সাদা চোখে বার্সার উত্থান-পতন : রাইকার্ড থেকে ভালভার্দে -পর্ব ১

সাদা চোখে বার্সার উত্থান-পতন : রাইকার্ড থেকে ভালভার্দে -পর্ব ১

গত কিছুদিন আগে অল হোয়াইটস অধিকর্তা ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে নিয়ে দু’পর্বের একটা লেখা লিখেছিলাম। সেখানে পেরেজের ভুলগুলোর সাথে প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে এসেছিল বার্সার নাম। যদিও বিষয়ের কারণে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ সেবার ছিল না। কিন্তু, শুধু পেরেজের জন্যই না; বর্তমান বাস্তবতায় বার্সেলোনার সাফল্যের পথ পরিক্রমা আলাদা আলোচনার দাবি রাখে।

আমি আমার আলোচনার কাল হিসাবে রাইকার্ডের সময় থেকে বর্তমান সময়টুকুকে বেছে নিয়েছি। এ সময়কালটায় বার্সার সাফল্য, একাধিপত্য কায়েমের কায়দা, ট্রান্সফার পলিসি প্রাসঙ্গিকভাবেই স্থান পাবে। আলোকপাত করবো কিছু বিতর্কিত বিষয়েও। তবে, মূল আলোচনায় যাবার আগে আমি একটু পিছন থেকে শুরু করব; স্পষ্ট করে বললে ১৯৭৮ সাল থেকে।

১৯৭৮ সালটা আলোচনা শুরুর জন্য বেছে নেবার কারণ বার্সার বার্সা হয়ে উঠার পিছনের যে মূল ভূমিকা; লা মেসিয়া, সেটিকে যিনি পূর্ণাঙ্গ রুপ দিয়েছিলেন সে জোসেফ লুইজ নুনেজ ১৯৭৮ সালেই প্রথম নির্বাচিত সভাপতি হিসাবে বার্সেলোনার দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নিয়ে দূরদর্শি এই আদমি এমন একটি একাডেমির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন যা থেকে উঠে আসা ক্যাডেটরা বার্সার দর্শন, ধরনের সাথে শুরু থেকেই পরিচিত হয়ে উঠবে। ১৯৭৯ সালে ১৭০২ নির্মিত একটি বাড়িতে শুরু হয় লা মেসিয়ার কার্যক্রম। নিজের ২২ বছরের মেয়াদকালে তিনি যেটিকে পরিণত করেছেন বিশ্বের অন্যতম আধুনিক এবং সফল এক একাডেমিতে।

খেলোয়াড় হিসাবে কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ পুণরায় বার্সায় ফিরেন কোচ হিসাবে নুনেজের জামানায়ই। তিনি শুধু মূল দলেই না, লা মেসিয়াতেও তার দর্শন ছড়িয়ে দিতে সমর্থ্য হয়েছিলেন। বার্সার প্রথম ড্রিম টিমের জন্ম ক্রুইফের হাত ধরে জন্মালেও সেটির আধিপত্যকাল খুব একটা বেশি সময়ের না হওয়ায় সে সময়টা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না, তবে এ সময়টার জিকরেরও হেতু রয়েছে। প্রথমত, এ সময়কালে ক্রুইফের ফুটবল দর্শনই হয়ে উঠে বার্সার মূল দর্শন। এবং, তার সময়কাল থেকেই লা মেসিয়ার গ্র্যাজুয়েটরা বার্সার মূল দলের অংশ হতে শুরু করেন। তারকা এবং লা মেসিয়ার গ্রাজুয়েটদের সমন্বয়; যেটি ক্রুইফ পয়লাবার একত্রিত করেন সেটিই পরবর্তিতে হয়ে ওঠে অদম্য বার্সার মূল ।

