ইবনে খালদুন এবং ম্যাকিয়াভেলির চিন্তায় রাষ্ট্র এবং ধর্ম

ইবনে খালদুন এবং ম্যাকিয়াভেলির চিন্তায় রাষ্ট্র এবং ধর্ম

রাষ্ট্র এবং ধর্মের দ্বৈরথ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক মোটেও নতুন কিছু নয়। এই দুয়ের মাঝে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, একটার জন্য আরেকটার আবশ্যকীয়তা কতটুকু – তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ ইং) এর রাষ্ট্র চিন্তায় ধর্মের উপস্থিতি কেমন তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যায়। আমরা জানি, যেকোন বোমার একটি আবশ্যক উপাদান হচ্ছে টিএনটি। সাধারণ বোমা থেকে নিয়ে পারমানবিক বোমা পর্যন্ত সব ধরণের বোমায় বিষ্ফোরক হিসেবে টিএনটি ব্যাবহার করা হয়। তাহলে একটি সাধারণ বোমা আর একটি অ্যাটম বোমার বিস্ফোরণের মধ্যে কোন জিনিসটা এতো বিশাল ব্যাবধান তৈরি করে দেয়? হ্যাঁ, সেটি হচ্ছে আনবিক শক্তি। খালদুন এক কথায় রাষ্ট্রের জন্য ধর্মকে আনবিক শক্তির মতো মনে করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের যে ‘আসাবিয়্যা’ শক্তির উপর টিকে থাকে সেই আসাবিয়্যায় প্রচণ্ড বাড়তি শক্তি যোগায় ধর্ম। আসাবিয়্যার খোলাসা কথা হচ্ছে- এমন একটি গভীর বন্ধন, যা বড় সংখ্যক মানুষকে বা একটি জাতির সদস্যদেরকে পরষ্পরের সাথে ঐক্যবদ্ধ করে রাখে। ধর্ম কিভাবে কাজ করে, বা কিভাবে আসাবিয়্যায় এক্সট্রা পাওয়ার যোগ করে – তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন ‘আল মুকাদ্দিমা’র তৃতীয় অধ্যায়ের পঞ্চম পরিচ্ছেদে। সংক্ষেপে যেটা বলা যায় সেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে আসাবিয়্যা পূর্ণরুপে বিদ্যমান থাকলেও তাদের মধ্যে পরষ্পর প্রতিযোগিতা, হিংসা, হানাহানি ইত্যাদি থাকলে তাদের লক্ষ্য কখনো এক হতে পারে না। রাষ্ট্রের জন্য তারা কখনো নিবেদিতপ্রাণ হতে পারে না। আসাবিয়্যার সাথে যখন ধর্ম যোগ হবে তখন সেটা তাদের নৈতিক ভিত্তি মজবুত করবে। তাদের মানবিক দূর্বলতা এবং ত্রুটিগুলো হ্রাস করে তাদেরকে অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করবে। রাষ্ট্র রক্ষায় এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে তাদেরকে নিবেদিতপ্রাণ করে তুলবে। তারপর তিনি দেখিয়েছেন, যদি এমন দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে লড়াই হয়, যেগুলো জাগতিক শক্তিমত্তা এবং আসাবিয়্যায় সমান সমান হয়, কিন্তু একটির মধ্যে ধর্মের উপাদান আছে যা অপরটিতে নাই, তাহলে নিশ্চিতভাবে প্রথমটি বিজয় লাভ করবে। এর প্রচুর উদাহরণ তিনি টেনেছেন। কিভাবে কাদসিয়া এবং ইয়ারমুকে নিজেদের চেয়ে সামরিক শক্তিতে কয়েক গুণ এগিয়ে থাকা চৌকষ সেনাবাহিনীকে মুসলিম ফৌজ পরাজিত করেছিল! কিভাবে স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকার মুওয়াহহিদীনরা ধর্মের বলে বলিয়ান হয়ে তাদের চেয়েও দুর্ধর্ষ উত্তর আফ্রিকান ‘যানাথা’ জনগোষ্ঠীকে পরাজিত করেছিল! ঠিক এর বিপরীতে যখন মুওয়াহহিদীনদের মধ্যে ধর্মের আদর্শ লোপ পায় তখন কিভাবে যানাথারা পূণরায় দাবার ছক ঘুরিয়ে দিয়ে তাদেরকে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় করে ছাড়ে!

ইতিহাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। ১. পরিপূর্ণ খিলাফাহ বা খিলাফায়ে রাশেদাহ। ২. খেলাফাহ্ এবং মুলকের (রাজতন্ত্রের) সমন্বয়ে তৈরি ব্যবস্থা। ৩. পরিপূর্ণ মুলক বা সালতানাত। (তার পূর্বে ইবনে তাইমিয়্যাও এরকম বিভক্তি করেছেন)। খালদুনের মতে একমাত্র প্রথমটিই শরীয়ত সমর্থিত ব্যবস্থা।

 

খালদুনের এই চিন্তার পটভূমি হচ্ছে তার যুগ পর্যন্ত চলে আসা সাতশো বছরের ইসলামী শাসনের উত্থান পতনের ইতিহাস। তিনি এই ইতিহাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। ১. পরিপূর্ণ খিলাফাহ বা খিলাফায়ে রাশেদাহ। ২. খেলাফাহ্ এবং মুলকের (রাজতন্ত্রের) সমন্বয়ে তৈরি ব্যবস্থা। ৩. পরিপূর্ণ মুলক বা সালতানাত। (তার পূর্বে ইবনে তাইমিয়্যাও এরকম বিভক্তি করেছেন)। খালদুনের মতে একমাত্র প্রথমটিই শরীয়ত সমর্থিত ব্যবস্থা। এটাই প্রকৃত এবং একমাত্র খেলাফাহ ব্যবস্থা। বাকি দুটোকে যদিও ইতিহাসে খেলাফাহ বলা হয়, সেটা কেবল শাব্দিক অর্থে। প্রকৃত অর্থে নয়। তিনি দেখেছেন, মুসলমানদের শাসন বিচ্যুতির অবনতি ঘটতে ঘটতে তার যুগে এসে মুসলিম জাতির ভাগ্য কতো করুন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে! মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গলদের এবং স্পেনে খ্রীষ্টানদের আক্রমনে মুসলিম সালতানাতের কী অবস্থা হয়েছিল! তারও আগে ক্রুসেডাররা কিভাবে শাম এবং মিসরে মুসলমানদের ভাগ্য নিয়ে ২০০ বছর পর্যন্ত তামাশা করেছে! এর সব কিছুর পেছনে তিনি মুসলমানদের ধর্মহীনতাকে দায়ী করেছেন। ইসলামের সঠিক আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়াকে দায়ী করেছেন। খেলাফাতে রাশেদাকে পরিবর্তন করে তার জায়গায় গোষ্ঠীকেন্দ্রিক এবং কায়েমী স্বার্থকেন্দ্রীক রাজত্ব কায়েম করাকে দায়ী করেছেন। এসব রাষ্ট্রে আসাবিয়্যাহ মোটামুটি ছিল। কিন্তু ধর্মের সঠিক উপাদান থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এই আসাবিয়্যা তাদের রাষ্টকে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায় নি। তাই তিনি তার যুগের করুন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে পূণরায় আসাবিয়্যার সাথে ধর্মকে সঠিক ভাবে সংযুক্ত করার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। আসাবিয়্যা এবং নগরায়ণের পাশাপাশি এটাকেও বিজয়ের অন্যতম শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

মডার্ন পলিটিক্যাল সাইন্সের আদিপিতা ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ ইং) খালদুনের প্রায় ৬৩ বছর পরে জন্মগ্রহণ করেছেন। সে হিসেবে তাদের মধ্যে সময়ের পার্থক্যটা খুব বড় নয়। তৎকালে খালদুনের মধ্যপ্রাচ্য আর ম্যাকিয়াভেলির ফ্লোরেন্স বা ইতালির অবস্থার মধ্যেও ব্যাবধান বেশি ছিলো না। একটা সময় ছিল যখন ইউরোপে রাষ্ট্র এবং গীর্জা একসাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে জনগনকে শাসন করতো। দুই পক্ষই একরকম ভারসাম্য বজায় রাখতো। কিন্তু শেষের দিকে এসে গীর্জা অসহিঞ্চু হয়ে উঠে। সে রাষ্ট্রকে কোনঠাসা করে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। এক পর্যায়ে সফল হয়। ইতালিতে রাষ্ট্রকে একরকম সরিয়ে দিয়ে নিজেই শাসনভার হাতে নেয়। অন্যান্য রাষ্ট্রে রাষ্ট্রকে না সরালেও নিজেই হয়ে ওঠে পর্দার আড়ালে প্রকৃত শাসক। কিন্তু গীর্জার অবর্ণনীয় জুলুমের কারণে এই পরিস্থিতি বেশি দিন টিকেনি। ধীরে ধীরে গীর্জার বিরুদ্ধে বলার মতো লোকের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। Dante Alighieri (1265-1321) এবং Marsilius of Padua (1275-1342) এর মতো মানুষরা গীর্জার জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এর পর প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। এরকম বিশৃঙ্খল একটি পরিস্থিতিতে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফ্লোরেন্সে (ইতালি) জন্মগ্রহন করেন ম্যাকিয়াভ্যালি। তিনিও খালদুনের মতো নিজের কওমের চরম দূর্দিনে দুনিয়াতে আসেন। তিনিও দেখতেছিলেন যে, ধর্ম এবং রাষ্ট্রের দ্বিমুখী সংঘর্ষে কিভাবে তার জাতি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

