এখনো হাতে বিস্তর সময় থাকলেও সম্প্রতি দুটো ভিন্ন সাক্ষাৎকারে রোনালদো এবং ভারান ব্যালনের জিকর করায় ভক্তকূলের মধ্যে আবারো ব্যালন কেন্দ্রিক আলোচনা শুরু হয়েছে। বলাই বাহুল্য, আলোচনা বললেও সেটি মূলত তর্ক বিতর্কই। ইতোমধ্যেই ইউরোপের বর্ষসেরা এবং ফিফার বেস্ট হিসাবে মদ্রিচের নাম ঘোষণা হয়ে গেলেও ব্যালনের আবেদন বা আকর্ষণ কমেনি বেশ কিছু কারণে। সেসবের পাশাপাশি তাশহির দেয়ার চেষ্টা করবো রোনালদোর বয়ানের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে।
বেস্ট নির্ধারণের প্রক্রিয়া, যেটি মাঝে ব্যালনের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছিল সেটি নিয়ে সমালোচনা ছিল বিস্তর। কিন্তু, ব্যালন যতবার আলাদাভাবে এই পুরষ্কারটি দিয়েছে সেটির গ্রহণযোগ্যতা খুব কমই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সম্প্রতি মার্কার এক খবরে, যেটি বেখবর হলেই মঙ্গল; তাতে যা দাবি করা হয়েছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে হুমকির মুখে পরবে ব্যালনের গ্রহণযোগ্যতাও। জিকর করব সে বিষয়টিরও।
রোনালদোয় বা মার্কায় যাবার আগে ভারানের বয়ানটার ব্যবচ্ছেদ করে একটু ভারমুক্ত হই আগে। তিনি বলেছেন সাম্প্রতিক সময়ে তিনি যা করেছে ব্যালন জয়ের জন্য তা যথেষ্ট! গত মৌসুম বাদই দিন, চলতি মৌসুমের হাল হকিকত সম্পর্কে যিনি ওয়াকিফ তার কাছে ভারানের এ বয়ানের পেছনে দুটো উদ্দেশ্য কাজ করতে পারে বলে মনে হতে পারে,
- নিজেকে ভাড় প্রমাণ করে হলেও গণমাধ্যমের নজরে আসা
- নিজের সম্পর্কে পরিপূর্ণ অজ্ঞতা
এমনটি বলছি কারণ, বিশ্বকাপ বাদে দিলে যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের বিষয়টিকে তিনি সামনে আনতে চাচ্ছেন তাতে তার অবদান কতটুকু সে বিষয়ে খোদ তার সমর্থকরাই সন্দিহান বলেই আমার বিশ্বাস। আর, চলতি মৌসুমে রিয়ালের শ্রী হরণ এবং লোপেতিগের ইজ্জত হরনের অন্যতম মূল কারিগর তার তুলনাহীন রক্ষণকর্ম। এরপরেও নিজেকে ব্যালনে দাবিদার ইয়াকিন করা হয় ভাড়ামো নতুবা চূড়ান্ত মূর্খতা।
রোনালদোর বয়ানে রোনালদো যেটি বলেছেন, সেটি নিয়ে দ্বিমত করার মত কোনো আদমি কায়ানাতে আছে বলে ইয়াকিন করা কঠিনই। কিন্তু, স্প্যানিশ গণমাধ্যম মার্কার ফাঁস করা তথ্য মতে বেস্টের পর ব্যালনও রোনালদোর হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। এবং যে বরাতের উল্লেখ করে তারা সংবাদটি ছেপেছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে সেটি শুধু বিস্ময়করই না; জনম দিবে চরম বিতর্কেরও। ব্যালনের শীর্ষ তিনে নাকি মেসি-রোনালদো কারুর নামই নেই। শীর্ষ তিনে রয়েছেন মদ্রিচ, ভারান এবং এমবাপ্পে।
তালিকাটি দেখার পর এটি নিয়ে সাওয়াল জাগা খুবই স্বাভাবিক। পুরষ্কারটি দেয়া হয় ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ভিত্তিতে। অন্তত পুরষ্কারদাতাদের দাবি বিশ্বাস করলে এটিই মানতে হয়। সেটি যদি সত্যিই হয়, তাহলে ঠিক কোন যোগ্যতায় ভারান এবং এমবাপ্পে শীর্ষ তিনে সেটির ব্যাখ্যা করা কঠিন। ভারানের ক্ষেত্রে কাজ করছে তার দুটো মেজর শিরোপা এবং এমবাপ্পের ক্ষেত্রে বিশ্বকাপ জেতা।
এখন বিবেচনার সীমারেখা যদি শুধু মাত্র বিশ্বকাপ হত তাহলে শেষের দু’জনের নাম শুরুতে থাকাটা বিস্ময়কর কিছু বলে মনে হত না। রাশিয়ায় রোশনী ছড়িয়েছেন দুজনই। কিন্তু, পুরো মৌসুমই যখন বিবেচনায় আসে; তখন কিছু সাওয়াল স্বাভাবিক।
যে দুটো মেজর জয় ভারানের মনোনয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে, তার একটি; চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পুরোটা সময়ই বলতে গেলে রিয়ালকে ভুগতে হয়েছে রক্ষণের জন্য। ভারান নিজের উপস্থিতি জানান দেয়া তো দুর, পেপের শূণ্যস্থানই তো ঠিক মতন এখনো পূরণ করতে পারেননি। রিয়াল যে তেরোতম শিরোপা জয়ের উৎসবে মাতোয়ারা হতে পেরেছে সেটি রোনালদোর কারণেই। হ্যা, ফাইনালটা তিনি নিজের মত করে রাঙ্গাতে পারেননি সত্য, কিন্তু সে ম্যাচটিতেও বেনজেমা-বেলে ভর করে রিয়াল লিভারপুলের রক্ষণের যে পরীক্ষাটি নিয়েছিল তার আধ্ধেকও লিভারপুল নিতে পারে নি।
