জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড ছিল সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। এই ঘটনায় তুরস্ক এবং সৌদি আরবের অবস্থান ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক। দুটি ইসলামিক রাষ্ট্রের এই বিরোধ কেন এবং কিসের বিরোধ? তাই নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিখ্যাত তাত্ত্বিক ফয়সাল দেবজি। এখানে জবানের পাঠকদের জন্য নিউইয়র্ক টাইমস– এ প্রকাশিত কলামটি অনুবাদ করে দেয়া হল।
ইস্তাম্বুলে সৌদি এজেন্ট দ্বারা জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড শুধু প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের স্বৈরাচারী এবং বেপরোয়া আচরণের দিকেই আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়েছে তাই নয়। বরং এটি সৌদি এবং তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে; যা মূলত ইসলামেরই প্রতিদ্বন্দ্বী রূপের প্রতিনিধিত্ব করে।
সৌদি আরবে রয়েছে রাজতন্ত্র যা একধরেন ইসলামের সামাজিক রীতি-নীতি ও সম্পর্ক দ্বারা সংজ্ঞায়িত এবং সেখানে কোন রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া নেই। অন্যদিকে তুরস্ক একটি প্রজাতন্ত্রী দেশ, যা প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান এবং তার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি দ্বারা শাসিত। এই সরকার বহু রক্ষণশীল মুসলমানদের ভোট দ্বারা ক্ষমতায় আসে।
একটি প্রভাবশালী সৌদি কণ্ঠ ছাড়াও জামাল খাশোগি বিগত বছরগুলোতে শাসনের এই প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামের রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি সৌদি শাসকের একজন অনুগত উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু তিনি এরদোগান ও তার পার্টিকে পছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন তুরস্ক গণতান্ত্রিক উপায়ে ইসলামিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তনে একটি আদর্শ মডেল যা মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শেরও প্রতিনিধি।
ইসলামীজম রাজতন্ত্রীয় অঞ্চলগুলোকে একটি অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখে। আরব বসন্তের পর মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসলে কাতার এবং কিছু ক্ষেত্রে ওমান ও কুয়েত আতঙ্কিত ছিল। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্রাদারহুড সরকারের বিরুদ্ধে মিশরীয় সামরিক বাহিনীর অভিযান এবং অভ্যূত্থানকে সমর্থন করে অর্থের যোগান এবং উৎসাহ দেয়। অন্যদিকে তুর্কি এবং এরদোগান ব্রাদারহুডকে সাহায্য করে এবং অভিযানের পরে ব্রাদারহুড নেতৃবৃন্দ ও সদস্যদের আশ্রয় প্রদান করেন।
“মুসলিম ব্রাদারহুডের অবসান গণতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং বিলুপ্তির নিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই না। আরবরা স্বৈারাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ শাসনের অধিনে বসবাস চালিয়ে যাবে।”
জামাল খাশোগি এই বিপজ্জনক ত্রুটিরেখার দু’পাশে পা দিয়েছিলেন এবং হতে পারে এটি তার গুপ্তহত্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি সৌদি-সমর্থিত অভ্যূত্থান এবং অভিযান নিয়ে লিখেছিলেন, “মুসলিম ব্রাদারহুডের অবসান গণতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং বিলুপ্তির নিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই না। আরবরা স্বৈারাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ শাসনের অধিনে বসবাস চালিয়ে যাবে।”
ইসলাম রাজতান্ত্রিক এবং প্রজাতান্ত্রিক দ্বন্দ্বের শীতল যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যায় যখন আরব রাজতন্ত্রগুলো পশ্চিমা শক্তি ধারা সুরক্ষিত হতে শুরু করে, তারা সেক্যুলার এবং কখনো কখনো সমাজতান্ত্রিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে থাকে। এই সময় ইসলামপন্থীদের উভয়েই একে অপরের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর, এখন সিরিয়াই সর্বশেষ সেক্যুলার একনায়কতন্ত্রের প্রতিনিধি— এটি এমন একটি রাজনৈতিক ফর্ম যা একসময় মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার একটা অংশে রাজত্ব করছিল।
ইসলামীজম মতাদর্শগত রাষ্ট্রের বিষয়ে নিজেই নিজেকে কূটনৈতিক বা শীতল যুদ্ধে জড়ায়, এটি ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তাদের সবচেয়ে বড় বিজয় উপভোগ করে এবং এক দশক পরই সুদান দখল করে। একই সাথে ইসলামইজম তুর্কি এবং তিউনিশিয়ায় নির্বাচিতভাবে ক্ষমতায় আসে। এই দেশগুলোতে সামাজিক রক্ষণশীলদের জনজীবনে জায়গা দেওয়ায় এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের স্বীকৃতি দেয়ায় মনে হচ্ছিল, এটি তার পথ হারিয়েছে বা এটি পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে।