তবে, দুই জনের চিন্তার মধ্যে বড় পার্থেক্যের জায়গা হলো, খালদুন ধর্মহীনতাকে তার জাতির পতনের জন্য দায়ী মনে করেছেন। আর ম্যাকিয়াভ্যালি ধর্মের বাড়াবাড়িকে তার জাতির পতনের জন্য দায়ী মনে করেছেন। তাই তিনি তার অনবদ্য গ্রন্থ ‘The Prince’ এ ধর্ম নিয়ে এক রকম ঠাট্টা করেছেন। ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন এখানে।

কিন্তু এটাই কি ম্যাকিয়াভ্যালির শেষ কথা? না, মোটেও নয়। প্রিন্স পড়লে এটা মনে হতে পারে। তবে, ‘ডিস্কোর্স অফ ম্যাকিয়াভ্যালি’তে গিয়ে তার চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। তিনি দেখলেন যে, ধর্মহীন রাষ্ট্র ফোকলা এবং ঠুনকো। নাগরিকদের আনুগত্য ধরে রাখার জন্য রাষ্ট্রের কাছে ধর্মের প্রয়োজন আছে। তাছাড়া, ধর্মের প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে রাষ্ট্র অযথাই শক্তিক্ষয় করবে। তাই তিনি ধর্মকে স্পেস দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তিনি ধর্মকে আইনের অধীনে একটি পাওয়ার ব্যাংক হিসেবে ব্যাবহার করার ফর্মুলা দিলেন।

ইতালিতে রাষ্ট্রকে একরকম সরিয়ে দিয়ে নিজেই শাসনভার হাতে নেয়। অন্যান্য রাষ্ট্রে রাষ্ট্রকে না সরালেও নিজেই হয়ে ওঠে পর্দার আড়ালে প্রকৃত শাসক। কিন্তু গীর্জার অবর্ণনীয় জুলুমের কারণে এই পরিস্থিতি বেশি দিন টিকেনি। ধীরে ধীরে গীর্জার বিরুদ্ধে বলার মতো লোকের সংখ্যা বাড়তে লাগলো।

 

এভাবেই রাষ্ট্র এবং ধর্ম প্রশ্নে ম্যাকিয়াভেলিও শেষ পর্যন্ত খালদুনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আংশিকভাবে হলেও ধর্ম প্রশ্নে চৌদ্দ এবং পনের শতকের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দুই দিকপাল ঐক্যমত পোষণ করলেন। তবে, পদ্ধতিগত ভাবে দু’জনের চিন্তার ফারাকের জায়গাটাও খুব একটা ছোট না।

খালদুন বা তার মতো মধ্যযুগের স্কলারদেরকে পাঠ করতে হলে দুটি বিষয় অত্যাবশ্যকীয় ভাবে মাথায় রাখতে হবে।

১. আমাদের সময়ের সাথে তাদের সময়ের ব্যাধানটা স্পষ্টভাবে মাথায় রাখতে হবে। যেকোন থিওরির উদ্ভাবনের একটি পটভূমি থাকে। সেটা প্রয়োগেরও একটা সময় থাকে। বইয়ে পেলেই যে সেটাকে সর্বাবস্থায় কার্যকর বা প্রয়োগের যোগ্য মনে করা হবে তা নয়। এমনও হতে পারে যে, তত্ত্বটি উদ্ভাবকের যুগের জন্য খুবই উপযোগী এবং উপকারী ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যাবধানে বর্তমানে এসে সেটা কার্যকর নাই। এটা উদ্ভাবকের কোন ত্রুটি নয়। এটা প্রকৃতির নিয়ম। ঠিক এই কারণে খালদুন পাঠ করার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইউরোপের শিল্পবিপ্লব তার পরের এবং পূর্বের সময়ের মধ্যে অনেক বড় আকারের একটি দেয়াল তুলে দিয়েছে। এর ফলে দুনিয়া আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। শিল্প-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে নিয়ে বানিজ্যসহ সবকিছুতে নতুন যুগের সূচনা হয়। জাতিরাষ্ট্রগুলোর উত্থান পতন হয় কল্পনার চেয়েও দ্রুত গতিতে। গোটা দুনিয়া ইউরোপের গুটি কতক রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়। শুরু হয় ঔপনিবেশিক শাসনের কালো অধ্যায়।

