‘ম’ ময় টেস্টে মান রক্ষা বাংলাদেশের

‘ম’ ময় টেস্টে মান রক্ষা বাংলাদেশের

মিরপুরে মানরক্ষার টেস্টে ‘ম’ এর ওপর ভর করেই মান বাঁচালো বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে মমিনুলের সেঞ্চুরি, মুশফিকের ডাবল এবং মিরাজের হাফ সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংসেও আবারো ‘ম’ এর জয়জয়কার। মিথুনে হাফ সেঞ্চুরি, মাহমুদুল্লাহর সেঞ্চুরি এবং মিরাজের পাঁচ উইকেট। পুরোটাই ‘ম’ময় হবার মাঝে বাঁধা শুধু তাইজুল।

টেস্টের গতি প্রকৃতি কেমন ছিল গত পাঁচ দিন যারা খোঁজ রেখেছেন তারা সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। আমি আমার আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখব দুজন ব্যক্তির ওপর; মাহমুদুল্লাহ এবং খালেদ আহমেদ। ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহর বন্দনা বহুবার বহুভাবে হয়েছে, সুতরাং তার জিকর করে লেখার ব্যপ্তি বাড়াবো না। আমার আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে এ ম্যাচে মাহমুদুল্লাহর অধিনায়কত্ব। আর খালেদকে কেনো যোগ করলাম সেটিরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব।

আমার এ বাক্যটা অনেকের মনে অসন্তোষ্টির জনম দেবে জেনেও ব্যবহার করছি; কারণ বিষয়টা নিরেট সত্য। বাংলাদেশের মত এত বিশ্লেষক বোধ করি কায়ানাতের কোথাও নেই। যে কখনো ক্রিকেট বল হাতে নিয়েও দেখেনি সেও মহান বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতির্ন হয়ে ব্যবচ্ছেদ করতে বসে যান ঠিক বেঠিকের। গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বিস্তর সমালোচনা হয়েছে মাহমুদুল্লাহর অধিনায়কত্বের। আপনি যদি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখে থাকেন, গত আঠারো বছরে বাংলাদেশ যতগুলো টেস্ট খেলেছে তার মধ্যে সবচেয়ে আক্রমণাত্বক অধিনায়কত্ব করেছেন মাহমুদুল্লাহ এই টেস্টে।

আমি একদম শুরু থেকেই প্রত্যেকটি সমালোচনার জওয়াব দিবো। প্রথমেই প্রশ্ন উঠেছিল দ্বিতীয় দিন পুরো ব্যাট না করে খেলা শেষ হবার ঘন্টা খানেক আগে কেন তিনি ইনিংস ঘোষণা করলেন! বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ততক্ষণে জমা ৫২২ রান, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। এমন অবস্থায় দিনের শেষার্ধে দুয়েকটা উইকেট তুলে নিয়ে প্রতিপক্ষকে চাঁপে ফেলতে চাওয়া ক্রিকেটের সাধারন কৌশল। এটি কি করে সমালোচনার বিষয় হয় বোধগম্য না। এবং বাংলাদেশ কিন্তু ঠিকই শেষ বেলায় আঘাত হেনে হাঁসিমুখেই মাঠ ছেড়েছিল। সুতরাং, এ সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াসই হাস্যকর।

তৃতীয় দিন যখন পুরোটা দিনই প্রায় ব্যাটিং করলো জিম্বাবুয়ে তখনো সমালোচনার ধারা অব্যাহত ছিল। ভালো করে যদি ম্যাচটি দেখে থাকেন এ সমালোচনা রূঢ় মনে হবে। কারণ, জিম্বাবুয়ে যে দিনভর ব্যাটিং করতে পেরেছে সেটি বোলার কিংবা মাহমুদুল্লাহর দোষে না। এর পিছনের মূল হেতু ছিল ফিল্ডারদের পিচ্ছিল হাত। একাধিক ক্যাচ যদি এ পর্যায়ে এসে ড্রপ হয় তাহলে অধিনায়ক বা বোলারের কিছুই করার থাকে না। বরং তিনি তার কৌশলি অধিনায়কত্বের প্রমাণ রেখেছেন মুর আর টেইলরের জমে জাওয়া জুটি আরিফুলকে দিয়ে ভেঙ্গে। রিভিও ব্যবহারেও বেশ সতর্কতা দেখা গিয়েছে। যদি একবার রিভিও না নেয়ার খেসারত দিতে হয়েছে কিন্তু সেটি তার একক সিদ্ধান্ত ছিল না।

সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হলো তৃতীয় দিন শেষে এবং চতুর্থ দিনের শুরুতে। যখন মাহমুদুল্লাহ জিম্বাবুয়েকে ফলো অন না করিয়ে নিজেরাই আবার ব্যাটিংয়ে নামলেন। সেটি আরো জোরালো হল, যখন বাংলাদেশ ত্রিশেরও কমে চার উইকেট খুইয়ে বসলো। সমালোকদের দাবি ছিল পিচের ভংকর অবস্থার ফায়দা নিয়েই জিম্বাবুয়াইনরা এ কৃতিত্ব দেখিয়েছে যার শেষ হতে পারত ম্যাচ হাতছাড়া করে! বাস্তবিকই কী তাই? মোটেও না। চতুর্থ দিনের পিচ যতটা ভাঙ্গার কথা পিচে ততটা ফাটল ছিল না। আর যে চারটি উইকেট বাংলাদেশ খুইয়েছিল তার তিনটিই ছিল বাজে শটে। এক লিটনই যা আউট হয়েছেন ভালো বলে। পিচ যে তখনো ব্যাটিংয়ে জন্য কঠিন না, তার প্রমাণ তো মাহমুদুল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। যাতে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন মিথুন এবং মিরাজ। নিজের ইনিংসের শেষের দিকে মাহমুদুল্লাহ যেভাবে ব্যাট চালিয়েছেন তাতেই বোঝা গিয়েছে পিচ কেমন। এ অবস্থায় জিম্বাবুয়েকে ফলো অনে পাঠিয়ে পঞ্চম দিনে ব্যাটিং করা ছিল বরং আরো ঝুকিপূর্ণ।

সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসে তার ফিল্ডিং সাঁজানো এবং শরীরের ভাষা। এরকম আক্রমণাত্বক ফিল্ডিং শেষ কবে কোন বাংলাদেশি অধিনায়ক সাঁজানোর চিন্তা করেছেন একবার ভেবে দেখেন। প্রথার বাইরে গিয়েও কিছু ফিল্ডারকে এমন জায়গায় রেখেছিলেন যেটি সচরাচর দেখা যায় না। জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং যে শেষের দিকে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়লো তার পিছনে ঐরকম চরম আগ্রাসী ফিল্ডিং সাজানোরও কৃতিত্ব রয়েছে। এটা যেমন বোলারের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় তেমনি ব্যাটসম্যানকে বাধ্য করে বাড়তি ঝুঁকি নিতে। যা করতে গিয়ে চা পানের বিরতি আর বিরতি থাকেনি না, বাংলাদেশকে সুযোগ করে দিয়েছে চা সমেত জিম্বাবুইয়ানদের বিদায়কালে আপ্যায়ন করার।

সমালোচনা না ঠিক, একটি জায়গায় আরো একটু সাহসী দেখতে চেয়েছিলাম। সেটি পেসারদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে। জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রায় নব্বই ওভারের মধ্যে পেসাররা ত্রিশ ওভারও পাননি। এটা ঠিক যে, যত তারাতারি সম্ভব জিম্বাবুয়েকে বেধে ফেলে ফল নিয়ে আসার তাড়না ছিল, এবং বল যেভাবে ঘুড়ছিল তাতে স্পিনে ভরসা রাখাই স্বাভাবিক। কিন্তু যতটুকুই সুযোগ পেয়েছেন খালেদ আর মোস্তাফিজ কিন্তু মুগ্ধই করেছেন। খালেদের মতন দুর্ভাগ্য নিয়ে আর কারো টেস্ট অভিষেক হয়েছে কি না জানি না। নতুবা, যেখানে একাধিক উইকেট পেতে পারতেন সেখানে ফিল্ডারদের বদন্যতায়! ম্যাচ শেষ করেছেন উইকেট ছাড়াই। সে জন্যই আক্ষেপটা। এমন অবস্থায় অধিনায়কের আস্থা বোলারকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগায়।

