বাংলাদেশে হ্যাসট্যাগ মি টু আন্দোলন এখন বেশ আলোচিত। এই আন্দোলন যাদের সাহসী ভূমিকার জন্য এতোটা ব্যাপকতা লাভ করেছে তাদের মধ্যে অন্যমত আসমাউল হুসনা একজন। তিনি গত ৮ নভেম্বর, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জার্নালিজম ট্রেইনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জেএটিআরআই) প্রধান জামিল আহমেদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন। পরবর্তীতে তার এই বক্তব্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হয়। তিনি বর্তমানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)তে কাজ করছেন। গত তিন বছর ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। কাজ করেছেন ডেইলি অবজারভারে।
জবানের সাথে তিনি বিশেষ সাক্ষাৎকারে ‘মি টু’ আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন:
আপনার সাহসী ভূমিকার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘মি টু’ আন্দোলন নতুন করে গতি পেল। আপনি কেন এই সময়ে এটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন?
আসমাউল হুসনা : আমি আনুধাবন করেছি, আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। আমি নিজে ও একজন ভুক্তভোগী। ‘মি টু’ প্ল্যাটফর্মটি একটি প্রতিবাদ, সচেতনতা ও আন্দোলনের জায়গা। সারা বিশ্বে নারীরা যখন তাদের যৌন হয়রানির আভিজ্ঞতা নিয়ে সোচ্চার হয়েছে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে আমার ও আমার সাথে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কথা বলা উচিত। সবারই তাদের সাথে যে নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে তা শেয়ার করা উচিত যাতে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক সচেতনতার স্পেস সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে আগে যে দুই জন এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছে প্রিয়তি ও সীমন্তি— যারা নিঃসন্দেহে আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তারা দুই জনই দেশের বাইরে অবস্থান করছে। আমার পক্ষে দেশে থেকে নিপীড়কের মুখোশ উন্মোচন করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল।
আমার যৌন হয়রানি নিয়ে কথা বলাটা একটা প্রতিবাদ, সচেতনতা ও আন্দোলন। আমি নিজে যেমন এই ধরণের আতঙ্কিত ও অন্যায় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে চাই না, আমার চারপাশের মানুষরা ও যাতে এ ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে না যায় সে সচেতনতা থেকেই আমি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছি। ‘মি টু’ আন্দোলন আমাকে অনুপ্রেরণা ও সাহস দিয়েছে অন্যায়কারীর দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলার জন্য।
আপনি যার বিরুদ্ধে আপনার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন সে মিডিয়ার পরিচিত মুখ। কোন প্রেসার কি আসছে? বা তার দিক থেকে কোন বক্তব্য কি জানতে পারছেন?
আসমা : আমি তার পক্ষ থেকে কোন কিছু শুনিনি এখনো। একজন নিপীড়কের কাছ থেকে আমি কোন কিছু শোনার আশাও করি না।
এই পর্যন্ত প্রায় সবগুলো ঘটনাই কোন না কোন ভাবে মিডিয়ার লোকদের জড়িত থাকার ব্যাপারটি লক্ষ্য করা গেছে। মিডিয়াতে আমরা জানি সব চেয়ে বেশি স্বাধীনতার চর্চা হওয়ার কথা। আপনার কি মনে হয়— কেন মিডিয়ার লোকজন নারীদের প্রতি এমন আচরণ করেন?
আসমা : আসলে আমাদের সমাজে নিপীড়ন সব জায়গাতেই ঘটছে। যারা নিপীড়নের বিষয়ে মুখ খুলেছে তাদের বেশির ভাগই মিডিয়া সক্রান্ত কাজে জড়িত ছিল বলে মিডিয়ার ঘটনাগুলো উঠে এসেছে। আস্তে আস্তে আরো অনেক কর্মক্ষেত্রের মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে।
সমাজের অসহায় ও দরিদ্র শ্রেণির নারীদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করার জায়গা তৈরি হয়নি এখনো। সেটা সত্যি। কিন্তু সামাজিকভাবে যদি সর্বস্তরে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সচেতনতার জায়গা তৈরি হয়, সামগ্রিকভাবে এর ফলাফল সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পরবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
সমাজের অসহায় ও দরিদ্র শ্রেণীর নারীদের তো মিডিয়া বা সোসাল মিডিয়া ব্যবহার করে এমন প্রতিবাদরে সুযোগ নাই তারা কি ভাবে তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত এমন অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ সমাজের অসহায় ও দরিদ্র শ্রেণির নারীদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করার জায়গা তৈরি হয়নি এখনো। সেটা সত্যি। কিন্তু সামাজিকভাবে যদি সর্বস্তরে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সচেতনতার জায়গা তৈরি হয়, সামগ্রিকভাবে এর ফলাফল সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পরবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
শুধু কি সমাজিক ভাবে বা মিডিয়া ট্রায়লই যথেষ্ট নাকি এমন অপরাধিদের আইনের আওয়তায় আনা দরকার। আর সেটা কি ভাবে সম্ভব?
