পিচ যেন পরকীয়ায় লিপ্ত প্রেমিকা এক!

পিচ যেন পরকীয়ায় লিপ্ত প্রেমিকা এক!

নিকট অতীতে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই ‘পিচ’ প্রসঙ্গটি অবধারিতভাবে আলোচনায় চলে আসছে। কখনো মূখ্য চরিত্ররুপে কখনো বা পার্শ্ব চরিত্রে। পিচের এই অবস্থাকে আমার কাছে লাগছে ছলনাময়ী প্রেমিকার মত। জানিনা, বিষয়টি কে কিভাবে নিবেন। তবে, আমি অন্তত এটাই বিশ্বাস করি, আরেক ভাবে বলা যায় বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

শুরু থেকেই শুরু করি। চলতি বছরের প্রথম সিরিজের আগেই মিরপুর শের-এ বাংলা স্টেডিয়ামের নামের আগে ছিল ডিমেরিট পয়েন্ট। তার থেকে বাঁচার এক বিচিত্র প্রয়াশ দেখা গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে। জঘন্যর বদলে বাংলাদেশের কর্তাদের একটি অংশের নির্দেশে পরের টেস্টে পিচের বদলে যেটি বানানো হলে সেটিকে বলা যায় মাইন ফিল্ড। প্রথম দিন থেকেই যেভাবে বল ঘুরছিল তাতে পাঁচ খেলা তো দূর, পাঁচ সেশন ব্যাটিং করাটাই হয়ে উঠেছিল ভয়ানক এক পরীক্ষা। বাংলাদেশ যে তাতে উৎরাতে পারে নি, সেটি তো সবারই জানা।

এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত হোম সিরিজ। প্রথম টেস্টের পিচ বোঝার টেস্ট কেসে ব্যর্থ হয়েছিলেন টিম ম্যানেজমেন্ট এর কর্তারা। না বুঝে তিন স্পিনার নিয়ে নেমে জিম্বাবুয়ের পেসে খেই হারিয়ে ইজ্জতের খেসারত দিতে হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। সেটি থেকে উত্তরণের ঢাকা টেস্টের ফলাফল পক্ষে আসলেও পিচ এর প্রহসন চলেছে এখানেও। চতুর্থ দিনেও ফাটলের রেশ সেভাবে দেখা যায়নি। তাই শেষ দিনে ফল কি দাড়ায় তা ভেবে রোমকূপ খাড়া হয়ে গিয়েছিল অনেকেরই।

নিজের ঘরে খেলা সব দলকেই বাড়তি সুবিধা দেয়। এবং আইসিসির সেরকম কোনো বাধা নিষেধ না থাকায় নিজ নিজ দেশে প্রতিটি দলই নিজেদের শক্তির জায়গাটিকে কাজে লাগিয়ে যে পিচ বানায় তাতে কঠিন পরীক্ষাই দিতে হয় প্রতিপক্ষকে। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে চিত্রটা একটু অদ্ভুতই। প্রতিপক্ষ তো বটেই, পিচ মনের বুঝতে বারোটা বাজার জোগাড় বাংলাদেশের খেলোয়াড়দেরই। তাই নিজের মাঠে খেলে ফায়দা নেয়ার পরিবর্তে পরীক্ষাটা হয়ে যাচ্ছে ইজ্জত রক্ষার। এ যেন অনেকটা প্রেয়সীর মনের মত, যার মতিগতি বোঝা যেমন ভার, তেমনি কঠিন মন রক্ষাও।

এখন বাছ বিচার ছাড়া কাউকে দায়ী করতে গেলে নাম আসে গ্রাউন্ডসম্যানদের। যেহেতু, পিচ তৈইয়্যারের যাবতীয় দায় দায়িত্ব তাদেরই। কিন্তু, আপনি যদি অন্দরে উঁকি দেন, চিত্রটা আপনাকে দ্বিধায় ফেলতে বাধ্য। কর্তার এক খেয়াল, কোচের আরেক খেয়াল তো অধিনায়কের পুরোই অন্য খেয়ালের আর্জিতে গ্রাউন্সম্যান বেচারা বুঝে উঠতে বিশম খান যে কার মন রক্ষা করবেন? এ দোটানায় যে পিচের জন্ম নেয় তাতে আবার কখনো বিষম খান ব্যাটসম্যানরা কখনো বা বোলাররা। বিচিত্র এক অবস্থাই বটে!