এবার মূল আলোচনায় যাওয়া যাক। নব্বইয়ের শেষার্ধে পেরেজ আত্মপ্রকাশের পূর্বে রিয়াল যখন সোনালি সময় কাটাচ্ছে তখন, স্পষ্ট করে বললে ২০০০ থেকে শুরু করে রাইকার্ড দলের কতৃত্ব নেবার পূর্ব পর্যন্ত বেশ একটা অস্থির সময়ই পার করেছে বার্সা। উল্লেখ্য যে, ডাগ আউটের সাথে সাথে ততদিনে বার্সার অধিকর্তার পদেও পরিবর্তন এসেছিল। দায়িত্ব নিয়েছিলেন তরুণ হুয়ান লাপোর্তে। লাপোর্তে-রাইকার্ড জুটির সাফল্য পেছনে তাদের দল গঠন পালন করেছিল মূখ্য ভূমিকা। তথাকথিক তারকাদের বদলে প্রত্যেক পজিশনে উপযুক্ত খেলোয়াড় খুজে বের করে তাদের সেরাটা আদায় ছিল রাইকার্ডের অন্যতম সাফল্য। দিনহো, ই’তো, জুলি বা ডেকোরা যে তারকা থেকে মহাতারকায় পরিণত হয়েছিলেন সেটি রাইকার্ডের বার্সাতেই। শুধু ভীনদেশের তারকারাই না, রাইকার্ড চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তারাদের সাথে লা মেসিয়ার ক্যাডেটদের। একই সাথে প্রস্তুত করছিলেন প্রত্যেকটি পজিশনের সাম্ভাব্য বিকল্পদেরও।

রাইকার্ড জামানায় ক্রুইফের দর্শনের প্রভাব সেভাবে চোখে না পড়লেও বার্সা খেলতে শুরু করে চোখ ধাঁধানো ফুটবল। বলাই বাহুল্য, এর নেতৃত্বে ছিলেন রোনালদিনহো। যদিও, রাইকার্ড মেসির শ্রেষ্ঠ সময়টুকু পাননি, কিন্তু আপনি যদি ভালো করে খেয়াল করেন, তাহলে খুব স্পষ্টভাবেই দেখবেন যে; মেসি, ইনিয়েস্তা, জাভিদের ভীত গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন এই ডাচ কিংবদন্তিই। যার পূর্ণ ফলটি ভোগ করেছেন পেপ গার্দিওলা। বার্সার উত্থানটা মূলত শুরু হয় ‘০৬ এর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিয়ে, যেটিতে আর্সেনালকে হারিয়ে বহুদিন পর মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পায় কাতালানরা। এর আগে সর্বশেষ ইউরোপ সেরার মুকুট বার্সার মাথায় শোভা পেয়েছিল ১৯৯১-৯২ মৌসুমে। যদিও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের আগেই স্পেনে অপ্রতিরোধ্য রূপ ধারণ করতে শুরু করেছিল বার্সা।

কিন্তু, সেটি শুরু হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হোচট খায় বার্সা। ইউরোপ জয়ের পর যেখানে আরো প্রতাপশালী বার্সাকে দেখার প্রত্যাশায় প্রহর গুনছিলেন সমর্থকরা সেখানে পরের মৌসুমটি আশ্চর্যজনক ভাবে শিরোপা শূন্য অবস্থায় শেষ করে বার্সেলোনা। প্রি সিজনে খেলোয়াড়দের ক্লান্তি এবং ইনজুরিকে প্রকাশ্য পতনের কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হলেও অন্দরের চিত্রটা ছিল ভিন্ন।