আসমা : এখন পর্যন্ত ‘মিটু’ প্ল্যাটফর্মে আমরা যারা যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছি সবগুলোই অতীতের অভিজ্ঞতা। বর্তমানে এইগুলো, আমার জানামতে, আইনি প্রক্রিয়ায় প্রমাণের সুযোগ খুব একটা নেই। তাই মিডিয়া ট্রায়াল বা সামাজিকভাবে নিপীড়কদের প্রত্যাহার বা মার্জিনালাইজ (marginalize) করাটা একটা মাধ্যম হতে পারে। আর যদি এখন থেকেই নারীরা তাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির ঘটনা নিয়ে সোচ্চার হয়, বর্তমানে এ ধরণের অভিজ্ঞতা ঘটলে নারীরা যাতে আইনি সহায়তা নিতে পারে সেই পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া দরকার।
নারী নির্যাতন বা যৌন হয়রানি শুধু লিঙ্গগত ব্যপার নয়। আমরা দেখেছি এর সাথে ক্ষমতার প্রশ্নটি জড়িত। বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক ক্ষমতা সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি গুরুত্ব কিছু অভিযোগ ও প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এরার থেকে মুক্তির জন্য নারীদের কি ধরণের পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করেন?
আসমা : আপনার সাথে আমি একমত। যৌন হয়রানি লিঙ্গগত ব্যাপার নয়। অনেক পুরুষও এই নির্যাতনের শিকার। বেশ কিছু পুরুষ এর মধ্যে তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছে। লেখক মোজাফফর হোসেনও উনার সাথে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কথা শেয়ার করেছেন। এই ধরণের ঘটনাগুলোর নেপথ্যে ক্ষমতার বিষয়টি জড়িত। তবে এটি শধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে যুক্ত তা নয়। আর একটি হিংস্র ক্ষমতা এর সাথে জড়িত সেটি হল পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ও চিন্তা চেতনা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে এই ধরণের হয়রানি সমাজ থেকে দূর করা দুরূহ হবে।
আপনার পরিবার বা আশপাশের লোকজন ব্যাপারটি কেমন ভাবে দেখছেন?
আসমা : আমার পরিবার এ বিষয়ে আমাকে সমর্থন ও সাহস দিয়েছে। আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। অনেকেই পাশে থেকে সাহস আর শক্তি দিয়েছে। আবার অনেকেই তাদের দীর্ঘ দিন ধরে লালিত ইন্টারনালাইজড প্যাট্রিয়ার্কাল অবস্থান থেকে সমালোচনা করেছেন।
আপনি কি মনে করেন এই ধরণের আন্দোলন ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়া জরুরি? কি ভাবে সেটা সম্ভব?
আসমা : আমি বিশ্বাস করি এই ধরণের আন্দোলন সামাজিক রুপ পাবেই। কারণ, মি টু একটা ব্যাক্তিগত আন্দোলন থেকে ইতোমধ্যে বৈশ্বিক আন্দোলনের রুপ পেয়েছে। আমাদের সমাজেও এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে।
নারীর প্রতি এই ধরণের আচরণের জন্য অপরাধীর পরিবার কি ভূমিকা নিতে পারেন?
আসমা : অপরাধীর পরিবারকে যে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিটি তার নির্যাতনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে, তাকে বিশ্বাস করতে হবে। তারপরে অপরাধীকে বিষয়টি নিয়ে সচেতন করতে হবে। তাকে এই ম্যাসেজটি অবশ্যই দেওয়া উচিত তার কাজ ও চিন্তা চেতনা ঘৃণ্য ও অমার্জনীয়। অপরাধীর পরিবার যদি নির্যাতনের শিকার ব্যাক্তিটির অভিযোগের কথা বিশ্বাস না করে তাহলে তারা কিন্তু একজন অপরাধীকে নিজের অজান্তেই সমর্থন করে সমাজের জন্য আরো সিরিয়াস ব্যাধি তৈরি করে দিচ্ছে। আর এতে অপরাধীও তার নোংরা কাজ এবং মানসিকতা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।