এমবাপ্পে বিশ্বকাপে উজ্জ্বল ছিলেন। লিগ ওয়ানও জিতেছেন বটে। কিন্তু ক্লাব পর্যায়ের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন রিয়ালের হাতে, আরো স্পষ্ট করে বললে দুই লেগে রোনালদোর হাতেই।
রোনালদো মেসি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বেই বিদায় নিয়েছেন সত্য। কিন্তু রোনালদো বিশ্বকাপে বাদপড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আর মেসি তো একরকম একাই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে টেনে এনেছিলেন। আর্জেন্টিনা নক আউটও নিশ্চিত করেছিল তার পায়ের জাদুতেই। ক্লাবের হয়েও অসাধারন সময় কাটিয়েছেন তিনি। অল্পের জন্য প্রথম স্প্যানিশ ক্লাব হিসাবে অপরাজিতভাবে লিগ শেষ করার রেকর্ডটি গড়তে পারেনি বার্সা। সুতরাং, সামগ্রিক দিক বিবেচনায় নিলে এ দুজনের শীর্ষ তিনেও না থাকা অস্বাভাবিক তো বটেই, পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
রোনালদো যেমনটি বলেছেন, তার সারমর্ম দাড়ায় এখনো তাদের অর্থাৎ তার এবং মেসির সমকক্ষ কেউ নেই। কথাটি যে শুধুই কথার কথা না, সেটি তো চলতি মৌসুমেও দেখা যাচ্ছে। ইতালির প্রেমিকা জুভেন্তাসের জার্সি গায়ে নয়া রাফতারে ছুটে চলেছেন পর্তুগিজ যুবরাজ। মেসিও বরাবরেই মতই মুগ্ধকর এবারও। এবং, খুব স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, স্ব স্ব ক্লাবের ফলাফলে মূখ্য ভূমিকা পালন করছেন দুজনই।
মদ্রিচের ক্ষেত্রে একটি সুবিধা রয়েছে, সেটি হচ্ছে ক্রোয়েশিয়ার মতন একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন। যেটি বিশ্বকাপের মাঝপথেও ছিল কল্পনাতীত। রিয়ালের জার্সি গায়ে মাঝে ফর্ম হারালেও নিজেকে খুঁজে পেতে খুব বেশি সময়ও নেননি।
এখন, এখানে একটি অপ্রিয় সাওয়াল সামনে চলে আসছে। এই পুরষ্কারগুলোর পিছনে কি শুধুই ফুটবলীয় নৈপুণ্য প্রাধাণ্য পায়? নাকি বাণিজ্যিক বিষয়ও বিবেচনায় আসে? কিছু দিন আগেই রোনালদোর ধর্ষণ কাহিনী ফালাও করে প্রচার করেছে বিশ্ব মিডিয়া, যদিও এর সত্যতা এখনো প্রমাণিত না। কিন্তু, এহেন আলোচনা রোনাদোর ভাবমূর্তিতে যে ছাপ ফেলেছে সেটি স্পষ্ট।
আর মেসি আরো একবার বিশ্বকাপে আলসাবিলেস্তেদের জার্সি গায়ে বিশ্বমঞ্চে ব্যর্থ হওয়ায় তার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্বও সম্মুক্ষীণ অপ্রিয় সাওয়ালের। এমন অবস্থায় উদিয়মান তারকা এমবাপ্পে বাণিজ্যের বাজারে নতুন তুরুপের তাস হতে পারেন। সুতরাং, বাণিজ্যিক দিক বিবেচনার বিষয়টি একদমই উড়িয়ে দেয়ার মত না। বিশেষ করে, ইদানিং ক্রীড়া জগৎ যেখানে মুখোমুখি নির্লজ্জ্ব বাণিজ্য লিপ্সার।
মেসি রোনালদোর যে দশ বছরের রাজত্বকাল, তাও যে একদমই বিতর্ক ছিল না তা না, কিন্তু সেটি এ দুজনের ভক্তকুলের মধ্যেই। এবং দু’জনকার মধ্যে ব্যবধানও ছিল ঊনিশ-বিশ। সদ্য সমাপ্ত থেকে চলতি মৌসুম পর্যন্ত এমন কোনো নাজাকাত কেউ দেখিয়ে ফেলেননি যে এরা শীর্ষ তিনেই জায়গা পাবেন না। এখনো এটিকে গুজবই বিবেচনা করতে চাই, কেননা বাস্তবিকই যদি শীর্ষ তিনের ক্রম মার্কার ফাঁস হওয়া তালিকার সাথে মিলে যায় তাহলে বিস্তর বিতর্কই শুধু নয় গ্রহণযোগ্যতাও হারাতে পারে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের এই অঘোষিত মুকুট।
এমনটি ঘটলে ব্যালন বিতর্কিত হবে রোনালদোর বয়ান না, কেন সেটা তো উপরেই উল্লেখ করেছি। এর আগেও একাধিক নাম সামনে আনা হয়েছে রোনালদো-মেসির শ্রেষ্ঠত্বের হুমকি স্বরুপ। কিন্তু তাদের রাজত্বে হানা দিতে পারেননি কেউই। ফুটবলীয় বিবেচনা মূখ্য হলে এবারো তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা কমই।