আমার কাছে যেটি মনে হয়, বাংলাদেশ দল আসলে নিজেরাই নিজেদের শক্তির জায়গা সম্পর্কে সন্দিহান অথবা তারা ঠিক জানেই না যে তাদের লক্ষ্যটা আসলে কি? প্রতিপক্ষ বিবেচনায় রণকৌশল সাঁজানোই স্বাভাবিক বিষয়। সেখানে দেখা গেল লঙ্কান স্পিনারদের বিপক্ষে বানানো হল স্পিনিং পিচ! বাংলাদেশ দলের কার মাথায় এটা ঢুকেছিল যে হেরাথের চেয়ে আমাদের স্পিনাররা ভালো সেটি জানতে বড় ইচ্ছে করে। এমন প্রতিভাবানের মুখ দর্শনেও তো পূণ্য লাভ হবার কথা।

আমাদের দেশের ওপরওয়ালাদের একটি বিশেষ প্রাণীর প্রতি ব্যাপক দূর্বলতা রয়েছে। সেটি হচ্ছে কাক। কাক যেমন নিজে চোখ বন্ধ করে মনে করে বাকি সবাই অন্ধ আমাদের হালতও তাই। আমরা যেন ধরেই নিয়েছিলাম স্পিনিং ট্র্যাক বানানোর আইনস্টাইনিও ফর্মুলা দিয়ে সবাইকে মাত করবো আমরা এবং এর জওয়াবও কেউ দিতে পারবে না। খোদ জিম্বাবুয়েই জানাচ্ছে যে, বাংলাদেশে আসলে যে পিচের বদলে রঙ্গমঞ্চে নৃত্যকলা দেখাতে হবে সেটি তারা আগে থেকে জেনেই সেরুপ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। আমি প্রথম টেস্ট শেষেই বলেছিলাম এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বলি হয়ে এক টেস্টেই থেমে যেতে পারে নাজমুল অপুর ক্যারিয়ার। আপাত দৃষ্টিতে পয়লাবার মনে হচ্ছে আমার প্রতিও বিসিবি কর্তারা পুলক অনুভব করছেন, ফলাফল উইন্ডিজ সিরিজের আগেই অপু বাদ।

ওয়ান ডে একদিনের মাঝে শেষ হয়ে যায় বিধায় এটির পিচ নিয়ে তেমন একটা সাওয়ালের মুখে পড়তে হয় না বাংলাদেশকে। কিন্তু, টেস্ট আসলেই সেটি যেন পরিণত হচ্ছে এসিড টেস্টে! হয় পাটা নতুবা শুরুতেই ফাটা পিচ বানিয়ে জমজমাট টেস্টের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে পিচ। অথচ ভিনদেশ থেকে আনা কিউরেটরদের জন্য নিজ দেশের খেলোয়াড়; যিনি একই সাথে দলের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বলেও পরিচিত তাকে গুণাগার সামঝে জরিমানা করতেও দেখা গিয়েছে। এখন, সেই কিউরেটর প্রধান যদি এতই যোগ্য হন তাহলে পিচের এহেন আচরণ ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

সমস্যাটা হচ্ছে কিউরেটরকে সরাসরি কাঠগড়ায় তোলায় আগে বিসিবির অন্দর সম্পর্কে ধারণা থাকায় থমকে যেতে হচ্ছে। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় যে দুটো বিষয়ে ধারণা করা যায় সেটি হচ্ছে, বর্তমান থিঙ্কট্যাঙ্ক নিজেরাই নিশ্চিত না নিজেরা ঠিক কি করতে চাইছে সে বিষয়ে যার ফলে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে ব্যার্থ হচ্ছে কিউরেটরদের অথবা কিউরেটর নিজেই যোগ্য নন, বিধায় যা তাকে বানাতে বলা হচ্ছে সেটি তিনি করতে সম্পূর্ণ অক্ষম!

দ্বিতীয়টি হবার সম্ভাবনা যে খুবই ক্ষীণ সেটি ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়। আঠারো বছরের পথচলায় নিকটের মত পিচ এতবার আলোচনায় আসেনি কখনো। আর, লঙ্কানদের বিপক্ষে পিচ তৈয়ারের পর নিশ্চয় দলকে জানানো হয়নি; যার ফলে তারা তিন স্পিনার নিয়ে খেলার মতন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে। দলের চাহিদাই কিউরেটর পূরণ করেছিলেন মাত্র।

লিখে রাখুন, আসন্ন উইন্ডিজ সফরেও পিচ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। হোম অ্যাডভান্টেজ নেয়ার কথা ইতোমধ্যেই শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশই শুধু না, উপমহাদেশের এক পাকিস্তান বাদে বাকি তিন দলই হোম অ্যাডভান্টেজ বলতে বুঝছে তিন স্পিনার খেলানো! যার ফলাফল ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। ইংল্যান্ডকে এই ফাঁদে ফেলতে গিয়ে লঙ্কানরা চপেটাঘাত খাচ্ছে বেশ ভালোমতই। বাংলাদেশও জিম্বাবুয়ে কলঙ্ক কপালে লেপ্টেছে। এই নেতিবাচক ধারা যদি অব্যাহত থাকে, নিকট ভবিষ্যতে উপমহাদেশের দলগুলোর হালত হবে হতশ্রী।