মাঠে না থাকলেও অনিয়াকত্ব যখন এসেছে না চাইতেও আসছে মাশরাফির নাম। মাহমুদুল্লাহ যখন জিম্বাবুয়েকে ফলো অন না করিয়ে নিজেরাই ব্যাটিংয়ে নামলেন অনেকেই মাহমুদুল্লাহকে সালাহ দিয়েছেন এমপি হবার ভাবনা বাদ দিয়ে ম্যাচে মনোযোগী হতে। মাশরাফির এক সিদ্ধান্ত যে বহুবার এমন অবস্থার জনম দিবে তা বোঝাই যাচ্ছে।

এবার খালেদ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে উপসংহারে যাব। আঠারো বছরে বাংলাদেশ এখনো টেস্ট মানের কোনো পেসার পায়নি এইটা নগ্ন সত্য। শাহাদাত শরীরের ভঙ্গিমায় বহু কিছুই চেষ্টা করেছেন, তবে মূল যে কাজ; সে বোলিংয়ে ছিলেন নির্বিষ। কিন্তু, খালেদকে দেখার পর মনে হলো, দীর্ঘ দিনের শূণ্যস্থানটি পূরণের ক্ষমতা রাখেন সিলেটের এই সন্তান।

ম্যাচের স্কোরকার্ড বলবে, দুই ইনিংসেই তিনি উইকেট শূণ্য ছিলেন। এজন্যই পরিসংখ্যানকে প্রায়শই বোকা সংখ্যা বলে ব্যাঙ্গ করা হয়ে থাকে। পেসার সুলভ আগ্রাসী মনোভাব, পেস, সুইং, বাউন্সার; দারুণ এক পেসার হবার মতন বেশ কিছু অস্ত্রই রয়েছে তার তূণে। হ্যা, যেটি কিছুটা চোখে লেগেছে সেটি হলো লাইনের ওপর এখনো তার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেই। পয়লা টেস্ট খেলা একজন আদমির কাছে অবশ্য সেটি প্রত্যাশাও ছিল না।

তার মতন অভাগা অভিষেক আমি আর দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। কমপক্ষে চারটি উইকেট পেতে পারতেন যদি ফিল্ডাররা সামান্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আর যে ক্যাচগুলো হাতছাড়া হয়েছে সেগুলো এমন কঠিনও ছিল না। বরং, একটি উইকেট পেলে তার আত্মবিশ্বাসটা আরো বাড়ত নিঃসন্দেহে। বেচারার ভাগ্যটা যে একদমই সাথে ছিল না সেটির প্রমাণ মিলেছে রিভিও তে। ফিল্ডারদের ওপর আস্থা হারিয়ে স্ট্যাম্প সই করা বোলিংয়ে যখন ব্যাটসম্যানকে বিট খাওয়ালেন, তখন এলবির আবেদন আম্পায়ার নাকচ করলে রিভিও নিয়েও ভাগ্যের শিকে ছিড়েনি তার!

আমাদের নির্বাচকদের মন জোয়ার ভাটার মতনই, তাই খালেদের মাঠের নৈপুণ্যের বদলে যদি বোবা পরিসংখ্যানকে সাক্ষ্য মেনে পরের টেস্টেই তাকে দর্শক বানিয়ে দেয়া হয় বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। বরং, আফসোসের জনম নিবে। যা দেখলাম, তাতে খালেদ যদি সঠিক পরিচর্যা পায় তাহলে ঘন্টায় ১৪০ কিমিতে বল করতে সক্ষম একজন কার্যকর বোলার পাবে বাংলাদেশ। সাথে বৈচিত্র্যের ভান্ডার নিয়ে ফিজ তো রয়েছেনই। আশা করি একবারের জন্য হলেও আমাদের ভুল প্রমাণ করে নির্বাচকরা খালেদে আস্থা রাখবেন।

সাকিব ফিরে আসলেই মাহমুদুল্লাহর আপাতকালীন দায়িত্ব শেষ। তবে, শেষ করার আগে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেটি সমালোচনা করার মতন তো নয়ই মনে দাগ কাটার মতন। আর অজ্ঞের বিজ্ঞ সাজার প্রয়াস চালিয়ে যদি সমালোচনা করতেই চান, তা করতে পারেন। আখেরে নিজের ক্রিকেট জ্ঞানের দেউলিয়াত্ব ছাড়া অন্য কিছু প্রকাশ পাবে না তাতে।