বিধির খেয়াল বড় অদ্ভুত। যা কখনো মানুষের কল্পনাতেও আসে না, সেটাকেই বাস্তবে পরিণত করে মানুষকে চমকে দিতে বিধির তুলনা হয় না। এমনই এক চমকের শিকার হয়ে জীবন বদলে গিয়েছিল রেজাউল করিম চৌধুরী এবং লিজা চৌধুরীর। সে চমক তাদের সুখী করেছে কি না তা জানা নেই, তবে; এটা একই সাথে জন্ম দিয়েছিল বিস্ময় আর বিরহের এক গল্পের।
নব্বইয়ের শুরুর দিক। সদ্য বিসিএস পাশ করে প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকেছে রেজাউল করিম চৌধুরী যিনি বাড়িতে রেজা নামেই পরিচিত। চাকরি পাওয়ার পরেই রেজার মনে বহুদিনের স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ নেয়ার দারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। চাচাতো বোন লিজার বান্ধবী লাবণ্যর সাথে রেজার প্রণয় দীর্ঘ দিনের। চৌধুরী বাড়ির সন্তান হবার পরেও নিজ পরিচয়ে পরিচিত হয়েই লাবণ্যর বাসায় প্রস্তাব নিয়ে হাজির হবে বলে কথা দিয়েছিল রেজা। রেজা আর লাবণ্যর স্বপ্ন তখন কল্পনা আর বাস্তবের দারপ্রান্তে।
এ প্রণয়ের পিছনে অন্যতম মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে লিজা। লিজার বান্ধবী লাবণ্য লিজাদের বাসায় এসে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পরে রেজার। লিজাকে সে কথা জানানোর পর লিজার প্রচেষ্টায়ই দু’জনের প্রণয়ের শুরু। যখন দেখা হত না, তখন দুজনের চিঠি দুজনের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটাও করতো লিজা। বলতে নেই, ছোট বেলায় রেজার মা মারা যাওয়ায় লিজার মায়ের কাছে রেজা মানুষ হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই দু’জনের মধ্যে একটি চমৎকার সম্পর্ক ছিল।
একদিকে রেজা যখন নতুন জীবনে প্রবেশের পর এত দিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে দেখে আনন্দে বিভোর তখন চৌধুরী বাড়ির এক কোনে বসে অঝোরে চোখের জল ফেলছে লিজা। লিজার বান্ধবী লাবণ্যর সাথে যেমন রেজার প্রেম ছিল তেমনি লিজার প্রেম ছিল রেজার বন্ধু নিয়াজের সাথে। লিজা যেমন লাবণ্য আর রেজার প্রেমের সেতুবন্ধন ছিল তেমনি লিজা আর নিয়াজের প্রেমের রেজা। ঘটনা চক্রে রেজা যখন নিজের প্রথম পোস্টিং নিয়ে বগুড়ায় জয়েন করে তখন নিয়াজ একটি স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে যায় আরো উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য। কথা ছিল, পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরেই লিজাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাবে নিয়াজ।
নিয়াজের উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য স্কলারশিপ পাওয়ায় লিজা খুশি ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু, নিয়াজকে দীর্ঘদিন না দেখতে পাওয়ার কষ্টটা ছিল আরো তীব্র। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল অঝোর অশ্রুতে। কিন্তু, এটি যে পুরো জীবনের গল্পই বদলে দিবে তা ভুলেও ভাবতে পারেনি লিজা।
ছোটবেলা থেকেই লিজা আর রেজার সম্পর্ক যে বেশ ভালো তা তো আগেই বলেছি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি শেষ হয়ে গেলেও সম্পর্কের উষ্ণতা সামান্যও না কমায় চৌধুরী বাড়ির অন্দরে একটি ধারণা ছিল যে রেজা এবং লিজা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। দু’জনের বাবা মোজাফফর চৌধুরী এবং মোফাজ্জল চৌধুরীর মধ্যে এ নিয়ে আলাপ হলেও তা কখনো রেজা বা লিজা পর্যন্ত পৌঁছোয় নি। আর লিজার মা, মমতাজ চৌধুরীরও এ বিয়েতে আপত্তি ছিল না, রেজাকে তো বলতে গেলে মানুষ করেছেন তিনিই। ছেলেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে।
ভাবনার জল কোথা থেকে কোথায় গিয়ে গড়ায়। রেজার পোস্টিং নিয়ে বগুড়ায় চলে যাওয়া আর লিজার মন খারাপ দেখে দুই চৌধুরী ভাই নিশ্চিতই হয়ে গেলেন যে দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। এমন অবস্থাতেই একদিন স্ট্রোক করলেন লিজার বাবা মোফাজ্জল চৌধুরী। অবস্থা শংকটাপন্ন হওয়ায় ফোনে রেজাকে জানানো হলো যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে আসতে।
সেই আসাটাই গল্পের মতন বদলে দিল জীবন। রেজাকে দেখা মাত্রই মোফাজ্জল চৌধুরী ইশারায় লিজাকে ডাকলেন। ডাকার পর দুই হাত দু’জনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমি যদি সুস্থ থাকতাম ধুমধাম করেই বিয়েটা দিতাম। জানিনা, আর কতক্ষণ সময় আছে; রেজা আমি তোর হাতে লিজাকে তুলে দিলাম!
বাজ পড়লেও বোধহয় এতটা অবাক হতো না লিজা বা রেজার কেউ। তাদের দু’জনের ভালো সম্পর্ককে বাড়িতে ভালোবাসা হিসাবে ধরে নেয়া হয়েছে তা ভুলেও আঁচ করতে পারেনি দুজনের কেউই। বাবার অমন অবস্থায় লিজা নিয়াজের কথা বলতে গিয়েও পারে না। আর সম্পর্কে চাচা হলেও মোফাজ্জল চৌধুরীকে রেজা ভালোবাসত নিজের বাবার মতই। তাই, রেজাও বলতে পারে না লাবণ্যর কথা।
মোফাজ্জল চৌধুরী রেজার বাবাকে বলেন, মিঞা ভাই কাজী ডাকেন। হায়াত-মওতের তো ঠিক নাই। শুভ কাজটা শেষ করেই মরতে চাই। এক দিকে বাবা অপর দিকে ভালোবাসা; আর একদিকে বাবা সমতূল্য চাচা আর অপরদিকে ভালোবাসা। লিজা বা রেজা কেউই কারো দিকে তাকাতে পারে না। দুজনের মনেই তখন ভাবনার তুফান বইছে। এর মাঝে কতটুকু সময় পার হয়ে গিয়েছে কেউ টেরই পায়নি। সম্বিৎ ফিরে আসে লিজার মায়ের ডাকে। কাজী চলে এসেছে!
বিধির লীলা বোঝা বড় দায়! সম্পুর্ণ ভুল বুঝাবুঝি বদলে দিয়েছে দুটি জীবন। বিয়ে পড়ানোর কয়েক ঘন্টা পরেই মারা যান মোফাজ্জল চৌধুরী। মারা যাবার আগে যে গল্পটা লিখে গিয়েছেন সেটি কে কোনভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, সেটি পাঠকই বিবেচনা করুন। আমি যতবারই দু’জনকে দেখি, প্রত্যেকবারই অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করি, সেদিন ঠিক কেমন ছিল তাদের মনের অবস্থা? আর কেমন আছে লাবণ্য আর নিয়াজ?