একটি দীর্ঘ সংগ্রামের অবশিষ্ট হিসেবে, রাজতান্ত্রিক এবং প্রজাতান্ত্রিক মুসলিমদের প্রতিযোগিতা একটি প্রান্তিক পরিণতিতে পৌঁছায়। বেশির ভাগ অঞ্চলের রাজকীয় প্যালেসগুলো আধুনিক সৃষ্টি এবং ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত না হলেও অন্তত উৎসাহিত। তাদের নিজেদের বৈধতা দেওয়ার মতো কোন রাজনৈতিক আদর্শ বা তত্ত্ব নেই, নাগরিক অধিকারের পরিবর্তে তারা বিশ্বাস আদায় করে, তাদের কর্মী, শেয়ারহোল্ডার এবং বোর্ডের মেম্বারদের বেতন এবং শাস্তি নিশ্চিতের ব্যাপারে শ্রেফ আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করে। আর এই কারণেই ইসলাম সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি ফর্ম হিসেবে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর, এখন সিরিয়াই সর্বশেষ সেক্যুলার একনায়কতন্ত্রের প্রতিনিধি— এটি এমন একটি রাজনৈতিক ফর্ম যা একসময় মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার একটা অংশে রাজত্ব করছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসলামইজম একটি ভুল পথে পরিচালিত ইস্যু হয়ে উঠেছে। ব্রাদারহুড মিশরীয় বিপ্লবের অগ্রদূত ছিলনা কিন্তু তা এর দ্বারা ধরা পড়ে। এই ব্যাপারটি কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতাচ্যূত করার মতো জনপ্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে কোন দলকে ক্ষমতায় বসানো ছিলো; যা দেশটিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও স্বৈরতন্ত্রের প্রয়োগকে সমর্থন দিয়ে ফেলে। এই ঘটনায় ব্রাদারহুডের বিরোধীদের ধর্মীয় পর্যবেক্ষণ ছিল, ইসলামপন্থীরা সেক্যুলার অভিজাতদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ইসলামের গণতন্ত্রায়ণ এবং বিভাজনের উপলব্ধি রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।
ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক উভয়ের ক্ষেত্রেই তাদের ধর্ম ঐতিহ্যবাহী ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৯৯০ সালে ‘জিহাদ’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থীরা নিজেদের পৃথক করে রেখেছিল; যা তাদের নির্বাচনী গণতন্ত্র, এমনকি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এবং যখন তাদের সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ইসলামপন্থীদের মতো, এই জঙ্গি সংগঠনগুলোকে আঞ্চলিক সরকার একে অপরের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করে।
ইসলামীজমের পতনকে তুর্কি যেভাবে তার সাবেক সহযোগীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে তার সাথে পরিমাপ করা যায়, দ্যা গুলেন মুভ্যমেন্ট, যা ২০১৬ সালে বিদেশি সহযোগিতায় অভ্যূত্থান সংঘটনের অভিযোগ আনে। ইসলামিক হুমকি নির্মূলে তুর্কিও মধ্যপ্রচ্যের সরকারের মতো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা আন্তর্জাতিক লিঙ্ক এবং বৈদেশিক স্পন্সরের সাহায্য নেয়। তারা জানায় যে, ইসলামকে শুধু রাষ্ট্রের একচেটিয়া পরিষেবায় রাখলেই সহ্য করা হবে, অন্যথায় না। তারা ধর্মের ক্ষেত্রে সেক্যুলার এবং থিওক্রেটিক দেশগুলোর চেয়েও বেশি সীমা নির্ধারণ করে দেয়।
ইরান যদি আজ উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলির জন্য সাধারণ সেনা অথবা অর্থনৈতিক হুমকির চেয়ে মতাদর্শকে প্রধান করে দেখে, তবে তা সম্ভব হয়েছে অসম্ভাব্য শিয়া বিপ্লবের জন্য যা অবশ্যই ইসলামবাদের জন্য দাঁড়িয়েছিল এবং আরব বিশ্বে যার আর কোন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। অথবা এর ভবিষ্যৎ তিউনিশিয়ার ইন্নাহাদা পার্টির মতো হতে পারে যা আরব বসন্তের একমাত্র সফল বিপ্লবে ব্রাদাহুডের আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রত্যাখান করেছিল।
ইসলামবাদ এখন বারংবার উচ্চারণ করা হচ্ছে কারণ এটি হ্রাস পাচ্ছে। এর সমর্থকরা এমনকি প্রতিদ্বন্দীরা ব্রাদারহুডকে সমর্থন করতে আগ্রহী, সেক্ষেত্রে কিছু মতাদর্শ ধার দিয়ে হলেও তারা তা করতে আগ্রহী।
তবুও পাশ্চাত্যে, প্রেস এবং মানবাধিকার অগ্রসরমান হওয়ায়. খাশোগির মৃত্যু উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, এবং এমন সময় যখন মধ্যপ্রাচ্য একটি আঞ্চলিক সম্পর্ক তৈরির সংগ্রাম শেষ করে আসছে; এই পশ্চিমা সম্পর্কের সাথে পশ্চিমা ক্ষমতা বা ভূগোল যুক্ত নয়। এটি রাজনৈতিক।
জামাল খাশোগি হত্যায় পশ্চিমে ক্ষোভের কারণে কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদরা মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অন্যান্য হুমকি বিষয়ে আরও হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা রাজনীতি থেকে সরে আসে। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াও গোপন রাখতে পারে না যে, এখানে মতাদর্শগত বৈশিষ্ট্য কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? ইসলামের তিনটি শক্তি- তুর্কি, ইরান এবং সৌদি আরব তাদের স্বৈরাচারী আকাঙ্ক্ষার কারণেই মতাদর্শগত রাষ্ট্রের পরিবর্তে রাজনীতিতে নিষ্ঠুর সেক্যুলারিজমকে আহ্বান করে।
যখন এই তিনটি দেশই ধর্মকে তাদের কর্তৃত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে, তখন এটি ইসলামের সাধারণ সার্বজনীনীকরণের মধ্যে পড়ে এবং আরও অন্যান্য উপায়ে তা ইসলামকে অকেজো করে দেয়। যার ফলে ইসলাম এই অঞ্চলের মুসলিম সমাজের জাতীয় চরিত্র নির্মাণ ব্যাতিত কিছুই গঠন করতে পারে না।