 

২. খালদুনসহ তখনকার লেখকদের রচনা পদ্ধতির নির্দিষ্ট একটি নিয়ম ছিল। এখনকার মতো তখন পরিভাষা ব্যাবহার করার মধ্যে অত বাধ্যবাধকতা ছিলো না। তাই দেখা যায় তারা তাদের লেখায় একই পরিভাষাকে একাধিক বার ব্যবহার করছেন। কিন্তু সব জায়গায় একই অর্থে না। ভিন্ন ভিন্ন অর্থে। যেমন খেলাফত এবং মুলক শব্দ দুটো। আবার নির্দিষ্ট একটি অর্থকে কয়েক বার কয়েক জায়গায় বুঝিয়েছেন। তবে প্রত্যেকবারই ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। এটা থেকে আমাদেরকে যেটা বুঝতে হবে যে, তার পরিভাষাগুলোকে কেবল গৎবাঁধা আক্ষরিক অর্থে না বুঝে ব্যাপক অর্থে বোঝার সম্ভাবনা আছে। তাই বর্তমান সময়ের সাথে মিলিয়ে তাকে পড়ার সময় বা তার থিওরিকে বর্তমানের উপর প্রয়োগ করার সময় এই ব্যাপারটা মাথায় রাখা অতীব জরুরি।

খালদুন রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব এবং শক্তিমত্তার জন্য আসাবিয়্যার সাথে ধর্মের সংযুক্তিকে জরুরি মনে করেছেন। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে এই কথাটা আপনার মনে প্রশ্ন তৈরি করবে। কলোনিয়াল শাসনের যে সময়টাতে ফরাসি এবং বৃটিশরা ৩০০ বছর পর্যন্ত দুনিয়াকে দাবড়ে বেড়িয়েছে সেই সময়টাতে তাদের রাষ্ট্র কিন্তু ধর্মকে আলাদা করে রেখেছিল।

 

এই সময়ে এসে তাইমিয়া এবং খালদুনের প্রভাব বা প্রয়োজনীয়তা কমেছে সেটা বলছি না। বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের বলা কথাগুলোর আক্ষরিক প্রয়োগ করতে গেলে বা সেগুলোকে মোটা দাগে বুঝতে গেলে আমরা সমস্যায় পড়বো। প্রশ্ন তৈরি হবে, যেগুলোর উত্তর খোঁজা কঠিন হবে। যেমন, ধর্মের কথাটাই বলি। খালদুন রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব এবং শক্তিমত্তার জন্য আসাবিয়্যার সাথে ধর্মের সংযুক্তিকে জরুরি মনে করেছেন। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে এই কথাটা আপনার মনে প্রশ্ন তৈরি করবে। কলোনিয়াল শাসনের যে সময়টাতে ফরাসি এবং বৃটিশরা ৩০০ বছর পর্যন্ত দুনিয়াকে দাবড়ে বেড়িয়েছে সেই সময়টাতে তাদের রাষ্ট্র কিন্তু ধর্মকে আলাদা করে রেখেছিল। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার করেছে, কিন্তু খালদুনের থিওরির মতো ধর্মকে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি বানায় নি। কলোনিগুলোতেও ধর্ম প্রচার তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না। বানিজ্য এবং সম্পদ কুক্ষিগত করাই ছিলো মূল লক্ষ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর পুরাতন কলোনিয়াল যুগ শেষ হয়ে যে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা চালু হয় তার দুই মোড়ল আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও ধর্মকে উপজীব্য করে দুনিয়া শাসন করেনি। আর এখন যে চীনের উত্থান ঘটছে সেখানেও ধর্মের প্রভাব নেই। এগুলোতো গেলো বিশ্বশক্তিগুলোর কথা। আগ্রাসনমূলক নীতি রাখেনা তবে আভ্যন্তরীনভাবে খুবই স্ট্রং রাষ্ট্র প্রচুর আছে যেগুলো বর্তমানে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত নেই। যেমন পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো এবং কুরিয়া জাপানের মতো দক্ষিন এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো। আরো পেছনে গেলে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বের রোমান সাম্রাজ্যের উদাহরণ টানা যায়। রোমান সাম্রাজ্য দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর একটি। সেটাওতো প্রচলিত অর্থে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো না।

