইনের দেখাও মিলছে হর হামেশা। মাঝে তো আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়েকে দিয়ে চারদিনের একটি টেস্ট খেলিয়েও পরীক্ষা করা হয়েছিল। এ ম্যাচটা যদি আইসিসির কর্তারা দেখে থাকেন নতুন করে আশার আলো দেখতেই পারেন তারা। শুধু এই টেস্টই না, নিকট অতীতে বাংলাদেশের যে কয়টা টেস্ট ঘরের মাটিতে ফল দেখেছে তার কয়টি পুরো পাঁচ দিন খেলা হয়েছে তা গবেষণার দাবি রাখে। সুতরাং, টেস্টকে কি করে টিটোয়েন্টিতে রূপান্তরিত করা যায় তার সালাহ দেবার বাংলাদেশের চেয়ে যোগ্য কেউ এই মুহূর্তে কায়ানাতেই নেই।

এটি বাণিজ্য প্রবণ আইসিসিকে আশান্বিত করতেই পারে। এবার আসি মোস্তাফিজে। পুরো ম্যাচে আদমি বল করেছেন সবে চার ওভার। খেলতে হয়নি দশটি বলও। এইটুকু অবদান  রেখে পুরো ম্যাচ ফি পকেটে ভরেছেন তিনি। পুরো কায়ানাতে এমন ভাগ্যবান আদমি বিরল। নজরে আনতে পারেন খেলার ধরণও, ইমরুল-সৌম্যরা যেভাবে ব্যাট চালিয়েছেন তাতে আড়াই দিনে ম্যাচ শেষ হওয়া টিকে কাকতাল বলে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন টস ভাগ্য বিরুপ হলে হালত কি হতো, সেটা নিয়ে ভাবতেও ভয় করছে।

অনেকেই বাংলাদেশ জেতার পরেও আমার এহেন আলোচনাকে অংহ বলে বিবেচনা করতে পারেন। দেখুন, আমি অন্যভাবেই বরং ব্যাখ্যা দেই। আপনি যে কোনো মাদকাসক্তর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুণ, সে জানাবে মাদক নেবার হেতু অন্তহীন কষ্ট। আর মাদক তাকে সে কষ্ট ভুলে থাকতে সাহায্য করে। এখন আপনি যদি, মাদকের কুফল না জানেন তাহলে তার এই বাতকে বিনা বাক্যব্যয়েই সমর্থন করবেন তার কষ্টে সমব্যাথী হয়ে। যদি জেনে থাকেন, তাহলে তার সে সাময়িক কষ্ট ভোলার মাধ্যম যে চিরস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াবে, সেটি তাকে না জানানোর অপরাধে আপনিও অপরাধী হবেন।

গণমাধ্যমের কিছু দায় রয়েছে। জিতেছে বলে বাহ্বা দেয়াতেই এটি শেষ হয়ে যায় না। তিনদিনের মাইন ফিল্ড বানিয়ে টস ভাগ্যকে কাজে লাগিয়ে ম্যাচ জয় আপাত দৃষ্টিতে স্বস্তির কারণ হতে পারে বটে, তবে তা দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্ষতির কারণ হবে এটি লিখে রাখতে পারেন। ক্রিকেট যদি বাঁচাতেই হয়, আজ অথবা কাল আইসিসির ঘুম থেকে জাগতেই হবে। ঘুমই বা বলছি কেন? ভঙ থেকে বের হয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। আর তখন যদি সত্যিকার ক্রিকেট খেলতে হয়, আমরা উড়ে যাব খড়কূটার মত। আফ্রিকা সিরিজেই যেটি দেখেছিলাম। আফ্রিকা নিজেদের ঘরের ফায়দা নেবার বদলে খেলেছিল নিরেট ফ্লাট উইকেটে। সেখানে যেরকম খেলেছি আমরা তা না হয় আরো একবার স্মরণ করে শরম না দেই।

যাই হোক, সামনের টেস্টটায় টেস্ট দেখার মনোবাসনা নিয়েই প্রহর গুনব। যদিও সেটির আলো দেখার সম্ভাবনা সামান্যই। তবু, বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করে বিসিবির সবাই অন্তত বেবোধ হয়নি। কেউ একজন অন্তত আছেন যিনি এইটুকু অনুধাবন করতে পারবেন যে, এমন জয়ে প্রাপ্তির বদলে আখেরে নিজের কবর নিজেরই খোড়া হচ্ছে। তবে, বোলারদেরও প্রাপ্য কৃতিত্ব দিতে কসুর করবো না। হোক মাইন ফিল্ড। ঠিক জায়গায় বল তো তারা রেখেছে। যাই হোক, একদম অভিনন্দন না দেখালেও সেটি দৃষ্টিকটূ দেখায়। তাই অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশ দলকে, মাইন ফিল্ডের যুদ্ধে ক্যারাবিয়ানদের পরাজিত করার গৌরব! অর্জন করার জন্য।