হোম অ্যাডভান্টেজ নেয়া ক্রিকেটে কবিরা গুণাহ পর্যায়ের কিছু না যে করাই যাবে না। কিন্তু, সেটি যখন নিজেদেরই উদোম করে ছাড়ে বিষয়টি ভাববার দাবি রাখে। বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলটির কথা তো এত দ্রুত বিস্মৃতি হবার কথা না। তার হোম অ্যাডভান্টেজ নিলেও পরের ঘরেও ছিল সমান প্রতাপশালী; সেখানে আমরা খাবি খাচ্ছি নিজেদের আব্রু রক্ষাতেই! গলদ যে বেশ বড় সেটি স্পষ্টই।

হোম অ্যাডভান্টেজের নামে তিন স্পিনার নিয়ে নামার ফিতুরে ফতুর হবার আগেই অনুধাবন আবশ্যক। ঢাকা টেস্টে খালেদ যেরকম বোলিং করেছেন তাতে পরের টেস্টেই তাকে বসিয়ে রাখা হবে চূড়ান্ত অপরিনামদর্শিতা। আর তাও মানা যেত যদি ব্যাটসম্যানরা স্বস্তি পেতেন। তারা যে চেহারা নিয়ে নামছেন আর যেভাবে ফিরছেন তাতে অ্যাডভান্টেজ না, বরং আজরাঈল তারা করেছে ঠেকে। তাই, কন্ডিশনকে শুধু না প্রতিপক্ষের শক্তি দূর্বলতা নিয়েও ভেবে কৌশল ঠিক করা আবশ্যক।

নিজ দেশের পিচ যেখানে প্রেয়শী হবার কথা সেখানে ছলনাময়ীর রুপে আবির্ভুত হতে দেখাটা বিস্ময়করই বটে। দুশ্চিন্তার বিষয় এই ছলনায় মূমূর্ষই না হয়ে যায় অবস্থা! পাটা-ফাটার বদলে স্পোর্টিং পিচ তৈরি করলে আখেরে লাভ নিজেদেরই। টেস্ট তিন দিনের খেলা নয়, স্বাভাবিক নিয়মে তৃতীয় দিন থেকে ম্যাচের আসন্ন ফলাফল সম্পর্কে একটা ধারণার সৃষ্টি হবার কথা। সেখানে তিন দিনেই ফল আনতে গিয়ে ঘটছে বিপর্যয়। আর নিয়মিত স্পোর্টিং পিচে খেললে বাইরের দেশে গিয়েও যে খাবি খাওয়ার প্রবণতা সেটাও হ্রাস পাবে।

আরো একটি বিষয় নজরে আনতে চাই। বাংলাদেশে একাধিক টেস্ট ভেন্যু রয়েছে। অবস্থান অনুযায়ী কন্ডিশনকে মাথায় রেখে যদি পিচ তৈরি করা হয় সেটাও একটা সুবিধা হতে পারে বাংলাদেশের জন্য। স্পিনিং ট্র্যাক যে একদমই করা যাবে না, তা বলছি না; তবে সেটি নির্দিষ্ট একটি মাঠেই থাকুক এবং স্পিনও ধরুক সাধারণ নিয়মে। অপর কোনো মাঠে সুবিধামতন পেস বা স্পোর্টিং পিচ বানানো সম্ভব। তাহলে প্রতিপক্ষ অনুযায়ী সে সব মাঠকে কাজে লাগানো যাবে একই সাথে হতশ্রী রুপটাও কিছুটা শ্রী ফিরে পাবে। এক মিরপুরেই যদি আপনি ঘাসের পিচ, পাটা পিচ বা স্পিনিং পিচ বানান তাহলে বিভ্রান্তি তো স্বাভাবিক। অজেয় অজিদের সময়কালটা দেখুন; প্রত্যেকটা মাঠের, স্পষ্ট করে বললে পিচের একটি নির্দিষ্ট চরিত্র ছিল। যার ফলে পরিকল্পনা করা যেত সহজে।

আমাদের শিক্ষা নিতে অনীহাটা অহর্নিশ দেখা যাচ্ছে। ঘরের পিচ নিজ দেশের ক্রিকেটারদের প্রেয়সী হবার কথা; এখন দেখা যাচ্ছে সে প্রেয়সী অপর দলের সাথে পরকীয়ায় মত্ত। যার দহনে জ্বলছেন আমাদের ক্রিকেটাররা!