মাঠকে ক্যানভাস বানিয়ে একের পর এক মোহনীয় যে চিত্রকর্মের জনম বার্সা দিচ্ছিল মাঠে তার মূল কারিগর ছিলেন রোনালদিনহো। ততদিনে ফুটবল বিশ্ব মেসি নামের ভবিষ্যত মহাতারকার সাথে ফুটবল বিশ্বের পরিচয় ঘটলেও এককভাবে বার্সার জোয়ালা টানবার মত কাঁধ তখনো তার ছিল না। মূল কারিগরের কক্ষচ্যূতি বার্সাকে যেমন ভোগাতে শুরু করে তেমনি অবনতি হতে থাকে রাইকার্ড-দিনহো সম্পর্কেরও। মাঠের বদলে নৈশ জীবনে অতিশয় আসক্তি দিনহোকে বা বার্সাকেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ফুটবলকেও। কারণ, বল পায়ে দিনহোকে যারা মাঠে দেখেছেন তারা নিশ্চয় জানেন কি আশ্চর্য নাজাকাত ছিল তার খেলায়। যে মৌসুমে একদম শেষ ম্যাচে লিগ শিরোপার নিষ্পত্তি হয়, সে মৌসুমে রেফারির এক ভুল সিদ্ধান্তের বলি হয়ে দিনহো লাল কার্ড দেখে

মাঠ ছাড়লে পূর্ণ পয়েন্ট ছাড়াই মাঠ ছাড়ে বার্সা, যার সুযোগ নিতে সামান্য কসুর করেনি রিয়াল। এ থেকেই বোঝা যায় দিনহো তখন বার্সার জন্য কি ছিলেন।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, সে সময় বার্সা বলতে গেলে পুরোটাই নির্ভরশীল ছিল দিনহোর ওপর। যার ফলে তার ছন্দপতন বার্সাকেও ধাবিত করছিল পতনের দিকে। সেটি থেকে যে তারা শিক্ষা নিয়েছে তার প্রমাণ দেখা গিয়েছে চলতি মৌসুমেই। মেসির অনুপস্থিতিতেও বার্সার জয়রথ থামেনি একবারও।

টানা দুই মৌসুমের হতাশাজনক ফল ইতি টেনে দেয় রাইকার্ড জামানার। ক্লাব ছাড়েন দিনহোও। দুটো বিষয় উল্লেখ করার মত এখানে, যার একটি আগেই করেছি; অতিমাত্রায় একজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভরতা এবং নিয়মিত কৌশল কাজ না করলে তার বিকল্প বের করতে না পারা। যাই হোক, রাইকার্ডের জামানার সমাপ্তি ঘটার আগেই তিনি কিছু কাজ করে গিয়েছিলেন যার সুফল বার্সা পরবর্তীতে ভোগ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম লা মেসিয়ার ক্যাডেটদের প্রস্তুত করা। যারা পরবর্তীকালে বার্সা জামানা বলতে মূলত যে সময়কালটা বোঝায় সে সময়ে পালন করেছেন মূখ্য চরিত্রের ভূমিকা। এবং ইউরোপিয়ান মহলে বার্সাকে সমীহ জাগানিয়া এক শক্তিতে পরিণত করা।

যাই হোক, টানা দু’মৌসুমের ব্যর্থতায় রাইকার্ড জামানার ইতি ঘটার পর বার্সা কতৃপক্ষ এক ধরনের জুয়াই খেললেন বলা যায়। মূল কোচ হিসাবে নিয়োগ দিলেন বার্সা বি দলের কোচ পেপ গার্দিওলাকে। এখানে দুটো বিষয় কাজ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়। গার্দিওলা ছিলেন লা মেসিয়ার ক্যাডেট এবং রাইকার্ডের ড্রিম টিমের সদস্য। এ নিয়োগের পিছনে ক্রুইফিয় দর্শন; যা মূলত টিকিটাকা নামে পরিচিত সেটি পূর্ণজন্মের মাধ্যমে কক্ষে ফেরার একটি প্রচেষ্টা কাজ করেছে বলে ধারণা করা যায়। এবং রাইকার্ড প্রাথমিক ভীতটা গড়লেও মূল শিকড়ের সাথে তার সে রকম সম্পর্ক ছিল না, সুতরাং শেকড়ে ফেরার তাড়না থেকেও এমন জুয়া বলে একটা ধারণা জন্মায়।  [চলবে …]