বার্সা নিয়ে লিখতে গেলে একটি বিষয় ইয়াদে রাখা অপরিহার্য। যেটি রিয়ালের ক্ষেত্রেও খাটে। ইউরোপের বেশিভাগ ক্লাবই নিজ অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে, আলাদা কোনো জাতীয়তাবাদের না। বাক্যটা একটু খেয়াল করার অনুরোধ রাখছি। বার্সা কাতালান প্রদেশেরই না শুধু সম্পূর্ণ আলাদা একটি জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করে। কাতালানরা এখনো স্পেনের অংশ হলেও বহুবার তারা আলাদা হবার প্রচেষ্টা চালিয়েছে, বার কয়েক সফল হয়ে চলেও গিয়েছে। সুতরাং, মাদ্রিদের সাথে দ্বৈরথটা শুধু ফুটবলীয় না হয়ে যায় দুটো জাতীয়তাবাদের লড়াইও। কারণ, রিয়াল প্রতিধিত্ব করে স্পেনের রাজ পরিবারের; যারা বিশ্বাস করে স্পেনের অখণ্ডতায়। এটি সম্পূর্ণ আলাদা একটি আলোচনা, স্বল্প পরিসরে যা নিয়ে কথা বলাটা দুরুহ। তবু, বিষয়টি টেনে আনলাম কারণ, টিকিটাকা দর্শনের সাথে গার্দিওলা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন কাতালান জাতীয়তাবাদও। যেটি নিয়ে পিকের প্রকাশ্য অবস্থান বিস্তর আলোচনা-সমালোচনার জনম দিয়েছে। সম্প্রতি ইকার ক্যাসিয়াসের একটি সাক্ষাৎকারে যেটি আরো স্পষ্ট হয়েছে।
যাই হোক মূল আলোচনায় ফিরি। পেপের প্রস্থান নিশ্চিত হবার সাথে সাথে নতুন ম্যানেজার হিসাবে পেপের সহকারি টিটো ভিলানোভার নাম ঘোষনা করে বার্সা কতৃপক্ষ। ইঙ্গিত খুবই পরিষ্কার; আদমি বদল হলেও আদর্শে বদল আসবে না। ভিলানোভার মেয়াদকালটা আলোচনার বাইরে রাখতে চাই কারণ, পুরো সুস্থ অবস্থায় তিনি ডাগ আউট সামলাতে পেরেছেন খুব কম সময়ই। মরণব্যাধি ক্যান্সার শরীরে বাসা বাধায় অকালেই ওপারে পারি জমান তিনি। তবে, যতটুকু সময় ছিলেন এইটুকু সাবিদ করে দিয়ে গিয়েছিলেন যে যোগ্য আদমির হাতেই দলটা তুলে দিয়েছিল বার্সা।
টিটোর বিদায়ের পরবর্তী নিয়োগটাই এ সময়কালের মধ্যে বার্সার সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ। ঠিক কোন যোগ্যতায় টাটা মার্টিনেজ বার্সেলোনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তা আজো ধাঁধাঁর মতই ধোয়াশা পূর্ণ ঠেকে আমার কাছে। যাই হোক, তাকে নিয়োগ দেয়াটা যে ভুল ছিল সেটা তিনি নিজেই নিখুঁত কর্ম তৎপরতার সাথে দেখিয়ে গিয়েছেন।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, বার্সা যেমন ভুল করে খেসারত দিয়েছে তেমনি তা অনুধাবনে সময় নিয়েছে খুবই সামান্য। যার ফলে উড়তে থাকা বার্সাকে ডোবানোর সমস্ত বন্দোবস্ত টাটা করলেও তা বার্সা সামলে নিয়েছে খুবই দ্রুত। টাটাকে টাটা জানানোর পর বার্সা পুনরায় ঝুঁকে পরে বার্সার দর্শনের সাথে পরিচিত এমন মুখের দিকে। ডাগ আউটে আসেন লুইস এনরিকে। রিয়াল-বার্সা দু’দলের জার্সি গায়েই খেলার অভিজ্ঞতা থাকলেও এনরিকে মূলত পরিচিত বার্সার হিসাবেই। তিনি দায়িত্ব নিয়ে টিকিটাকাকে দিলেন নতুন রুপ। পজিশনিং ফুটবলের ধরণ না বদলালেও তিনি জোড় দিলেন গতির ওপর। যার ফলে আরো দৃষ্টি নন্দন হয়ে ওঠে বার্সার খেলা। একই সাথে মেসি, সুয়ারেজ এবং নেইমারকে নিয়ে গড়ে তোলেন ইউরোপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণ জুটি। এনরিকের টাটায় বিধ্বস্ত বার্সার ত্রাতা রুপেই শুধু হাজির হননি, বার্সাকে আবারো অদম্য রুপ দেন তিনি।
