“তুম বিলকুল হাম জ্যায়সে নিকলে!” অশুভ সাম্প্রদায়িকতার নিরিখে যে ভারত এবং পাকিস্তান সমগোত্রীয়, নির্ভয়ে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন তিনি। রাষ্ট্রশক্তির নিকট নতশির হওয়া তার ধাতে ছিল না। অকুতোভয় ব্যক্তিত্বময়ী এই লেখিকা শানিত ভাষায় লেখার অপরাধে বাধ্য হয়েছিলেন দেশ ছাড়তেও! প্রগতিশীল লেখিকা, কবি এবং মানবাধিকার কর্মী ফাহমিদা রিয়াজ এই জগত থেকে চিরতরে না-ফেরার জগতে চলে গেলেন! বিগত কয়েক মাস তিনি রোগ-জর্জরিত ছিলেন। লাহোরের এক বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়, সেখানে ২১ নভেম্বর, বুধবার রাত্রে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে লেখিকার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
ব্রিটিশ শাসনাধীন উত্তরপ্রদেশ জেলার মীরাটে ১৯৪৬ সালের ২৮ জুলাই এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ফাহমিদা রিয়াজ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রিয়াজ-উদ-দিন ছিলেন আদর্শ শিক্ষাব্রতী। কর্মসূত্রে তিনি তৎকালীন সিন্ধ প্রদেশে বদলি হয়ে চলে গিয়ে পাকিস্তানের হায়দরাবাদে সপরিবার বসবাস শুরু করেন। সিন্ধ প্রদেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান অনস্বীকার্য। ফাহমিদার চার বছর বয়সে তার পিতা প্রয়াত হন। পরবর্তীকালে মাতা হুসনা বেগমের কাছে লালিত হওয়ার সময়ে অল্প বয়স থেকে অধ্যয়ন করতেন উর্দু এবং সিন্ধ সাহিত্য, শিখেছিলেন পার্সি ভাষা। পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার পর তিনি ‘রেডিও পাকিস্তান’-এ কর্মজীবন শুরু করেন।
স্নাতক সম্পূর্ণ হওয়ার পর পারিবারিক চাপে তিনি বিবাহ করতে বাধ্য হন। স্বামীর সঙ্গে সংযুক্ত আমেরিকায় থাকাকালীন ‘বিবিসি উর্দু সার্ভিস’ (রেডিও) সংস্থায় কাজ করতেন, পাশাপাশি তিনি ডিগ্রি অর্জন করেন চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে। প্রথম স্বামীর থেকে ডিভোর্স নিয়ে তিনি পাকিস্তান ফিরে আসেন এবং করাচি শহরে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় যুক্ত হন। তারপর তিনি ‘আওয়াজ’ নামে প্রকাশনী খুলে পালাবদল শুরু করেন পাকিস্তান প্রকাশনা জগতের। এই সময়কালে জাফর আলি উজান নামে এক বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়, পরে দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফাহমিদার প্রথম পক্ষের একটি কন্যা বর্তমান, দ্বিতীয় পক্ষে দু’টি পুত্রের মধ্যে একজন কবীর ২০০৭ সালে সাতার কাটতে গিয়ে ডুবে মারা যায়।
ফাহমিদার ১৫ বছর বয়সে আহমেদ নাদিম কাশেমী সম্পাদিত ‘ফুনুন’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত কবিতা প্রশংসিত হয়। ১৯৬৭ সালে ফাহমিদা রচিত কবিতা সংকলন ‘পাথার কি জুবান’ গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘বাদান দারিদা’ কাব্যগ্রন্থ অশ্লীলতা এবং শরীরী-ভাষা প্রয়োগের অভিযোগে কট্টরপন্থী সমাজ দ্বারা আক্রান্ত হয়। উল্লেখিত কাব্যগ্রন্থে ব্যবহৃত শব্দাবলি সেই সময়ের পাকিস্তানে ট্যাবু হিসাবে গণ্য হত। লেখিকা হিসাবে তিনি যেমন প্রাচীনপন্থী সমাজে নিন্দিত হয়েছেন, তেমন আধুনিকমনস্ক সমাজে ততোধিক বন্দিত হয়েছেন।
ফাহমিদা রিয়াজ রচিত গল্প, কবিতায় বৈপ্লবিক এবং নারীবাদী দৃষ্টিকোণ লক্ষনীয়। পাকিস্তানের বৃহত্তর মেধাজীবী-সমাজ তাকে ‘নারীবাদী আন্দোলনের অগ্রদূত’ গণ্য করে। তিনি অল্প বয়স থেকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। আশির দশকের শুরুতে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া-উল হকের বিরুদ্ধে তার প্রকাশনী ‘আওয়াজ’ আপসহীন, প্রতিবাদী আওয়াজ তোলে। যথারীতি স্বৈরাচারী শাসকের বিরাগভাজন হন তিনি। দেশদ্রোহ, রচনায় অশ্লীল শব্দচয়ন ইত্যাদি একগুচ্ছ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দশটিরও বেশি মামলা রুজু হয়, স্বামী-সহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন পাওয়ার পর তার কবিবন্ধু ভারতীয় লেখিকা অমৃতা প্রীতম তাকে ভারতে বসবাস করার পরামর্শ দেন। সেই মর্মে অমৃতা তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট সুপারিশ করে তার ভারতে থাকার ব্যবস্থা করেন। দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে ফাহমিদা দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিশুপুত্র এবং বোনকে নিয়ে সংসার পাতেন, পরে জামিন পেয়ে চলে আসেন তার স্বামীও। দীর্ঘ ছয় বছর ভারতে ছিলেন এই বিতর্কিত লেখিকা, তখনই তিনি হিন্দি ভাষা শেখেন। নির্বাসন-পর্ব শেষ হওয়ার পর তিনি ফিরে যান পাকিস্তানে; ১৯৮৮-১৯৯০ সময়কালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সরকারে জাতীয় পুস্তক পরিষদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। বেনজির ভুট্টোর দ্বিতীয়বারের মন্ত্রিসভায় তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি মুখ্য সম্পাদক ছিলেন ২০০৯, উর্দু অভিধান পর্ষদের।
লেখিকা পরিচয়েই তিনি সর্বাধিক স্মরণীয়। গল্প, কবিতা সংকলন মিলিয়ে তিনি পনেরোটি গ্রন্থের রচয়িতা। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘ধূপ’, ‘গুলাবি কবুতর’, ‘আদমি কি জিন্দেগী’, ‘আধুরা আদমি’ ইত্যাদি। আল মুফতাহ, সিতারা-এ-ইমতিয়াজ এবং আরও কিছু পুরস্কারে তাকে সম্মানিত করা হয়েছে।