এই অবস্থাকে ভাল ভাবে বুঝতে হলে আমাদের সেকুলারিজম নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তালাল আসাদ তার বিখ্যাত বই ফরমেশন অব সেকুলারিজমে যেমন দেখিয়েছন, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যাবস্তায় সেকুলারিজম কেবল মাত্র একটি ধারণা নয়। একই সাথে একটি ডকট্রিন বা হুকুমত। তবে এই সেকুলারিজম যে সব মূল্যবোধ চর্চা করে তাতে গায়েবে বিশ্বাসের মতো ধর্ম না থাকলেও আইন বা যুগের চেতনার নামে যেসব বিধান প্রণয়ণ করে তা ধর্মভাবাপন্ন। এখানে ঈশ্বর চিন্তা নাই কিন্তু ধর্ম যেমন নিজেকে চুড়ান্ত সত্য বলে হাজির করে। সেকুলারিজমও তাই করে। অন্যদিকে সেকুলারিজম কিছু রিচুয়ালও তৈরি করে। সেগুলো সংষ্কৃতির নামে চর্চা করা হলেও এদের সাথে ধর্মবোধের খুব একটা অমিল নাই। কাজেই সেই দিক থেকে এইসব আপাত ধর্মহীন রাষ্ট্রগুলোর ভেতরও ধর্ম সেকুলার ফর্ম রুপে হাজির আছে। কোন কেনা চিন্তক তো মনে করেন, খোদ সেকুলারিটি একটা ধর্ম হয়ে উঠতে চায়।

পশ্চিমা দর্শনের তিন দিক পাল দার্শকি, জুডিথ বাটলার, অ্যালান বাদিয়ূ, হাবারমাস। এই তিনজনের একটি আলোচনার সংকলন ক্যামব্রিজ থেকে বের হয়েছে। যার শিরোনাম, ‘পাওয়ার অব রিলিজিয়ন ইন পাবলিক স্ফেয়ার’। এখানে সাম্প্রতিক দুনিয়ার পোস্টমর্ডান কন্ডিশনেও কি ভাবে ধর্ম জনপরিসরে হাজির আছে তা নিয়ে জরুরী আলাপ আছে। এটা নিয়ে বিস্তারিত কথা এখানে বলার সুযোগ নাই। তবে এখনকার দুনিয়ার স্পিরিচুয়াল ক্রাইসস চরম। তাই আরবান এরিয়াতেও এখন একধরণের সেকুলার স্পিরিচুয়ালিটি চর্চা করা হয়। যেটা আবা রসরাসরি বিভিন্ন ধর্ম থেকেই উৎসারিত। কাজেই ধর্মহীন একটা পৃথিবীর কল্পনা জ্ঞানগত ভাবে সমস্যাজনক। যে কথা বলছিলাম,

তাহলে কি খালদুনের কথা ভুল?

না, ভুল না। তবে আমাদেরকে তাঁর কথাটাকে ব্যাপক অর্থে নিতে হবে। তিনি ধর্মের কথা বলেছেন। মানে আসাবিয়্যাতকে বেগবান করে এবং জনগণকে উদ্যমী করে এমন একটি উপাদানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। সেটা তার যুগে ধর্মের মধ্যেই ছিল। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পরের পিরিয়ডে এই কাজটা অন্য কিছুর মাধ্যমে সমাধা করা হয়েছে বা করা হচ্ছে। যেমন, বর্তমানে আমেরিকা এবং ইউরোপ দুনিয়া শাসন করার জন্য বিশ্বায়ণের ধারণা নিয়ে এসেছে এবং এর উপকরণ হিসেবে ডলার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব ব্যাংক, জাতিসংঘের মতো প্রচুর সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। সোভিয়েতরা মার্কসের কমিউনিজমকে উপজীব্য করে ৭০ বছর পর্যন্ত টিকে ছিলো এবং প্রায় ৪০ বছর দাপটের সাথে আমেরিকার সাথে পাল্লা দিয়েছে। আমেরিকা সৈন্যসামন্ত দিয়ে প্রচুর দেশ দখল করেনি পূর্বের সাম্রাজ্যগুলোর মত বা ভিয়েতনাম আফগানিস্তানে সুবিধা করতে পারেনি এটার দিকে তাকিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে মাপলে ভুল হবে। প্রকৃত অর্থে দুনিয়ার অর্ধেকেরও বেশি জায়গা বর্তমানে আমেরিকান প্রভাবাধীন কলোনি। দুই-তৃতীয়াংশ দেশ বললেও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। তো ধর্ম হয়তো নেই, কিন্তু ধর্মের স্থানে তারা অন্য কিছুকে আসাবিয়্যার সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যাবহার করেছে। তাই খালদুনের কথাটি এখনো পুরোদমে প্রাসঙ্গিক।