তবে, এনরিকের একটি ব্যর্থতা তাকে ক্যাম্প ন্যু ছাড়তে বাধ্য করে। স্পেনে একাধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হলেও ইউরোপে বার্সার একাধিপত্য ধরে রাখতে পারেননি তিনি। বরং, জিদানে সাওয়ার হয়ে ইউরোপের একছত্র আধিপত্য কায়েমে কামিয়াব হয়েছে রিয়াল। যার ফলে এনরিকেও বিদায়ে বাধ্য হলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন বর্তমান কোচ ভালভার্দে। তিনিও বার্সার সাবেক।
ইতিহাসের অনেকটা পথ আমরা হাটলাম। এখন আরো একবার সময় এসেছে একটু পিছনে ফেরার। সময়ের হিসাবে প্রায় এক দশকের বেশি সময়ের পথ পরিক্রমা আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এ সময়কালটা ভালোমত লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, যার হাত ধরে বার্সার উত্থান পর্বের শুরু সে রাইকার্ড এবং টাটা বাদ দিলে যাদেরকেই বার্সা কোচ হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে প্রত্যেকেই বার্সার দর্শনের সাথে সম্পূর্ণ রুপে পরিচিত। হ্যা, রাইকার্ড হয়ত ক্রুইফের দর্শন অনুসরণ করেননি কিন্তু মূল দলের সাথে লা মেসিয়ার ক্যাডেটদের; যারা পরবর্তীতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যকার সেতু বন্ধনের রচয়িতা তিনিই। অতএব, এটা খুবই স্পষ্ট যে, কোন নিয়োগের ক্ষেত্রে বার্সা ম্যানেজমেন্ট স্থিরতার পরিচয় দিয়েছে। একজনের স্থলে আরেকজন আসলেও তিনি পুরো দলকে ঢেলে সাজাননি; যেটা করেছেন সেটাকে ফাইন টিউনিং বলা যায়। সেখানে রিয়ালের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। একাধিক হাই প্রোফাইল কোচ আনলেও প্রত্যেকের দর্শন আলাদা হওয়ায় রিয়ালকে বারবার শুরু করতে হয়েছে শূন্য থেকে।
কোচের সাথে সাথে এ সময়কালে মূল অধিকর্তার পদেও পরিবর্তন এসেছে একাধিকবার। এখানে যেটি হয়েছে, তারা কেউই মূল দর্শন থেকে না সরলেও ট্রান্সফার পলিসির বদলটা চোখে লাগার মত। আগের আলোচনাতেই বলেছি রাইকার্ড-লাপোর্তে জুটি তারকার বদলে আগ্রহী ছিলেন কার্যকর খেলোয়াড় দলভুক্ত করায়। সান্দ্রো রাসেল এবং পেপের সময়ে যেটির পরিবর্তন ঘটে। এটি আরো বদলেছে বর্তমানে। ইদানিং বার্সার ট্রান্সফার পলিসিতে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষনীয়। যেমন, ডেম্বেলেকে যে দামে বার্সা দলে ভিড়িয়েছে সেটি আসলেই তার প্রাপ্য কি না সে প্রশ্ন যেমন উঠে, তেমনি তিনি বার্সার জন্যও উপযুক্ত কি না সেটিও জওয়াবের দাবি রাখে। বিশাল অঙ্ক খরচ করতে দেখা গিয়েছে কৌতিনহোর বেলায়ও। এ নিয়ে তিক্ততার কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
দিনহো বার্সার উত্থানের নিউক্লিয়াস হলেও তার বিদায়ে বার্সাকে অস্থির হতে দেখা যায়নি। কারণ, তার আগেই বার্সা তার বিকল্প হিসাবে তৈয়ার করে নিয়েছিল মেসিকে। এই প্রবণতা এখন দেখা যায় না। বরং, রিয়ালের মতন অনেকটাই আত্মঘাতী এক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এখন। যেমন, নেইমারের বিদায়ের পরই কৌতিনহোকে পেতে বার্সা যে পথে হেটেছে সেটা ঠিক রিয়ালের মতনই। পুয়োলের বিকল্প হিসাবেও যখন যাকে মনে ধরছে তাকে বেশ বড় অঙ্কেই দলে ভেড়ানোর দৃশ্যও চোখে লাগার মত। যদিও, এখনো কেউই সেই জায়গাটি সে অর্থে নিতে পারেননি, পারেননি পুয়োলের অভাব পূরণ করতে। এবং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বার্সাকেও দেখা যাচ্ছে না নিজেদের অস্ত্র নিজেদেরই তৈয়ার করায় ব্রতী হতে। এখানে বার্সার চরিত্র শুরুর বার্সার সাথে মিলে না।
এ সময়কালটার মধ্যে বার্সা ম্যানেজমেন্ট এর আরো একটি দূর্বলতা বেশ দৃষ্টিকটূ ঠেকেছে। অনেক খেলোয়াড়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের পরের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই তিক্ত। যা সংবাদমাধ্যমে জোগান দিয়েছে মুখোরোচরক সব খবরের। নেইমার প্রসঙ্গই এর সবচেয়ে বড় উদাহারণ হতে পারে। এছাড়া আবিদাল যে অভিযোগটা করেছিলেন সেটিও ভাবমূর্তির জন্য নেতিবাচক। তবে এখানে এটিও খেয়াল রাখার বিষয় যে, যখন আপনি আলোচনার শীর্ষ ক্রমে অবস্থান করবেন তখন সবকিছুই সহীহ রাস্তায় চালানো কঠিন। ভুল ঘটা স্বাভাবিক।
পুরো সময়কালটা পর্যালোচনা করে দেখলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দশকের বেশি সময় ধরে ফুটবল বিশ্বে বার্সা রাজ করতে সক্ষম হয়েছে নির্দিষ্ট একটি আদর্শ এবং দর্শন আকড়ে থাকার ফলে। এটি থেকে বাকি দলগুলোরও শিক্ষা নেবার রয়েছে। সব সময় ফল অনুকূলে না আসলেও নিজস্ব দর্শন আকড়ে থাকাট বার্সার সাফল্যের মূল কারণ বলে আমার বিশ্বাস। আর এখানেই বারবার মার খেয়েছে মাদ্রিদ। তারা এখনো কাস্তিয়া বা মূল দলের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দর্শন খুঁজে বার করতে পারেনি। যার ফলে অধিকর্তা বা কোচ বদলের সাথে সাথে বদলে যায় রিয়াল।
অনেক প্রসঙ্গই হয়ত বাদ পড়েছে। তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পুরো একটা দশক পর্যালোচনা করার জন্য তিনটি পর্ব খুবই কম। তবু, চেষ্টা করেছি যতটা নির্মোহ ভাবে সম্ভব সময়কালটা তুলে ধরার। এ বিষয়ে আমিও জ্ঞাত যে, অনেক বিতর্কিত বিষয় আমি এড়িয়ে গিয়েছি। মূল বিষয়ে সাথে সেগুলো আমার প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি বলেই তার জিকরের জিকির তুলিনি। তবে, একটা বিষয়ে আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেই এই ধারাবাহিকের ইতি টানব। বার্সার সাফল্যের মূল হিসাবে যে দর্শনের কথা একাধিকবার উল্লেখ করেছি তা থেকে বার্সা না সরলেও ট্রান্সফার পলিসির যে বিশাল পরিবর্তন সেটি বার্সাকে ভোগাতে পারে।
পড়ুন : সাদা চোখে বার্সার উত্থান-পতন : রাইকার্ড থেকে ভালভার্দে -পর্ব ২